লেখকঃ করীম রেজা
ঘুরতে যাবেন তাও আবার সোজা পাহাড়ে ওঠবেন। আমি সন্দেহ করি শেষতক স্বাস্থ্যগত ঝুকির জন্য না-ও যাবেন। আর পাহাড় ট্র্যাকিং করায় আনন্দ, উত্তেজনা, ভয় সব একত্রে মেশানো। আমাকে অবাক করে দিয়ে এটম ভাই টুকটাক কেনা-কাটা শুরু করলেন, যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকলেন। প্রবল কিন্তু চাপা উত্তেজনা ভরা ছোট্ট একটা ব্যাকপ্যাক কাঁধে জিল্লুরের সঙ্গে এটম ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম হাতছানির দেশে।
অভিযানের উদ্দেশ্য বগালেকে একরাত বিশ্রাম নিয়ে একসময়ের বিদিত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড় কেওক্রাডং যাওয়া। বগালেক গ্রামে বিকেলে পৌঁছার কথা থাকলেও পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা বেশ উতরে যায়। রাতের বাসে বান্দরবন পৌঁছাই সকালে। নাস্তার পর মিনিবাসে রুমার পথে পাহাড়ি চড়াই উৎড়াই।
পিচ-খোয়া ওঠে গেছে এখানে ওখানে। রাস্তার কার্পেটিংয়ের পুরুত্বও খুব সামান্যই। রাস্তা যে এখনও টিকে আছে, চলার উপযোগী আছে, তা বুঝি সাত জনমের ভাগ্যি আমাদের। হেলে-দুলে বান্দরবানের পাহাড়ি পথে চলার বাস্তব অভিজ্ঞতা এই প্রথম। ভালই লাগছিল। চারদিকের সবুজ, দিগন্ত খোলা আকাশ, নীচে জনবসতি মানে দু’একটি বাড়ি ঘর, একপাশে খাই অন্যপাশে গাড়ির সমান্তরাল পাহাড়ের আরও উপরে উঠে যাওয়া গা।
পাহাড়ের গায়ে ছোট-বড় গাছ, গুল্ম-লতা, কোথাও নানা রঙের, কিংবা একই গেরুয়া রঙের কিন্তু নানা ছাদের শুধু মাটির দেখা মেলে। ঘন্টা দু’তিন বোধ করি লেগেছিল রুমা বাজারে পৌঁছতে। নতুন পরিবেশের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে খুটিনাটি বিষয় মনেই ছিল না। হয়নি ছবি তোলাও। রাস্তার পাশের ঘরবাড়ির চেহারা সুরত কিংবা বাড়ির সামনে বা পাশে রোদে ছড়িয়ে দেয়া কাপড় চোপর দেখেই আলাদা ভাবে চিনতে পারা যায়, কোন বাড়ি আদিবাসী বা উপজাতিদের আর কোন বাড়ি সমতল থেকে পাহাড়বাসী হওয়া বাঙালিদের। বাঙালি বাড়ির পরিবেশের অপরিচ্ছন্নতা, অগোছালো ভাব সহজেই পাহাড়িদের পরিচ্ছন্ন-পরিপাটি পরিবেশের প্রতি মন টেনে নেয়।
বান্দরবান থেকে রুমার পথে থেমে থেমে হালকা বৃষ্টি ছিল, রুমা পৌঁছাবার আগেই সূর্যের দেখা মেলে। ভ্রমনের আয়োজকেরা বেশ অভিজ্ঞ, নিজেরাই কাগজপত্র নিয়ে দলের সবার নাম তালিকাভুক্ত করলেন। আমাদের শুধু স্বাক্ষর করতে হল। গাইড ছাড়া পাহাড়ে ট্র্যাকিং করতে যাবার নিয়ম নেই। নিয়ম নেই সামরিক কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত সেখানে ভ্রমণের।
ছোট্ট একটি টিলার ওপর সামরিক ক্যাম্পে নাম রেজিস্ট্রি করে রুমা বাজার থেকে চান্দের গাড়ি চড়ে বগালেক পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত যাবার বন্দোবস্ত। চিরাচরিত শর্ত গাড়ি যতদূর পর্যন্ত যায়, সিকি রাস্তা, আধা রাস্তা বা পৌণে কিন্তু ভাড়া গুনতে হবে পুরো রাস্তার। ভাগ্য বলে কথা। চান্দের গাড়ি নামের মাহাত্ম্য উদ্ধারের কোনও ফুরসত নেই। রাস্তার খাই-খাড়াই এমনই যে, কারও মতে এ যেন বিনে পয়সার রোলার কোস্টার।
জিপ বা চান্দের গাড়ি রাস্তার খাড়া দিকে যখন ওঠে তখন খোলা আকাশই থাকে এ জগতের একমাত্র দর্শনীয়। কখনও অসমান সমতল সামান্য রাস্তা এগিয়ে গিয়ে নিম্নমুখী হয়েছে অথবা আবার উঠে গেছে সেই উপরে। উপরটুকু উঠেই হয়তো আবার দেখা মিলবে গহীন খাদের, দুর্বল হৃদয়ধারীদের জন্য যা তেমন সুবিধেজনক নয়।
রাস্তা যখন নিচের দিকে নামতে থাকে মনে হয় এই বুঝি জিপ গাড়ি উল্টে যাবে। তবে দক্ষ স্থানীয় চালকেরা ঠিকই নিরাপদে বড় রকমের বিপদ-বিপত্তি না ঘটিয়েই যাত্রী নিয়ে গন্তব্যে যায়। ১৮ কিলোমিটারের অর্ধেক পথে চান্দের গাড়ি থেমে যায়। গাড়ি আর এগোবে না।
গাড়িতে বসে চালক বলেছিল, আমাদের ভগ্য ভাল যে, দুদিন বৃষ্টি ছিল না তাই গাড়ি চলছে। নতুবা হেঁটে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। আর এখন ৯ কিলোমিটার পথ হাঁটতে হবে। প্রখর রোদের তাপে আমরা হাঁটতে লাগলাম পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথে।
কোথাও কোথাও রাস্তার কাজ চলছে। এক্সকাভেটর দিয়ে রাস্তা সমান করা হচ্ছে। কখনও কখনও কিছু ইট দেখে অনুমান হয় আগে এই রাস্তা গাড়ি চলার উপযোগী করা হয়েছিল। সময়ের চাপে অযত্নে তা নিশ্চিহ্ণ। দু-দিন আগের বৃষ্টিতে এখানে সেখানে পানি জমে রাস্তার মাটি কাদা হয়ে আছে। গাড়ি রাস্তায় স্থায়ী চাকার দাগ ধরে তার ওপর দিয়ে চলে। নাহলে যে কোনো সময় তা ফেঁসে যেতে পারে। ফিরতি যাত্রায় আমাদেও তাই হয়েছিল। ছায়াহীন পাহাড়ি পথে উদ্ধারকারী গাড়ির জন্য ঘন্টা-দুয়েক বসে থাকতে হয়েছিল রোদের নিচে।
এখান থেকে পায়ে হেঁটে এগোতে হবে প্রায় ৯ কিলোমিটার পথ। অর্ধেক পথ গাড়িতে আসা গেল। ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করেই বুঝা গেল কত কঠিন এই পদব্রজে পাহাড়ের অভিযাত্রী হওয়া। আমরা দু-তিনজন ছাড়া দলের সবাই ততক্ষণে অনেকটা পথ এগিয়ে নীচে নেমে বিশ্রাম নিচ্ছে। বেড়াই বাংলাদেশ নামের অভিযাত্রী দলের ব্যবস্থাপকদের একজন সোহগ সাবলীলভাবে নেমে যাচ্ছে। একটি লাঠি না হলে পাহাড়ি পথে চলা খুব কঠিন এবং কখনও বিপদজনকও বটে।
সোহাগ বললেন তিনি নীচে গিয়ে চিকন বাঁশের লাঠি পাঠিয়ে দেবেন স্থানীয় গাইডের সহকারিকে দিয়ে। নীচে পৌঁছে কাঁধের সামান্য বোঝা গাইডের সহকারিকে বুঝিয়ে দিলাম। কেননা এই পাহাড়ি পথে ছোট একখানি ব্যাগ বহন করে হেঁটে যাওয়া খুব সহজ নয় আমাদের মত সমতলের অনভ্যস্ত বাসিন্দাদের পক্ষে। সবাই অনেকটা পথ ইতোমধ্যে এগিয়ে গেছে। আমরাও পা চালালাম নিসর্গের মধ্য দিয়ে।
পাহাড় কেটে গাড়ি চলার মত রাস্তা বানানো হয়েছে। কখনও দুই দিকে পাহাড়, কখনও একদিকে। চারদিকে সবুজের সমারোহ। প্রথমেই একটি ক্ষুদে নালার মত পাহাড়ি ছড়া পার হতে হল জুতোসুদ্ধ পা ভিজিয়ে। কিছুদূর যাওয়ার পর শুরু হল গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। সূর্য কখন অদৃশ্য। বড় বড় ফোটাও একসময় শুরু হল। আড়াল নেবার, থেমে দাঁড়াবার কোনও যুৎসই জায়গা নেই। বেশ কিছুদূর যাবার পর রাস্তার পাশে দুখানা ঘরের দেখা পেলাম। দোকান, বেচা কেনা হয়, চা বিস্কুটও আছে। পাহাড়ি কলার কাদি ঝুলছে। সিক্তদেহে বেঞ্চিতে বসে একটু জিরিয়ে নেয়া। কয়েকজন পাহাড়ি নারীও আছে। পথে এক পাহাড়ি যুবকের সঙ্গে বাক্যালাপ হয়েছিল, যে আমাদের অনেক আগেই এস্থানে পৌঁচেছে। আমরা কলা, বিস্কুট কিনে খেলাম। পূর্বের যুবককে জিজ্ঞেস করলাম, উপস্থিত পাহাড়ি রমনীরা আমাদের দেয়া কলা বিস্কুট খাবে কিনা?
তাদের সামনে, তাদেরকে না দিয়ে খেতে কেমন বাধো বাধো লাগছিল। যুবক এবং দোকানী মিলে মহিলাদের সঙ্গে স্থানীয় ভাষায় কথা বলে আমাদের জানালো আপত্তি নেই। সবাইকে এক প্যাকেট করে বিস্কুট দেয়া হল। আবার পথ চলা বৃষ্টি মাথায়। তোড় সামান্য কমলেও সম্পূর্ন বন্ধ হল না। জলের পিপাসা মেটানো এবং অভিজ্ঞতা বা মজা নেয়ার জন্য পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ছড়ার পানি আঁজলা ভরে নিয়ে পান করলাম। মেঘের জলে ভেজা পিচ্ছিল রাস্তা। কতবার যে আমরা পালা কওে পড়তে পড়তে বেঁচেছি, তার হিসেব রাখিনি।
জান বাঁচাবো নাকি হিসেব। কখনও পা টিপে টিপে চিকন বাঁশের লাঠির ওপর ভর দিয়ে ধরাশায়ী হতে হতে হইনি। অবলম্বন ছাড়া জীবনে চলা যে কত কঠিন, তা এবার পাহাড় আমাদের শিখিয়ে দিল। রাস্তায় মাঝেমধ্যেই ক্ষীণ জলধারার মুখোমুখি হলাম। বৃষ্টির পানি পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে নীচে। রাস্তা আড়াআড়ি পাড় হয়ে পাশের খাদে গড়িয়ে নামছে। কোথাও বেশ কিছু জায়গা পানিতে সয়লাব। পানিতে পা ডুবিয়ে হাঁটতে হয়।
কমলা বাজার পেরিয়ে বগালেক পাহাড়ের পাদদেশে হাজির হলাম। এবার পাহাড়ে চড়া-সরু পায়ে চলা পথে। বৃষ্টি ধরে এসেছে ততক্ষণে কিন্তু সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনায়মান। গাইডের সহকারিকে জিজ্ঞেস করি, আর কতদূর। সনাতন গ্রামবাংলার মানুষের মত জবাব, এইতো এই পাহাড়টুকু উঠলেই, সামনে আমাদের উদ্দিষ্ট গ্রাম। আশান্বিত হয়ে প্রবল উদ্যমে পা চালাই।
দুই পা পাশাপাশি ফেললে ডানে বায়ে আর পা ফেলার জায়গা থাকে না। দুইজন লোক পাশাপাশি হাটতে বা একে অন্যকে পাশ কাটাতে পারবে না, এমন সরু রাস্তা। যাহোক আমরা চলছি, আগে পিছে, দুজন কথা বলতে বলতে; আর পথের শেষ কোথায় জানতে একটু পেছনে থাকা সঙ্গের গাইডকে বার বার একই প্রশ্ন করছি। উত্তরও পাচ্ছি একই রকম, আগের মতই, এইতো আরেকটু।
পেছনে জিল্লুর, পাহাড়ে ওঠার আগে পানি খেতে গিয়ে পিছিয়ে পড়েছিল, সঙ্গে গাইড ছিল। উঠছি, নামছি, হাঁটছি, যেন পথের শেষ নেই। এক দেড় কিমি হাঁটার পর গাইড আমাদের অতিক্রম করে গেলেন। আর বেশি পথ বাকি নেই। মাঝে মাঝে জিল্লুরকে ডাকি উচ্চস্বরে, আছি বলে পেছন থেকে সে জানান দেয়। অন্ধকার তবে সবুজের মাঝে ধূসর এক চিলতে আলোর রেখা ধরে বাঁশের লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে চলছি। একসময় জিল্লুরের শব্দহীনতায় আমরা বেশ আতঙ্ক বোধ করি।
গাইড জানিয়ে গেল সে সাহায্য আনতে যাচ্ছে, জিল্লুর দুর্বল হয়ে পিছিয়ে পড়েছে, তবে চিন্তার কিছু নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে টর্চ নিয়ে ফিরে চলল আমদের ফেলে আসা পথে। উপরে গিয়ে জানলাম আরও একজন খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অবশেষে আমরা বগা লেক গ্রামের প্রান্তে গিয়ে পৌঁছলাম। সামান্য সমতল জায়গা। ভেজা শরীরে কেউ ঘাসের ওপর শরীর এলিয়ে দিয়েছে, অন্যরা কেউ বসে, দাঁড়িয়ে। অনতিদূরের সামরিক বাহিনীর ক্যাম্পের সামন্য আলো দেখা যায়। বুঝলাম এবার সত্যিই জায়গামত এসেছি। বগালেক আর বেশি দূরে নয়।
রুমা বাজারে নামধাম লিপিবদ্ধ করে রওনা দিয়েছিলাম। এখানের সেনাক্যাম্পে নামধাম লিখে কতজন এলাম তা নথিভুক্তির পর আমরা গ্রামের ভেতর প্রবেশ করি। অন্ধকারে গ্রাম, কিংবা রিসোর্ট বা উপজাতিদের ঘরবাড়ি কিছুই বুঝতেও পারিনি। তাছাড়া খুব বিস্তারিত কিছু জানারও আগাম চেষ্টা করিনি। শুধু এখানে ওখানে কয়েকটি বাড়ির সামনে বৈদ্যুতিক আলো জ্বলছে। আঁধার দূর না হলেও মোটামুটি ঠাহর করা যায়। পরে দেখলাম সৌর বিদ্যুতে ছোট আকারের টিউব লাইট থেকে এই আলো পাওয়া যায়।
আমাদের ৯ জনের জন্য বারান্দাসহ একটি মাচান ঘর বরাদ্দ দেয়া হল। স্থানীয়ভাবে এগুলো কটেজ নামে চিহ্ণিত। কেউ একজন পথ দেখিয়ে সেখানে নিয়ে গেল। বলা হল ভেজা কাপড় বদল করে,পরিচ্ছন্ন হয়ে অন্য আরেক ঘরের সামনে যেতে। যেখানে খোলা বারান্দার মত স্থানে খাবার টেবিল। বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠে ভেতরে উঁকি দিয়ে যা দেখলাম, তাতে কটেজের কি আছে বুঝতে না পেরে চারদিকে খুঁজতে লাগলাম।
বগালেক বা বগাকাইন গ্রামে সবমিলিয়ে ২৯ পরিবারের আবাস। তাদের একদুই প্রজন্মের আগের পরিবারের সদস্যরা পাহাড়ের অন্য পাশের গ্রাম সইকত বা সাইকত পাড়া থেকে এসে এখানে বসবাস শুরু করে। সবাই একই পরিবারের বংশধর। লেকের পাড়ে পাহাড়ের কোলে ছোট গ্রাম। সারি বাধা ঘর সামনের সমতল জায়গা উঠোনের মত রেখে তৈরি।
উঠানের শেষ মাথায় একটি গির্জা। সবাই খৃস্টের অনুসারী। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ধর্মান্তরনের শতবর্ষপূর্তি হয়ে গেল। আগে তারা পূর্বপুরুষের আদি ধর্মকর্মই করত। জাতি হিসেবে বম জনগোষ্ঠীর মানুষ তারা। সারিবদ্ধ ঘরের পেছনে আছে অসমতল জায়গায় অতিথিদের থাকার ঘর, তাদের ভাষায় কটেজ। বেড়া, মেঝে বাঁশের পাটাতন ঘর, টিনের চাল। রাতে সৌর আলোর ব্যবস্থা। পাহাড়ের সাদাসিধে কিন্তু কঠিন জীবন যাপন। অতিথিদের খাবার সাধারন মানের হলেও সতেজ,পুষ্টিকর। স্বল্প খরচে থাকা খাওয়া তাই নিরুদ্বেগভাবে কয়েকদিন স্বচ্ছন্দে প্রকৃতির মাঝে বসবাসের উপযুক্ত বটে।
ছেলেমেয়েরা সবাই শিক্ষিত। শিশুদের দল বেধে চলতে দেখলেও, তরুন যুবক-যুবতী গ্রামে চোখে পড়েনি। বোধ করি সবাই শহওে মিশনারিতে থেকে লেখাপড়া করে। নারীদেরই কাজ করতে দেখলাম। পুরুষদেও খুব কম দেখা গেল। ছেলে মেয়েরা পড়াশুনা শেষ করে গ্রামেই ফিরে আসে। কোনও এনজিওতে কাজ করলেও নিজেদেও এলাকাতেই নিয়োগ পেতে চেষ্টা করে।
রিচার্ড নামের উচ্চশিক্ষিত একজন এখন গ্রামেই কটেজ ব্যবসা শুরু করেছেন,তার বাবার বোন সিয়াম-এর মতই। সে আবার আদি বম জাতি পরিচয়ে গর্বিত বলেও আমাদেও জানাতে ভুল করেনি। সিয়ামই আসলে ব্যবসার প্রধান ব্যক্তি। বাকিরা তার সহযোগিতাতেই চালিয়ে নিচ্ছে। পর্যটকদের সুবাদে সবাই বেশ নগদও আয় করছে। বগালেকের তিনদিকে পাহাড়। পাহাড়ে বম, মুরং, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা এবং অন্যান্য আদিবাসীদের আবাস। বগালেক নিয়ে আছে কিংবদন্তি।
অনেকদিন আগে এখানে একটি চোঙা আকৃতির পাহাড় ছিল। আশপাশের গ্রামের গবাদি পশু এবং কমবয়সী ছেলেরা প্রায়ই ঐ পাহাড়ে হারিয়ে যেত। অতিষ্ঠ গ্রামের কয়েকজন সাহসী যুবক ঐ পাহাড়ে এক গুহায় ভয়ঙ্কর দর্শন একটি ড্রাগন (বম ভাষায় বগা অর্থ ড্রাগন) দেখতে পায় এবং হত্যাও করে। সঙ্গে সঙ্গেই গুহা থেকে আগুন বেরিয়ে এসে পার্শ্ববর্তী সব পুড়িয়ে দেয়, হঠাৎ ভূমিকম্পের ফলে এই লেকের সৃষ্টি হয়।
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় অবশ্য বলা হয়, তিন কারণে এই লেক তৈরি হয়ে থাকতে পারে। ভূমিধ্বস, উল্কাপিন্ড পতন কিংবা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ। কারন যাই হোক, এটি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২ হাজার ৭০০ ফুট ওপরে একটি আবদ্ধ মিঠাপানির জলাশয়। এই হ্রদের পানির উৎস সম্পর্কে এখনও সঠিক গবেষণা হয়নি।
বগালেকের প্রায় ১৫০ ফুট নিচে বগাছড়া নামে একটি পাহাড়ি জলধারা রয়েছে। এই ছড়া বগালেকের পানির উৎস কিনা এ বিষয়ে কারো সুচিন্তিত ধারণা পাওয়া যায় না। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে এই বগালেকের পানির রঙে বদল ঘটে বলে অনেকে অনুমান করেন হ্রদের তলদেশে একটি উষ্ণ প্রবাহ রয়েছে। সেখানে পানি প্রবাহের ফলেই উপরের লেকের পানির রঙ বদল ঘটে।
বিস্ময়কর হলেও সত্য হ্রদেও পানির আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে, জলজ আগাছা দেখা যায়, মাছও। গায়ে পানি ঢাললে বেশ কোমল এক ধরনের অনুভূতি জাগে। চারদিকে বড় বড় পাথর ইতস্তত ছড়ানো। ছোট ছোট তো আছেই, লেকের তলদেশে, পাড়েও আছে অনেক। গ্রামের মহিলা শিশুরা এখানে নিয়মিতই গোসল করে। সর্বপ্রথম গ্রামের এক কিশোরী হ্রদের পানিতে ডুবে মারা যায়। স্মৃতি হিসেবে তার কবর গ্রামেই, বম ভাষায় লেখা একটি পাথরের ফলক দিয়ে চিহ্ণিত করা আছে। বগালেক গ্রাম এবং তার চারদিকের সৌন্দর্য মানুষকে বার বার আকর্ষণ করবে তার প্রাকৃতিক বিত্ত-বেসাত উপভোগের হাতছানিতে।