লেখকঃ ফারুক হাসান – একজন পর্যটন পরামর্শক ও বিশেষজ্ঞ
জন গাড়ী চালিয়ে সংকীর্ণ এক জলধারার কাছে এসে থামলো।
আমি বল্লাম, “নদী দেখতে যাবে না?”
ও বল্লো, “এই তো নদী।”
আমি বল্লাম, “কোথায় নদী?”
ও সংকীর্ণ জলধারাটি দেখিয়ে বল্লো, “এই তো নদী।”
আমি মনে মনে ভাবলাম ও যদি আমাদের মেঘনা, পদ্মা, আগুনমুখা, পায়রার মত নদীগুলো দেখতো
তা’হলে এ নদী আমাকে দেখাতে নিয়ে আসতো না! বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা, যমুনার মত বিশাল বক্ষা নদীগুলো নিয়ে গড়ে উঠতে পারে ব্যাপক আকারে পর্যটন কর্মকান্ড। দেশের নদীগুলোকে ঘিরে এখন পর্যটন যে একেবারেই হয় না, তা কিন্তু নয়; তবে তার ব্যাপ্তি একেবারেই কম। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন অনেক বছর ধরেই নদীতে ভাসমান রেস্তোঁরা চালাচ্ছে। এ দেশের একটি ট্যুর অপারেটিং কোম্পানী তাদের সুদৃশ্য একটি বড়সড় দেশীয় নৌকা দিয়ে এ দেশে প্রবাশী বিদেশীদের নিয়ে প্রায়শই নদী ভ্রমনের ব্যবস্থা করে থাকে। আরেকটি ট্যুর অপারেটিং কোম্পানী বিদেশী পর্যটকদের নিয়ে দেশীয় নৌকা করে রংপুরে যমুনার চর থেকে যাত্রা শুরু করে পদ্মা, মেঘনা হয়ে বরিশালে চলে আসে। বিদেশী পর্যটকদের জন্য এ এক অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম।
ছুটির দিনগুলোতে দেখা যায় দেশীয় ভ্রমন পিপাসুরা নৌকায় সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে, মাইক বাজিয়ে নদীতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এভাবে মাইক বাজানো যে শব্দ দুষণের সৃষ্টি করে তেমনটা তারা বুজে উঠতে পারেন না। মংলাতে দেখা যায় ডজন ডজন ছোট-বড় ট্যুরিস্ট বোট নদীতে অপেক্ষা করে আছে পর্যটকদের সুন্দরবনের কাছে বা অনেক ভিতরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এওতো নদী নিয়ে পর্যটন। মিশরের নীল নদে ‘রিভার ক্রুজ’-কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিশাল পর্যটন কর্মকান্ড। প্রতিদিন শত শত বিদেশী পর্যটক নীল নদে বিলাসবহুল জাহাজে করে নৌ-ভ্রমণ করে থাকে যার মাধ্যমে দেশটি বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মূদ্রা আয় করে। বাংলাদেশে রিভার এ্যান্ড গ্রীন ট্যুর নামের একটি ট্যুর কোম্পানি ঢাকার পাশের নদীতে ‘ঢাকা ডিনার ক্রুজ’নামে ‘রিভার ক্রুজ’শুরু করেছে বছর দু’য়েক হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মেকং নদী থাইল্যান্ড, ভিয়েৎনাম, ক্যাম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার, চীনের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে। দেশগুলোর পারস্পারিক সহযোগিতায় এ নদীতে ‘রিভার ক্রুজ’ হয়ে থাকে দেশগুলোর দর্শনীয় স্থানগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে। হাজার হাজার বিদেশী পর্যটক এ ক্রুজের মাধ্যমে দেশগুলো ভ্রমণ করে থাকে।
বৃটিশ আমলে আসামের গুহাহাটি থেকে বাংলাদেশের (তদানীন্তন পূর্ববঙ্গের) গোয়ালন্দ, বরিশাল, খুলনা, পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতা হয়ে উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদ পর্যন্ত নিয়মিত যাত্রীবাহী স্টিমার চলতো। ১৯৪৭-এ উপমহাদেশ বিভাগের পর (অথবা ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর?) এ পথে স্টিমার চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তবে নারায়নগঞ্জ/ঢাকা থেকে বরিশাল হয়ে খুলনা পর্যন্ত চলতে থাকে স্টিমারগুলো। উনিশ শতকের দ্বিতীয় শতকের শেষ দিকে কোলকাতা ডকইয়ার্ডে নির্মিত এই প্যাডেল স্টিমারগুলো বিদেশী পর্যটকদেরও আকর্ষণ করে থাকে। একে তো প্যাডেল স্টিমার তার পর নদীগুলোর সৌন্দর্য্য, নদীর দু’পারের দৃশ্য আর মানুষের কর্মকান্ড পর্যটকদের বিমোহিত করে। পরে অবশ্য স্টিমারগুলো আর প্যাডেল চালিত থাকে নি, শুধু অবয়বটাই থেকে গেছে প্যাডেল স্টিমারের মত। বরিশাল থেকে মংলা পর্যন্ত (যদি ঘষিকালিতে নদীটা নাব্য থাকে) নদী আর নদীর দু’পারের অপরূপ দৃশ্য কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে বাঙ্গালী আর মধুমতি নামের যে দু’টি স্টিমার বানিয়ে এ পথে চালানো হচ্ছে এগুলো দেখতে বড় লঞ্চের মত, প্যাডেল স্টিমারের চেহারা আর রাখা হয়নি; রাখলে ভালো হতো – ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা থাকতো, বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণ করতো।
বাংলাদেশে কয়লা চালিত রেল ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সবগুলোকে স্ক্র্যাপ করে ফেলা হয়েছে – ঐতিহ্য আর অতিতের স্মৃতি হিসেবে কয়েকটিকে সংরক্ষণ করা যেতো। প্যাডেল স্টিমারগুলোর যে কয়েকটি এখনো টিকে আছে সেগুলোকে যেন এক সময়ে স্ক্র্যাপ করে ফেলা না হয়। কয়েক বছরের মধ্যে এগুলোর শত বর্ষ পূর্ণ হবে আর তখন ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে স্টিমারগুলো। বিশ্ব ঐতিহ্য হলে এগুলো বিদেশী পর্যটক আরো বেশী করে আকর্ষণ করবে। যতটুকু সম্ভব দীর্ঘসূত্রিতা করে শেষ পর্যন্ত এ বছর ঢাকা-কোলকাতা রিভার ক্রুজ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে বিআইডব্লিউটিএ জাহাজ পরিচালনা করবে। একটি সরকারী/আধাসরকারী সংস্থা পর্যটন জাহাজ পরিচালনা করলে তা কতটুকু লাভজনক হবে ভেবে দেখা প্রয়োজন। পর্যটকরা যাত্রাকালিন সর্বোচ্চ সেবা প্রত্যাশা করে থাকে। সরকারী/আধাসরকারী কর্মকর্তা/কর্মচারীগণ সে প্রত্যাশা পুরন করতে পারবেন কি? দ্বিদেশীয় রিভার ক্রুজটি বাণিজ্যিকভাবে সফল করে তোলার জন্য প্রয়োজন সর্বোচ্চ মার্কেটিংয়ের। বিআইডব্লিউটিএ কতটুকু প্রস্তুত সে জন্য? এই ক্রুজের জন্য বাংলাদেশে বসবাস রত এক/দের লক্ষ বিদেশীকে মূলত আকর্ষণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক ট্যুরিজম মার্কেটেও প্রচারনা চালাতে হবে। তবেই দেশের লাভ হবে।
কেবল নৌ ভ্রমণই নয় নদীকে নিয়ে বাংলাদেশে গড়ে উঠতে পারে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম। যেমন মেঘনার মোহনায় বা মেঘনা-পদ্মার সঙ্গমস্থলে জেলেদের সঙ্গী হয়ে ইলিশ ধরা অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় পর্যটকদের কাছে একটি বড় আকর্ষণ হয়ে উঠতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে বাঁশ কেটে ভেলা বানিয়ে সারি সারি ভেলা কর্ণফুলী নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয় কর্ণফুলী কাগজ কলে নিয়ে আসার জন্য। ভেলাগুলোর গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লেগে যায় বেশ কয়েক দিন। এ ভেলায় করে নদী ভ্রমণ পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হতে পারে। ইন্দোনেশিয়ায় বাঁশের ভেলার পর্যটন গড়ে উঠেছে অনেক আগেই। বিদেশী পর্যটকরা দারুন উপভোগ করে এমন ভেলায় ঘুরে বেড়াতে।
বাংলাদেশে নদী নিয়ে পর্যটনের সাফল্য নির্ভর করবে আমাদের উদ্যোগের উপর এবং আমরা বিশ্ব বাজারে কতটুকু সাফল্যের সঙ্গে এর বিপণন করতে পারবো তার উপর।