পর্যটন বিচিত্রা ডেস্ক
বাবরের সংগঠন ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের পক্ষ থেকে রোববার সকাল ৮টা ৫৬ মিনিটে এক ফেসবুক পোস্টে বলা হয়েছে, ‘সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এবং লাখো শুভাকাঙ্ক্ষীর দোয়ায় প্রকৃতিমাতা (এভারেস্ট) বাবরকে ক্ষণিকের জন্য স্থান দিয়েছেন নিজের চূড়ায়। খানিক আগে বেজক্যাম্প ম্যানেজার এবং আউটফিট মালিক আমাদের এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এখন বাবর আছে ক্যাম্প-৪-এ নামার পথে। ওই ডেথ জোনে যোগাযোগ সম্ভব নয়। তাই অভিযানের ছবি পেতে সময় লাগবে।’
বাংলাদেশ থেকে বাবর আলী নেপালের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন ১ এপ্রিল। প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করে ৪ এপ্রিল কাঠমান্ডু থেকে উড়ে যান লুকলা বিমানবন্দরে। এরপর পথচলা শুরু করেন এভারেস্ট বেজক্যাম্পের উদ্দেশে। সেখানে পৌঁছান ১০ এপ্রিল।
মো. বাবর আলীর বয়স ৩৩ বছর। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ৫১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। চমেক থেকে এমবিবিএস পাশ করে নিজেকে চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত করেন। এই তরুণ চিকিৎসক নানা স্বেচ্ছাসেবী কাজে জড়িত।
এর আগে ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে পাঁচজন বাংলাদেশি এভারেস্ট জয় করেন। তারা হলেন-মুসা ইব্রাহিম, এমএ মুহিত (দুবার), নিশাত মজুমদার, ওয়াসফিয়া নাজরীন ও মো. খালেদ হোসাইন। ১১ বছর প্রতীক্ষার পর বাংলাদেশের কেউ আবার এভারেস্ট জয় করল।
চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বুড়িশ্চর এলাকার লেয়াকত আলী ও লুৎফুন্নাহার বেগমের দ্বিতীয় সন্তান বাবর ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৫১তম ব্যাচের ছাত্র। কিছুদিন জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসাবে কাজ করলেও আগের অভিযানের সময় ছুটি না মেলায় চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। এর আগে প্রথম বাংলাদেশি হিসাবে হিমালয়ের আমা দাবালাম চূড়া জয় করেছেন বাবর।
বাবর ১৬ এপ্রিল সামিট করেন ২০০৭৫ ফুট উচ্চতার লবুচে ইস্ট পর্বত। এরপর আবারও বেসক্যাম্পে ফিরে পর্বতের নিচ অংশের পথ খুলে গেলে ২৬ এপ্রিল বেসক্যাম্প থেকে যাত্রা শুরু করে ক্যাম্প-২ পর্যন্ত ঘুরে এসে শেষ করেন উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পর্ব। এরপরই ১৪ মে মাঝরাতে বেসক্যাম্প থেকে শুরু হয় বাবরের স্বপ্নের পথে যাত্রা। তিনি প্রথম দিনেই সরাসরি উঠে আসেন ক্যাম্প-২-এ, যার উচ্চতা ২১ হাজার ৩০০ ফুট। পরিকল্পনা অনুসারে সেখানে দুই রাত কাটিয়ে বাবর ১৭ মে উঠে আসেন ২৪ হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতার ক্যাম্প-৩ এবং ১৮ মে আসেন ক্যাম্প-৪-এ।
২৬ হাজার ফুট উচ্চতার এই ক্যাম্পের উপরের অংশকে বলা হয় ডেথ জোন। অবশেষে ১৮ মে মাঝরাতে আবারও শুরু হয় বাবরের যাত্রা, ও ভোরের প্রথম কিরণে ২৯ হজার ৩১ ফুট উচ্চতার মাউন্ট এভারেস্ট শীর্ষে উড়িয়ে দেন বাংলাদেশের পতাকা। তবে বাবরের অভিযান এখনো শেষ হয়নি। শুধু এভারেস্ট নয়, সঙ্গে লাগোয়া পৃথিবীর চতুর্থ শীর্ষ পর্বত লোৎসেও বাবর জয় করতে চান। বাবরের নতুন অভিযান রোববারই শুরু হবে, এদিন তিনি ক্যাম্প-৪-এ নেমে মাঝরাতে আবারও শুরু করবেন দ্বিতীয় লক্ষ্যের পথে যাত্রা এবং সব অনুকূলে থাকলে সোমবার ভোরে পৌঁছে যাবেন পর্বত লোৎসের চূড়ায়। লোৎসে জয় করতে পারলে একসঙ্গে দুই পর্বতশৃঙ্গ জয়ে প্রথম বাংলাদেশি হবেন বাবর আলী। লোৎসের উচ্চতা ২৭ হাজার ৯৪০ ফুট। এই অভিযানে বাবরের সঙ্গে ছিলেন তার দীর্ঘদিনের বন্ধু ও পর্বতারোহণ গাইড বীর বাহাদুর তামাং।
ডা. মো. বাবর আলীর মা লুৎফুন্নাহার বেগম বলেন, ছোটবেলা থেকে পাহাড়-পর্বত জয়ের নেশায় সে বিভোর ছিল। তার এ অর্জনে আমি অনেক খুশি। বাবর আলীর বাবা লেয়াকত আলী বলেন, খুব ভালো লাগছে। সকাল থেকে বাসায় অনেক টিভি চ্যানেলসহ গণমাধ্যমকর্মীরা ভিড় করেছে। সবাই নানা ধরনের প্রশ্ন করছে। আত্মীয়স্বজনসহ অনেকেই ফোন করছে। এই যে অবস্থা, এটা আমার কাছে প্রথম ও শেষ বিজয় বলে মনে হচ্ছে।
পর্বতারোহণ কত খরচ হলো
বাবর আলীর শুধুমাত্র পর্বতারোহণ অভিযানে মোট খরচ হয়েছে প্রায় ৪৫ লাখ টাকার মতো। যার একটি বড় পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে ক্রাউডফান্ডিং এর মাধ্যমে। ক্রাউডফান্ডিং হল কোন একটি কাজের ব্যয় নির্বাহের জন্য বা তহবিল গঠনের জন্য অর্থ সংগ্রহের একটি উপায়।
অনেকেই অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বা বিভিন্ন ইভেন্ট আয়োজনের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে থাকে।
অভিযানের প্রধান সমন্বয়ক এবং বাবর আলীর বিভিন্ন পর্বতারোহণের সঙ্গী ফারহান জামান জানান, বাংলাদেশে বাবর আলীই প্রথম যিনি ক্রাউডফান্ডিং-এর মাধ্যমে এভারেস্ট জয় করেছেন। তারা মূলত তিনটি উপায়ে এই ক্রাউডফান্ডিং করেছেন বলে জানান। প্রথমত তারা অনলাইনে একটি ইভেন্ট খোলার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করেন।
জামান বলেন, আমরা প্রথমে আমাদের পর্বতারোহণের গ্রুপ ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সে একটা ইভেন্ট খুলে ডিক্লারেশন ছাড়ি যে বাবর আলী এভারেস্টে উঠবেন। এজন্য ফান্ড দরকার। আমরা বাবরের একটা শর্ট ফিল্ম বানিয়ে ইভেন্টটা তৈরি করেছিলাম।
দ্বিতীয়ত তারা যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ক্রাউডফান্ডিং প্ল্যাটফর্ম ‘গোফান্ডমি’-রও সাহায্য নিয়েছেন।
জামান জানান তাদেরই পরিচিত একজন গোফান্ডমি প্রচারণায় বাবর আলীর অভিযানে সহায়তা দিতে একটি লিংক তৈরি করেন। এতে করে দেশের বাইরে থাকা অনেক বাংলাদেশি ওই লিংকের মাধ্যমে তহবিল দেন।
তৃতীয়ত তারা মেডেল বিক্রি করে ফান্ড সংগ্রহ করেন। বিভিন্ন রানিং ইভেন্ট বা দৌড় প্রতিযোগিতায় আয়োজকদের কাছে অনেক মেডেল থাকে। যেগুলো ইভেন্টের পর আর ব্যবহার হয় না।
তারা এসব ইভেন্ট আয়োজকদের সাথে যোগাযোগ করে মেডেলগুলো সংগ্রহ করেন এবং অনলাইনে বিক্রি করেন। সেই সাথে দেশ বিদেশের নানা সামাজিক ও ক্রীড়া সংগঠনও তাদের সহায়তা দিয়েছে। তাছাড়া বাবর আলীর নিজের জমানো এবং কিছু ধারদেনা করা টাকাও খরচ করা হয়।
তিনি বলেন, অনেক টাকা বন্ধুবান্ধবদের থেকে ব্যক্তিগতভাবে ধার করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে বাবরই প্রথম ক্রাউডফান্ডিং এর মাধ্যমে এভারেস্ট জয় করেছে। আগে সব কর্পোরেট স্পন্সর ছিল।
তবে বাবর আলীর এই অভিযানেও সবচেয়ে বড় পরিমাণে অর্থায়ন এসেছে সাতটি কোম্পানির স্পন্সরশিপ থেকে। যদিও এর মধ্যে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান একটিও নেই।
মূলত যেসব প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা নিজে পর্বতারোহণ করেন বা পর্বতারোহণের বিষয়ে আগ্রহ রাখেন তারাই এগিয়ে এসেছেন বলে জানান জামান।
তিনি বলেন, আমরা এমন কোনও বড় কোম্পানি নেই যাদেরকে নক করিনি। মালিক থেকে পিওন পর্যন্ত সব জায়গায় চেষ্টা করে দেখেছি। কিন্তু কোনও সাড়া পাইনি। তারা ভাবে যে ঘুরতে যাচ্ছে। তা ছাড়া নির্বাচনের পর পরই বড় কোম্পানিগুলোর পক্ষে ফান্ড দেয়াটা হয়তো কঠিন।
এভারেস্ট আরোহণ আসলেই বেশ ব্যয়বহুল। এ অভিযানের জন্য একজন ব্যক্তির ন্যূনতম ২৫ লাখ টাকা থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অংকের খরচটি হয় নেপাল সরকারের রয়্যালটি ফি বাবদ। জামান জানান, এভারেস্টে উঠতে জনপ্রতি ১২ হাজার ডলার রয়্যালটি ফি নেপাল সরকারকে দিতে হয়।
এই টাকার বিনিময়ে ক্লাইম্বিং পারমিট অর্থাৎ পর্বত আরোহণের অনুমোদন পাওয়া যায়। এর বাইরে বাড়তি কোন সেবা পাওয়া যায় না। নেপাল সরকার শুধুমাত্র পর্বতারোহীর নাম আনুষ্ঠানিকভাবে নথিভুক্ত রাখেন। চূড়ায় আরোহণ করতে পারলে তারা সেটা ঘোষণা করেন। সেইসাথে বোতলজাত অক্সিজেন এবং হাই অল্টিটিউড গিয়ারের জন্য একটি বড় অংক বিনিয়োগ করতে হয়।
সেইসাথে তাঁবু, স্লিপিং ব্যাগ, জ্যাকেট, বুট, থাকা খাওয়া, শেরপার ফি- সব মিলিয়ে অনেক বড় অংকের টাকা খরচ হয়ে যায়।
তবে এভারেস্ট আরোহণের সামগ্রিক আয়োজন এবং লেনদেনের সব কাজ মূলত এজেন্সিরাই করে থাকে। এরা অনেকটা ট্রাভেল এজেন্সির মতো।
জামান জানান, এজেন্সিগুলো নেপাল সরকারের অনুমোদন নেওয়া থেকে শুরু করে পর্বতে উঠে নেমে আসা পর্যন্ত সব ধরনের সেবা দিয়ে থাকে। এজন্য তাদেরকে এককালীন সব মূল্য পরিশোধ করে দিতে হয়। আপনি শুধু বাংলাদেশ থেকে কাঠমুন্ডু যাবেন, তারপর আপনাকে হোটেলে নেওয়া থেকে শুরু করে বাংলাদেশে ফেরার আগ পর্যন্ত পর্বতারোহণের বাকি সব প্রক্রিয়া এজেন্সি সম্পন্ন করে থাকে। এভারেস্ট অভিযাত্রায় নেপালে বিভিন্ন ধরনের এজেন্সি কাজ করে যাদের একেক জনের খরচ একেক রকম। আমরা সবচেয়ে কম দামি এজেন্সি ধরে গিয়েছি। ভালো এজেন্সিগুলোর ফি আরও ১৫/২০ লাখ টাকা বেশি। ওখানে ফেসিলিটিজও বেশি।
তিনি আরও জানান, দামিগুলোয় গেলে বাবরের শিখরে ওঠার ছবি ও ভিডিও খুব দ্রুত পেয়ে যেতাম। তার সাথে দুজন শেরপা থাকতো। বেজ ক্যাম্পে খাট পেতো। আমরা গিয়েছি ধারদেনা করে। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আমাদের সস্তা অপশন বেছে নিতে হয়েছে। সব মিলিয়ে এভারেস্ট অভিযাত্রা বাবদ বাবর আলীর যে ঋণ রয়েছে তা পরিশোধে এগিয়ে আসতে ইতোমধ্যেই আবার ক্রাউডফান্ডিং শুরু করতে হয়েছে।