পর্যটন বিচিত্রা প্রতিবেদন
চারিদিকে জলরাশি, আকাশ থেকে নামার সময় মনে হবে যেন সমুদ্রে নেমে যাচ্ছে বিমান। সমুদ্রের বুক ছুঁয়ে মাটিতে নামার এমন দৃশ্য যেমন উপভোগ্য ঠিক তেমনই রোমাঞ্চকর। মুহূর্তেই পাল্টে যাবে অনুভ‚তি। দীর্ঘ উড়োজাহাজ যাত্রায় গন্তব্যে পৌঁছানোর সময় আকাশ থেকে দেখা যাবে বিমানবন্দরের সৌন্দর্য। কক্সবাজার বিমানবন্দরের জন্য এমনই এক দৃষ্টিনন্দন রানওয়ে প্রস্তুত করা হচ্ছে। এটি দেশের সবচেয়ে বড় ও দৃষ্টিনন্দন রানওয়ে। এর অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অবতরণের সময় উড়োজাহাজটি একেবারে সাগর ছুঁয়ে যাবে। কারণ ১০ হাজার ৭০০ ফুট দীর্ঘ রানওয়ের মধ্যে ১ হাজার ৭০০ ফুট তৈরি হয়েছে সমুদ্রবক্ষে। আর এ রানওয়ে দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় যাত্রীবাহী বিমানটিও কক্সবাজার বিমানবন্দরে অনায়াসে নামার সুযোগ পাবে। সমুদ্রের সুনীল জলরাশির মাঝ দিয়ে রানওয়েটি এখন অনেকটাই দৃশ্যমান। রানওয়ের কাজ প্রায় শেষ।
প্রকল্পের অংশ হিসেবে রয়েছে রানওয়ে বর্ধিত করার পাশাপাশি দৃষ্টিনন্দন একটি আন্তর্জাতিক ভবন; যেখানে কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, লাউঞ্জ এবং গাড়ি পার্কিং সুবিধা থাকছে। ভবন থেকে সরাসরি বিমানে ওঠানামার জন্য থাকছে একটি বোর্ডিং ব্রিজ। সবগুলোই তৈরি হয়ে চালু হবে ২০২৪ সালের জুনে। একই সঙ্গে কক্সবাজার বিমানবন্দর ঘিরে পাশের দেশগুলোর আঞ্চলিক হাব হিসেবে তৈরির জন্য কনসালট্যান্ট নিয়োগের পরিকল্পনাও করেছে সরকার।
বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, শুধু সূর্যের আলোতে আকাশপথে কক্সবাজার যাওয়ার দিন শেষ হচ্ছে। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই রাতেও যাত্রী নিয়ে উড়োজাহাজ অবতরণ ও উড্ডয়ন করবে। এতদিন বিমানবন্দরটির রানওয়ের দৈর্ঘ্য কম ও অন্যান্য অবকাঠামো অনুন্নত থাকায় সব ধরনের বিমান চলাচল করতে পারত না। তাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় অবিচ্ছিন্ন সমুদ্রসৈকতে ঘুরতে আসা বিদেশি পর্যটকদের ঢাকা হয়ে কক্সবাজার যেতে হয়েছে। আর এর ফলে নানা রকম ভোগান্তির শিকার হতে হয় তাদের। চলতি বছরের নভেম্বরে রানওয়ে প্রস্তুত হয়ে যাবে। তখন অভ্যন্তরীণ রুটের বিমানগুলো এটি ব্যবহার করতে পারবে। তবে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচলের জন্য অনুমতি পেতে কিছুটা সময় লাগে। আগামী বছর আন্তর্জাতিক রুটের ফ্লাইটগুলো এই রানওয়ে ব্যবহার করতে পারবে। বর্তমানে কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে দেশের চারটি বিমান সংস্থার যাত্রীবাহী বিমান প্রতিদিনই ওঠানামা করে।
অন্যদিকে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের রূপ দেওয়ায় খুশি স্থানীয়রা। তারা বলছেন, কক্সবাজারের আধুনিক পর্যটন শিল্প বিকাশে এই বিমানবন্দর রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী চীনা প্রতিষ্ঠান বলছে, নানা প্রতিক‚লতার মাঝেও নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।
কক্সবাজার বিমানবন্দর রানওয়ে সমুদ্র সম্প্রাসারণ প্রকল্পের পরিচালক মো. ইউনুস ভূঁইয়া বলেন, কক্সবাজার বিমানবন্দরে প্রস্তুত হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় ও দৃষ্টিনন্দন রানওয়ে। প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ডিসেম্বরে মাসের শেষদিকে চালু হবে। নতুন রানওয়ের পুরোটা (১ হাজার ৭০০ ফুট) অংশ থাকছে সাগরজলের ওপর। উড়োজাহাজ নামবে সাগরের জল স্পর্শ করে। তখন কক্সবাজারের পর্যটনসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। আমরা দ্রæত কাজ শেষ করার চেষ্টা করছি।
ডিসেম্বরে রানওয়ে উদ্বোধন হলেও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি পেতে অনেক সময় লাগবে। কারণ এই প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অনেক জায়গা এখনও দখল হয়ে আছে। সেগুলো দখলমুক্ত করে স্থাপনা নির্মাণ করার পর আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালানোর জন্য অনুমতির আবেদন করতে হবে।
বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান বলেন, অক্টোবরে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে অর্থনীতির চাপ এসেছিল ফরেন কারেন্সিতে। এলসি খুলতে পারিনি। এর জন্য কিছু আইটেম ক্রয় করে আনতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। আশা করি, ডিসেম্বরের মধ্যে বর্ধিত রানওয়ে চালু হবে। অভ্যন্তরীণ রুটের জন্য প্রস্তুত হলেও, আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু হতে লাগবে আরও সময়। আন্তর্জাতিক বিমান ডিক্লেয়ার করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিছু কিছু স্থাপনা সরাতে হবে। সেগুলো দখল হয়ে রয়েছে। এ জন্য জেলা প্রশাসক, মন্ত্রণালয় এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলছি। দ্রুত সময়ের মধ্যে এই কাজগুলো শেষ করা হবে। আশা করি, আগামী ২০২৪ সালের জুনের আগেই আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু ও দিবারাত্রি ফ্লাইট ওঠানামার কার্যক্রম শুরু হবে।
তিনি বলেন, এটি চালু হলে, বিদেশি পর্যটকদের জন্য বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতে নির্ঝঞ্ঝাট ভ্রমণের সুযোগ হবে। এই রানওয়ে চালু হলে কক্সবাজার থেকে সরাসরি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বিমান চলাচল সংযুক্ত হবে। পাশাপাশি রাতেও উঠানামা করতে পারবে বিমান। এটির কারণে কক্সবাজার বিদেশি পর্যটক টানতে সক্ষম হবে। রানওয়ে পরিষেবা চালু হলে বোয়িং ৭৭৭ এবং বোয়িং ৭৪৭-এর মতো বড় বিমানগুলো কক্সবাজার বিমানবন্দরে অবতরণ করতে সক্ষম হবে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে সমুদ্রের বুকে প্রথম রানওয়ে দৃশ্যমান হয়েছে; উদ্বোধন হবে শিগগিরই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একমাত্র দূরদর্শী সিদ্ধান্তে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এটি চালু হওয়ার পর যাত্রীরা আকাশ থেকে নামার সময় মনে হবে যেন সমুদ্রের মধ্যে নেমে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, কক্সবাজারে বৃহৎ পরিসরে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করার প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। দ্রুত সময়ের মধ্যে দ্বিতীয় রানওয়ের কাজ শুরু হবে। একই সঙ্গে সমুদ্রপারে আরও বড় পরিসরে একটি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে।
রিফুয়েলিং সিস্টেম চালু
আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার আগেই রিফুয়েলিং সিস্টেম চালু করেছে কক্সবাজার বিমানবন্দর। গত ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে আসা একটি বিমানে জ্বালানি তেল সরবরাহের মাধ্যমে শুরু হলো এ যাত্রা। পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড কক্সবাজার বিমানবন্দরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজে এক হাজার ২০০ লিটার জ্বালানি তেল সরবরাহের মাধ্যমে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামীতে রিফুয়েলিংয়ের হাব হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে।
কক্সবাজার হচ্ছে পর্যটনের হাব। এ পর্যটনের সঙ্গে বিমানবন্দরের যোগাযোগ এটি সারা বিশ্বে স্বীকৃত। সে লক্ষ্য নিয়ে সরকার কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে ঘোষণা করেছে। বড় বড় বিমান আসবে কক্সবাজার বিমানবন্দরে। যে কারণে এখানকার চাহিদা অনেক বৃদ্ধি পাবে, বিশেষ করে উড়োজাহাজের জ্বালানির চাহিদা। এ কারণেই বিমানের রিফুয়েলিংয়ের একটি নতুন যাত্রা শুরু হয়েছে। কক্সবাজার বিমানবন্দরে বর্তমানে তিনটি ট্যাংকে জ্বালানি তেলের ধারণ ক্ষমতা রয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার লিটার। এটি আগামীতে পর্যায়ক্রমে ৩ থেকে ৪ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত করা হবে।