- নাবিলা বুশরা #
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল যে আন্দোলনের মাধ্যমে, তা ছিল ভাষা আন্দোলন। বাঙ্গালি চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল এই আন্দোলনের মধ্যেই। পলাশী বিপর্যয় থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ১৯০ বছরের পরাধীনতার আমলের সিংহভাগ ইংরেজি ছিল এ দেশের রাষ্ট্রভাষা। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন জোরদার হওয়ার সাথে সাথে ভাবী স্বাধীন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা কী হবে সে সম্পর্কে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।
ভারতবর্ষ স্বরাজ লাভ করলে স্বাধীন ভারতের সাধারণ ভাষা কী হবে এ নিয়ে প্রশ্ন করে মহাত্মা গান্ধী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে পত্র লিখলে জবাবে রবীন্দ্রনাথ লেখেন : ভারতের সাধারণ ভাষা তথা আন্তঃপ্রাদেশিক যোগাযোগের একমাত্র ভাষা হতে পারে হিন্দি মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি রক্তের বিনিময়ে বাঙ্গালিরা তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছিল সেদিন।
মাতৃভাষা নিয়েও যে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন হতে পারে, বুকের তাজা রক্ত বিসর্জণ দিয়ে বর্ণমালার স্বীকৃতি আদায় করা যেতে পারে তা বিশ্বের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছিল বাঙ্গালি জাতি। পাকিস্তানি শাসকদের বুলেটের সামনে অ আ ক খ-এর অপমৃত্যু হয়নি। রফিক, শফিক, সালাম, বরকতসহ অনেকের আত্মত্যাগে কেনা এই ভাষা। তার মর্যাদা রক্ষার্থে এদেশে প্রতিবছর পালিত হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা, যা বাঙ্গালির সাহিত্যিক পরিচয় বিকাশে অন্যতম পরিচায়ক।
অমর একুশে গ্রন্থমেলার ইতিহাস
বইমেলার উদ্ভবের ইতিহাস খুবই কৌতূহলোদ্দীপক একটি ঘটনা। বইমেলার চিন্তাটি প্রথমে মাথায় আসে প্রয়াত কথাসাহিত্যিক, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক সরদার জয়েনউদদীনের। তিনি বাংলা একাডেমিতেও একসময় চাকরি করেছেন। বাংলা একাডেমি থেকে ষাটের দশকের প্রথম দিকে তিনি গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক পদে নিয়োগ পান।
সরদার জয়েনউদদীন যখন বাংলা একাডেমিতে ছিলেন, তখন বাংলা একাডেমি প্রচুর বিদেশি বই সংগ্রহ করত। এর মধ্যে একটি বই ছিল ‘Wonderful World of Books’। এই বইটি পড়তে গিয়ে তিনি হঠাৎ দুটি শব্দ দেখে পুলকিত বোধ করেন। শব্দ দুটি হলো : ‘Book’ এবং ‘Fair’, কত কিছুর মেলা হয়। কিন্তু বইয়েরও যে মেলা হতে পারে এবং বইয়ের প্রচার-প্রসারের কাজে এই বইমেলা কতটা প্রয়োজনীয়, সেটি তিনি এই বই পড়েই বুঝতে পারেন।
বইটি পড়ার কিছু পরেই তিনি ইউনেসকোর শিশু-কিশোর গ্রন্থমালা উন্নয়নের একটি প্রকল্পে কাজ করছিলেন। কাজটি শেষ হওয়ার পর তিনি ভাবছিলেন বিষয়গুলো নিয়ে একটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করবেন। তখন তাঁর মাথায় আসে, আরে প্রদর্শনী কেন? এগুলো নিয়ে তো একটি শিশু গ্রন্থমেলাই করা যায়। যেমন ভাবা তেমনই কাজ।
সরদার একটি শিশু গ্রন্থমেলার ব্যবস্থাই করে ফেললেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির নিচতলায়, যা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রিয় গ্রন্থাগার হিসেবে পরিচিত। যত দূর জানা যায়, এটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম বইমেলা। এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে।
শিশু গ্রন্থমেলা করে সরদার জয়েনউদদীন পুরোপুরি তৃপ্ত হতে পারেননি। আরও বড় আয়োজনে গ্রন্থমেলা করার তিনি সুযোগ খুঁজতে থাকেন। সুযোগটি পেয়েও যান। ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জে একটি গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হয়।
এই মেলায় আলোচনা সভারও ব্যবস্থা ছিল। সে সব আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল হাই, শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও সরদার ফজলুল করিম। এই মেলায় সরদার জয়েনউদদীন একটি মজার কাণ্ড করেছিলেন। মেলায় যে রকম বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন, উৎসুক দর্শকেরাও এসেছিলেন প্রচুর, বইয়ের বেচাকেনাও মন্দ ছিল না কিন্তু তাদের জন্য ছিল একটি রঙ্গ-তামাশাময় ইঙ্গিতধর্মী বিষয়ও।
মেলার ভেতরে একটি গরু বেঁধে রেখে তার গায়ে লিখে রাখা হয়েছিল ‘আমি বই পড়ি না’। সরদার জয়েনউদদীন সাহেবের এই উদ্ভাবনা দর্শকদের ভালোভাবেই গ্রন্থমনস্ক করে তুলেছিল বলে জানান বাংলা একাডেমির একসময়কার মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান।
এখানেই সরদার জয়েনউদদীন থেমে থাকেননি। ১৯৭২ সালে তিনি যখন গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক, তখন ইউনেসকো ওই বছরকে ‘আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করে। গ্রন্থমেলায় আগ্রহী সরদার সাহেব এই আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষে ১৯৭২ সালে ডিসেম্বর মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। সেই থেকেই বাংলা একাডেমিতে বইমেলার সূচনা।
বইমেলার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব
প্রতিটি জাতির মেধা ও মননের আঁতুড়ঘর হলো তার বইয়ের জগৎ বা লাইব্রেরি। একই সাথে দেশের সকল মেধার সংগ্রহশালাও হচ্ছে এই লাইব্রেরি। সময়ের প্রয়োজনে এই সংগ্রহশালাকে মেলার মধ্য দিয়ে প্রদর্শন ও প্রচার করা হয়ে থাকে। এতে এই বিশাল জ্ঞানের ভান্ডার চলে আসে সকলের হাতের নাগালে। এর মাধ্যমে আবালবৃদ্ধবনিতা এই বিশাল জ্ঞান-সমুদের সাথে পরিচিত হওয়ার একটি বড় সুযোগ পায়।
জতিগতভাবে বাঙ্গালি আরাম ও প্রমোদপ্রিয়। জ্ঞানান্বেষনের উদ্দেশ্যে লাইব্রেরিতে গিয়ে বইপড়া ও বই সংগ্রহ করার ইচ্ছা ও সুযোগ অনেকেরই হয় না। মেলা উপলক্ষে প্রমোদ ও বইকেনা দু’টোই একসাথে হয়ে যায়। মেলায় যেসব দূর্লভ বই হাতের নাগালে পাওয়া যায় অন্য অনেক সময়েই তা খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে।
আরামপ্রিয় এই বাঙ্গালিকে বইমুখী করে তোলার জন্য কিছু কালজয়ী সাহিত্যিকদের সঙ্গে বইমেলার রয়েছে এক অনবদ্য অবদান। সব বয়সের মানুষের জন্য বইমেলায় থাকে উপযুক্ত বইয়ের পর্যাপ্ত সংগ্রহ। শিশুরা পরিচিত হতে পারে নতুন নতুন বইয়ের সাথে। বয়সীরাও খুঁজে পান তাদের মনের খোরাকসমৃদ্ধ বইটি।
বইমেলা বর্তমানে লেখক-লেখিকাগণের বই এর মোড়ক উন্মোচনের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সাহিত্যিকরা স্বতস্ফূর্তভাবে মেলায় অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের সাথে দেখা-সাক্ষাতে একজন পাঠক পান পাঠের নতুন প্রেরণা। লেখকের অটোগ্রাফসমেত বই কিনে পাঠক তার পাঠের ও বই কেনার চাহিদকে বহুগুণ বাড়িয়ে নিতে পারেন। এছাড়াও পাঠকের সারা বছরের পাঠাভ্যাসকে একটু ঝালিয়ে নিতে বইমেলার রয়েছে এক আশ্চর্য ভূমিকা। লেখক-পাঠকের এ মহা মিলন-মেলার উষ্ণতায় চঞ্চল হয়ে ওঠে নবপ্রেরণায় উদ্দীপ্ত একজন পাঠকের মন-প্রাণ।