আমার দেখা আমেরিকার অনেক শহর বা নগরের মধ্যে তিনটি শহরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য আমার নজরে এসেছে। যেমন আমার অভিজ্ঞতায় ‘লাস ভেগাস’কে মনে হয়েছে জুয়ারীদের শহর, ‘হলিউড’কে পাগলের শহর (এত পাগল আমি আর কোথাও দেখি নি), আর ‘মিয়ামী বীচ’কে ন্যাংটা বা অর্ধ-ন্যাংটা মেয়েদের লীলাভূমি। তার মানে আপনি যদি জুয়ারী দেখতে চান যাবেন লাস ভেগাসে, পাগল দেখতে হলে হলিউডে আর ন্যাংটা বা অর্ধ-ন্যাংটা মেয়ে দেখতে মিয়ামী বীচে।
প্রশাসনিক বিভাজনে ‘মিয়ামী’ ও ‘মিয়ামী বীচ’ দু’টি সম্পূর্ণ আলাদা শহর। মিয়ামী হচ্ছে মূল ভূখন্ডে (Main Land) এ অবস্থিত বিশাল কসমোপলিটান নগর। আর আটিলান্টিকের বুকে মূল ভূখন্ডের কাছে কয়েকটি ছোট ছোট দ্বীপকে নিয়ে মিয়ামী বীচ শহর, মূল ভূখন্ডের সাথে সেতু দ্বারা সংযুক্ত। বিসকেইন উপসাগরে অবস্থিত মিয়ামী বীচ প্রধানত ট্যুরিস্ট সমাগম এলাকা, মূলত অগণিত ট্যুরিস্ট হোটেল ও অবসর কাটানোর এপার্টমেন্ট (Holiday or Retired Apartments) নিয়ে গঠিত। দ্বীপগুলির উত্তর ও দক্ষিণে বড় বড় বীচ, উষ্ণ ট্রপিক্যাল আবহাওয়ার কারণে সারা বছর পর্যটক সমাগমে মুখর। এছাড়া মিয়ামী বীচেই রয়েছে ‘পোর্ট অব মায়ামী’, যা পৃথিবীর ‘ক্রুইজ রাজধানী’ হিসাবে খ্যাত।
২০০০ সালে আমেরিকা ভ্রমণে এসে তখন আমি ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের সর্ব-দক্ষিণে ফোর্ট লডারডেলে অবস্থান করছিলাম। মিয়ামী প্রবাসী আমার এক অধ্যাপক বন্ধু খবর পেয়ে সেপ্টেম্বরের এক বিকেলে আমাকে মিয়ামীতে নিয়ে যাবার জন্য আসেন। ফ্রি ওয়ে ধরে গাড়ি চালিয়ে ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে ফোর্ট লডারডেল থেকে মিয়ামীতে বন্ধুর বাসায় পৌঁছে যাই। তখন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা। তাদের বিয়ের আগের থেকে আমার সাথে মহিলার পরিচয় ছিল, খানিকটা বন্ধুত্বও ছিল। অনেকদিন পর পুরানো বন্ধু ও বান্ধবীর সাথে মিলিত হয়ে আমরা সবাই খুবই আনন্দিত হই।
সকালে ব্রেকফাস্টের পর বন্ধুবর তাঁর কলেজে চলে গেলে আমার প্রাক্তন বান্ধবী আমাকে নিয়ে বের হন। একটি ট্যাক্সিতে করে আমরা সাউথ বীচে আসি। আটলান্টিকের পারে এই সেই আমেরিকার বিখ্যাত মিয়ামী বীচ, যার কত গালগপ্প শুনেছি। কিন্তু প্রথম দর্শনে খুব হতাশ হলাম। স্বদেশে বিদেশে ভারত মহাসাগর (বঙ্গোপসাগরসহ), প্যাসিফিক ও আটলান্টিকের পারে বহু বীচ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। তার মধ্যে যে কয়টি নিকৃষ্টতর বীচ দেখেছি, এটি তার অন্যতম। আমাদের কক্সবাজার, ইউনানী ও কুয়াকাটার সাথে কোন তূলনাই হয় না। যাহোক মাঝবয়সী বন্ধুপত্নীর সাথে বীচে হাঁটা শুরু করি। একসময় সে আমার একটি হাত ধরে, গায়ে গা লাগিয়ে হাঁটে। তার হাতের স্পর্শের অনুরণন আমার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। আমি তার হাতটি টেনে নিয়ে আলতো করে চুমো খাই। বান্ধবী মিষ্টি করে হাসে। ইচ্ছে হচ্ছিল ঐ পরিবেশে ‘আই সুড গিভ হার এ প্রপার কিস্’। কিন্তু সাহস হলো না। বীচে আমরাই শুধু হেঁটে বেড়াচ্ছি, অন্যরা জোড়ায় জোড়ায় বা দলে দলে সমুদ্রে স্নান করছে বা বালির চরে রৌদ্রস্নান করছে। তাদের গায়ে স্বল্পবাস স্নানের পোশাক, মেয়েরা বিকিনি পড়া, ছেলেরা জাঙ্গিয়া বা বক্সার পরা। অল্প এগোতে দেখি, কয়েকটি মেয়ে টপলেস হয়ে বালুকা তটে চাদর বিছিয়ে রৌদ্রস্নান করছে। গোপন অঙ্গটি সামান্য ফিতার মতো কিছু দিয়ে ঢাকা। পাশ থেকে দেখলে মনে হয় কিছুই নেই। হাঁটতে হাঁটতে দেখি এরকম আরো অনেক। এক জায়গায় আমাদের সামনেই তিন/চারটি মেয়ে টপলেস হয়ে জল থেকে উঠে আসছে। কাছ থেকে তাদের উদ্ধত স্তনাগ্র চূড়া থেকে জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে, যেমন শীতের ভোরে কচুর পাতা থেকে শিশিরবিন্দু গড়িয়ে পড়ে। আমি দাঁড়িয়ে ঘাবার মতো
তাকিয়ে দেখতে থাকি মেয়েগুলির নিরাভরণ দেহবল্লরীর আঁকবাঁক ও খাঁচখোঁচ। বন্ধুপত্নীর বল্লেন- আরে অমন অসভ্যের মতো তাকিয়ে আছেন কেন ? বল্লাম- আমি অসভ্য মানুষটা এ সব সভ্য নারীদের অনাবৃত দেহের অপূর্ব সৌষ্টব দেখার লোভ সামলাতে পারছি না। তাদের অঙ্গ নড়াচড়ার সময় উম্মুক্ত উদ্ধত স্তন-যুগলের আন্দোলন আর নিতম্বের হিল্লোলকে মনে হচ্ছিল, যেন এক একটি চলমান ছন্দোময় কবিতা। বন্ধুপত্নীকে ঠাট্টা করে বল্লাম- ‘চলুন আমরাও কাপড় খুলে নেমে পড়ি’। উত্তরে বল্লেন- “আপনার সাথে সমুদ্রে নাইতে নামার এই প্রস্তাবের চেয়ে, এই মুহুর্তে আমার কাছে আনন্দময় আর কিছু নেই। আপনার বন্ধু বড় বেরসিক মানুষ, এসবে কোন উৎসাহ নেই।” আমি সাগরজলে নামার জন্য তৈরী হয়ে আসি নি। আর এদিকে বন্ধুপত্নীর সত্যি সত্যি তার পরনের জামা-প্যান্ট খুলতে শুরু করেন। আমি অনেক কষ্টে তাঁকে নিবৃত্ত করি। আমি আপত্তি না করলে তিনিও টপলেস হতেন কিনা জানি না। যাহোক আমি তাঁর সুডৌল উরুদ্বয় ও স্তনযুগলকে সুর্যালোকে উম্মোচিত হতে দিই না।
লাঞ্চের আগে আমরা বাসায় ফিরে যাই।
লাঞ্চের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে বিকালে আমি একা বের হয়ে মেইন ল্যান্ডের জাহাজ বা লঞ্চ ঘাটে আসি। মিয়ামীর একমাত্র আকর্ষণ কিন্তু সমুদ্রজলে বা রৌদ্রে স্নানরত নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নারীদের অনাবৃত দেহবল্লরী দর্শন নয়। এখানে আছে দেখার আরো অনেক মনোমুগ্ধকর দ্রষ্টব্য ও উপভোগের নানা আয়োজন। তার মধ্যে একটি অন্যতম বিশেষ আকর্ষণ বিসকেইন উপসাগরে ‘ক্রুইজ ভ্রমণ’। ক্রুইজ ভ্রমণে দ্রষ্টব্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- মিয়ামী ডাউন টাউনের দর্শনীয় আকাশচুম্বি স্কাইলাইন, মিয়ামী বন্দর, ফিশার দ্বীপ, মিয়ামী সৈকত ও আমেরিকার মিলিওনীয়ারদের ঘরবাড়ি। ডাউন টাউনের লঞ্চঘাটেই বিসকেইন উপসাগরে ‘ক্রুইজ ভ্রমণ’ পরিচালনাকারী বেশ কয়েকটি সংস্থার অফিস আছে। আমি একটি সংস্থা থেকে দেড় ঘন্টার প্রমোদভ্রমণের টিকেট কাটি। আমাদের জন্য নির্দিষ্ট ক্রুইজ শিপ বা লঞ্চটির নাম ‘আইল্যান্ড লেডি’। জেটি থেকে পাঁচটায় প্রমোদ-তরীটি ছাড়ে। আমরা দশ/বারো জন যাত্রি। দিনটা বেশ গরমের। দেখি আমি ছাড়া সকলের মাথায় সান-হ্যাট, চোখে সান-গ্লাস ওমুখে সান-স্ক্রীন মাখা। জেটি ছেড়ে লঞ্চ এগোতে থাকলে পিছনে মিয়ামী ডাউন টাউনের দৃষ্টিনন্দন স্কাইলাইন দৃশ্যমান হয়। আকাশচুম্বী এক একটি অট্টালিকার স্থাপত্য অনবদ্য। উঠে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে গিয়ে ঢেউয়ের ধাক্কায় প্রমোদ তরীর আন্দোলনে তাল সামলাতে না পেরে পাশে বসা তরুণী সহযাত্রীর কোলের উপর পড়ি। আমার একটি হাত তাঁর দুই নরম উরুর সন্ধিস্থলে পড়ে। ভাবলাম, কি জানি বলে। না, সে কোন রকম রাগ না দেখিয়ে, বরং একটু হেসে আমাকে ধরে উঠে বসতে সাহায্য করে। তাঁর উম্মুক্ত সুডৌল বাহু লতার স্পর্শ ও তার দেহের সুবাস আমার স্নায়ুতে শিহরণ জাগায়। পরবর্তী সময়ে আরো ছবি তোলার সময় বার বার ভেবেছি, বেতাল হয়ে আবার কেন পড়ে যাই না। ভাবি, একবার ইচ্ছে করে অভিনয় করেই পড়ে যাব নাকি। সাহস হলো না। কেননা, যদি বুঝতে পারে তাহলে চ্যাংদোলা করে আমাকে বিসকেইন উপসাগরে ছুঁড়ে ফেলবে। আমাদের তরী এগিয়ে যায় তটরেখা থেকে বেশ দূর দিয়ে পোর্ট অব মিয়ামী’র দিকে। দেখি লাইন দিয়ে দাঁড়ানো বিশাল বিশাল অপূর্ব সুন্দর অনেক ক্রুইজ শিপ। এখান থেকে ভ্রমণার্থীদের নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে পাড়ি দেয় বিলাসবহূল এইসব বিশাল প্রমোদতরীসমূহ। দূর থেকে প্রমোদতরী গুলির বিশালত্ব ও জাঁকজমক অবাক হয়ে দেখি। তারপর আমাদের তরী ঘুরে দ্বীপের আরেক দিকে চলে আসে। এখানে তটরেখার ধারে ধারে অনুপম
দর্শনীয় সব অট্টালিকার সারি। এক এক খন্ড বিশাল জায়গার উপর এক একটি বাড়ি নির্মিত। বাড়িগুলির স্থাপত্য এবং প্রত্যেকটির বাড়ির চারিদিকে গড়ে তোলা বাগান ও ল্যান্ডস্কেপের বিন্যাস অতূলনীয়।গাইড জানালো,এই বাড়িগুলির মালিক আমেরিকার সব ধনাঢ্য ও প্রসিদ্ধ ব্যক্তিরা। শীতকালে উত্তরের অন্যান্য রাজ্যগুলি যখন বরফে ঢাকা পড়ে তখন বা অন্য সময়ে বিশেষ অবসর কাটাতে ঐসব অঞ্চলের বড়লোকেরা এখানকার বাড়ি বা এপার্টমেন্টে এসে থাকেন। এই বাড়িগুলির সারিকে বলা হয় ‘মিলিওনীয়ার্স রো’।
আমাদের তরী তীর ঘেঁষে আস্তে আস্তে চলতে থাকে। অবাক বিস্ময়ে দেখতে থাকি বর্ণাঢ্য বাড়ীগুলির জৌলস, দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য ও অনুপম বিন্যাস।
এরপর প্রমোদতরীটি ফিশার আইল্যান্ড ও সাউথ বীচের বরাবর ঘুরে যায়। যেদিকে তাকাই সেদিকে মন- ভোলানো চোখ-জুড়নো দৃশ্য। খুব তাড়াতাড়ি যেন দেড় ঘন্টা সময় শেষ হয়ে এল। ধীর লয়ে আমদের তরী আবার জেটিতে এসে ভিড়ে। আমরা তীরে উঠে আসি। এই অনবদ্য রোমাঞ্চকর ভ্রমণে দেখা মিয়ামী বীচের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যগুলির কথা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
পরদিন সাপ্তাহিক ছুটির দিন, বন্ধুবরের কলেজ নেই। তিনি সকালে তাঁর গাড়িতে করে আমাকে নিয়ে বের হন, মিয়ামী বীচের আর এক বিশেষ দ্রষ্টব্য দেখানোর জন্য। এটি হলো ‘মিয়ামী সীকোরিয়ম’ (Miami Seaquarium)। সীকোরিয়ামে জনপ্রতি প্রবেশ মূল্য খুব বেশীই মনে হল। একারিয়ামে সমুদ্রতলের লেবেলে নানা সামুদ্রিক প্রাণীর সমাহার। এই একোরিয়ামের আসল দ্রষ্টব্য জাঁকালো সামুদ্রিক প্রাণী ডলফিনের খেলা প্রাণ-মাতানো খেলা। নীচের একোরিয়াম দেখে আমরা আসি স্টেডিয়াম আকারের এক বিরাট ওয়াটার পুলে। দুইদিকে দর্শকদের বসার গ্যালারি। আমরা গ্যালারিতে উঠে দর্শক সারিতে গিয়ে বসি। শুরু হয় ডলফিনের মনোমুগ্ধকর খেলা। পুলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ভেসে বেড়ানো, মাঝে জল থেকে মাথা তুলে দর্শকদের উদ্দেশ্যে অবোধ্য ভাষায় কিছু বলা এবং নানা রকম এক্রোব্যাট। এরপর চলে সঙ্গিতের মুর্চনার তালে তালে পুলের জলে ডলফিনের একক- নৃত্য যুগল-নৃত্য ও দলীয় নৃত্য। তারপর দেখি দু’টি বাচ্চা ছেলেমেয়ে একটি অনুচ্চ
মঞ্চে এসে দাঁড়ালে দু’টি ডলফিনও ঐ মঞ্চে উঠে আসে এবং তাঁদের সাথে খেলায় মত্ত হয়। তারপর বাচ্চা দু’টি ডলফিন দুটির পিঠে চড়ে জলে ভাসে। তারা ডলফিনের সাথে হুটোপুটিতে মাতে এবং নানা এক্রোব্যাটে অংশ নেয়। আমরা আরো অনেক দর্শকের সাথে ডলফিনের এই অনবদ্য লীলা নিশ্বাস বন্ধ করে দেখতে থাকি। একসময় অনুষ্ঠান শেষ হলে দর্শদের করতালিতে মুখর হয় সমগ্র পুল। এখানে দর্শকদেরও ডলফিনের সাথে খেলায় অংশ নেয়ার ব্যবস্থা আছে। তার জন্য আলাদা টিকেট লাগে। দারুন এক অভিজ্ঞতা নিয়ে পুল থেকে বের হয়ে আসি। বন্ধুবরকে ধন্যবাদ জানাই এরকম একটি দ্রষ্টব্যস্থানে নিয়ে আসার জন্য। দুপুর দেড়টায় আমরা বাসায় ফিরে আসি।
লাঞ্চের পর আমরা দেশের কথা, পুরানো দিনের বিশেষ করে ছেলেবেলার কথা স্মরণ করে আড্ডায় মশগুল হই। অল্প কিছুক্ষণ পরে এই পুরানো বন্ধু ও বান্ধবীকে ছেড়ে চলে যেতে হবে – এই ভেবে মাঝে মঝে মনটা খারাপ হয়ে আসছে। আজ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে আমার মিয়ামী থেকে লন্ডন ফিরে যাওয়ার পোগ্রাম।
প্রকৌশলী জে, বি, বড়–য়া