লেখক: রোদেলা নীলা
প্রতি বছর শিল্পসাহিত্যের অঙ্গনে সুপরিচিত সুপ্রতিষ্ঠিত কোন লেখককে অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার দিয়ে সন্মানিত করে পাক্ষিক অনন্যা। সেদিন সেই মহতী অনুষ্ঠানে সন্মাননা দেওয়া হয়েছিলো প্রথিতযশা কথা সাহিত্যিক জাহানারা নওশিনকে যিনি কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের বড় বোন। অনুষ্ঠানের মঞ্চ আলোকিত করে বসেছিলেন সংবর্ধনা প্রাপ্ত ব্যক্তি সব্যসাচী লেখক ও কবি সৈয়দ শামসুল হক, কবি আসাদ চৌধুরী, প্রমুখ। ছিলেন অতি অবশ্যই অনন্যা সম্পাদক তাসমিমা হোসেন। রোদেলা নীলা সেই সময় অনন্যায় প্রতিবেদক ও সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতেন। তার মাধ্যমে অনন্যার গোটা পরিবারের সাথে আমার সখ্য গড়ে ওঠে। ইংরেজি ভাষায় বলা যায়- From acquaintance to friendship.
সেদিন সেই অনুষ্ঠানে জানতে পারি রোদেলা নীলার পড়াশোনা গণিত শাস্ত্রে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমারও পড়াশোনা একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যদিও ভিন্ন বিভাগে, গণিতের সাথে কোন রকম সম্পর্ক নেই এমন একটি জ্ঞান কান্ডে। তফাৎ তার সাথে আমার আরও আছে; আমি বয়সে তার থেকে ঢের বড়, চুলে আমার পাঁক ধরেছে বটে। আর একটি বড় পার্থক্য আমাদের মাঝে; আমি স্বভাবতই ঘরমুখী, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় – দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শীষের ওপর একটি শিশির বিন্দু। অপরদিকে রোদেলা নীলা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আবারও বলি – আমি চঞ্চল হে আমি সুদূরের পিয়াসী।
সুদূরের পিয়াসী হবার সুবাদে তিনি গেল বছর আকাশ পথে বেড়াতে গিয়েছিলেন অসাধারণ সুন্দর দেশ অস্ট্রেলিয়ায়; নিকটবর্তী আরও কয়েকটি দ্বীপ দেশ নিয়ে যে মহাদেশের সৃষ্টি হয়েছে। আমি মাঝে মাঝে ভাবি অস্ট্রেলিয়া শব্দটিকে আজ বহু অর্থ জ্ঞাপক একক শব্দ হিসেবে বিবেচনা করবো কীনা নাকি অস্ট্রেলিয়া ভাষা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে হাইপারোনিমি (Hyperonymy) বা সুপার অর্ডিনেট (Super ordinate) হিসেবে বিবেচিত হবে।
রোদেলা নীলা অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে ছিলেন গুনে গুনে তিন মাস অর্থাৎ মাত্র নব্বই দিন, সেই অভিজ্ঞতাকে আশ্রয় করে যে বর্ননা তিনি দিয়েছেন তার নাম রেখেছেন – রানীর নগরে ৯০ দিন। জানরা ( genre) হিসেব এই রচনাকে ভ্রমণ সাহিত্যের (travel literature) অন্তর্ভুক্ত করা যায়। কারণ সমস্ত বর্ননা জুড়ে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার নানা জায়গা ভ্রমণের বিশ্বস্ত বিস্তারিত বিবরণ। তিনি অস্ট্রেলিয়ার যে জায়গাতেই পা রেখেছেন সেই স্থানের মানুষ – প্রকৃতি- আবহাওয়া-সংস্কৃতি-ধর্ম-অর্থনীতি-উন্নয়ন-লোকাচার, ইত্যাদি নানা বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করেছেন। তার এই রচনার পান্ডুলিপি পাঠের সময় আমি অনায়াসে আমার মানসচক্ষু দিয়ে সেই সব মনোরম স্থানকে কল্পনা করে নিতে পারি। মনে হতে থাকে লেখকের সাথে যেন শ্বশরীরে আমিও ভ্রমণ করছি।
রোদেলা নীলার এই রচনার আর একটি বৈশিষ্ঠ্য রয়েছে, রানীর নগরে ৯০ দিন কেবল একটি ভ্রমণ বিষয়ক অনবদ্য রচনা নয়, এই রচনার কথক স্বয়ং লেখক নিজে অর্থাৎ এই রচনা একটি ফার্স্ট পারসন ন্যারেটিভ (First person Narrative) । যে কথাটা এখন উল্লেখ করতে চাই, তা হলো ভ্রমণ সমগ্র রচনায় উপস্থাপিত ঘটনাগুলো ঘটেছে কয়েকজন ব্যক্তির / চরিত্রের জীবনে। সেই সমস্ত চলমান ঘটনার একটি সুনির্দিষ্ট প্রারম্ভ আছে এবং সুস্পষ্ট সমাপ্তি রয়েছে। এই সমস্ত ঘটনাকে আশ্রয় করে জীবন চলমান। আর লেখক, উপস্থাপিত সকল ঘটনার মাঝে মূল চরিত্র। এ যেন একটি সচলায়তনের উপন্যাস (novelette).
এই নোভেলের প্রধান চরিত্র স্বয়ং লেখক (Protagonist)। লেখকের আপন অভিজ্ঞতা এমন এক হৃদয় হরণ ভাষাশৈলীর মাধ্যমে পাঠক সমীপে লেখক উন্মোচন করেন তার গহীন ভালোবাসা, ঘৃণা, বিশ্বাস, অনাস্থা, সংকোচের বিহবলতা আর কাস্তেসহ দ্রোহ।এই সব নানান বর্ণের অনুভব ও ভাবনা অনন্য সাধারণ ভাষাশৈলীর উপস্থাপন।
রোদেলা নীলা একাধারে কবি – গল্প লেখক – প্রাবন্ধিক ও ভ্রমণ লেখক। রানীর নগরে ৯০ দিন তার চতূর্দশ গ্রন্থ, ইতোমধ্যে তার বেশ ক’টি গ্রন্থ পাঠক মহলের দৃষ্টি আকর্ষন করেছে। দেশের প্রধান দৈনিক সংবাদপত্রে – সাহিত্য পত্রিকা – ম্যাগাজিনে তার রচনা প্রকাশিত হয়েছে, শুধু তার ভ্রমণ অভিজ্ঞতাকেই আশ্রয় করে বেশ ক’টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন তিনি। তবে ইতোপূর্বে প্রকাশিত সব গুলো ভ্রমণ রচনার সাথে বর্তমান গ্রন্থের বড় রকমের পার্থক্য রয়েছে। এ রচনা একই সাথে ভ্রমণ রচনা (Travelogue) এবং সচলায়তনের উপন্যাস (Novelette)।
শুধু বাংলাদেশ নয়, সমস্ত পৃথিবীতেই নারী ভ্রমণ লেখকের সংখ্যা বিরল, ভ্রমণ সাহিত্যের কথা উঠলেই হিউএন সাঙ, ইবনে বতুতা, মার্কো পোলোর কথা মনে পড়ে। কোন দেশের কোন অঞ্চলের কোন নারী লেখকের কথা কেও উল্লেখ করেন না। রোদেলা নীলা আর দশজন আটপৌঢ়ে বাঙালি নারীর অবগুন্ঠনকে অমান্য করে ভ্রমণ করেন। ভ্রুমণ শেষে অর্জিত সকল সোনালী রূপালী তামাটে অভিজ্ঞতার কথা লিপিবন্ধ করেন আপন আনন্দে স্বতঃস্ফূর্ত চিত্তে।
আজ রোদেলা নীলার এই গ্রন্থ প্রকাশের শুভ ক্ষণে বিশ্ববিখ্যাত প্রথম বাঙালি পর্যটক শ্রীহাট্টের সন্তান রামনাথ বিশ্বাসকে স্মরণ করি বিনম্র শ্রদ্ধায়। রোদেলা নীলা’র লেখক স্বত্ত্বাকে জানাই উষ্ণ অভিনন্দন।
মহান একুশে বইমেলা ২০২৫ অধ্যাপক আহমেদ রেজা
ইংরেজী বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়