পর্যটন বিচিত্রা ডেস্ক
১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলটি পার হতে সময় লাগবে মাত্র তিন মিনিট। টানেলে থ্রি হুইলার ও মোটরসাইকেল চলবে না। হেঁটেও পার হওয়া যাবে না। টানেলের ভেতরে সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চলবে। টানেল পথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজারের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমে আসবে। সময়ও লাগবে এক ঘণ্টা কম।
তিন দশমিক ৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে টানেলটি শুধু বাংলাদেশে নয়, দক্ষিণ এশিয়ার কোনো নদীর তলদেশে নির্মিত প্রথম টানেল। যা চট্টগ্রাম অঞ্চলে খুলে গেল স্বপ্ন ও সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় এলো বৈপ্লবিক পরিবর্তন। চট্টগ্রাম নগরী ও সারা দেশের সঙ্গে চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চল এবং কক্সবাজারকে এক করেছে এই টানেল। বাস্তবায়ন হবে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি-টু টাউন’ কনসেপ্ট। টানেলের একপ্রান্তে রয়েছে চট্টগ্রাম নগরী, অন্যপ্রান্তে আনোয়ারা এলাকায় গড়ে উঠবে নতুন শহর। যাতায়াত সহজতর হওয়ায় কমবে সময় ও পরিবহণ ব্যয়। দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে শিল্পায়ন হবে দ্রুতগতিতে। সমৃদ্ধ হবে দেশের অর্থনীতি।
এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেলের জন্য চট্টগ্রামবাসী বহুদিন ধরে অপেক্ষায় ছিল। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। চট্টগ্রামের চেহারা বদলে দেবে এই টানেল। এটি যুগান্তকারী একটি কানেকটিভিটি। চীনের সাংহাইয়ের মতো ‘ওয়ান সিটি-টু টাউন’ গড়ে উঠবে টানেলের সুবাদে। চট্টগ্রামের মানুষের জীবনমান হবে অনেক উন্নত। টানেল শুধু চট্টগ্রাম নয়, দেশের অর্থনীতিতে রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কর্ণফুলীর অপর পাড়ে শিল্পায়ন শুরু হয়ে গেছে। আরও নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। কক্সবাজার পর্যন্ত শত কিলোমিটার এলাকাজুড়ে শিল্পায়নের দুয়ার উন্মোচিত হয়েছে। উপকৃত হবে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প। শুধু একটি টানেলের কারণে দেশের জিডিপিতে এক শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটবে।
তিনি আরও বলেন, টানেলের পুরো সুফল পেতে হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করতে হবে। যেটি টানেল হয়ে মেরিন ড্রাইভের সঙ্গে সংযুক্ত হবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের নভেম্বরে প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে টানেল প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। নির্মাণ কাজের দায়িত্বে ছিল চীনা কোম্পানি ‘চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন লিমিটেড’। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে বঙ্গবন্ধু টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম টানেল-টিউব নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন।
বাংলাদেশ ও চীন সরকারের যৌথ অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে। চীনের এক্সিম ব্যাংক দুই শতাংশ হারে সুদে পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। বাকি অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশ সরকার।
দুয়ার খুলল নতুন অর্থনৈতিক হাবের
দুটি কারণে টানেলের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে বড় করে দেখছেন অর্থনীতিবিদ ও উদ্যোক্তারা। একটি হলো- আনোয়ারাসহ দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মাতারবাড়ী পর্যন্ত উপক‚লের কাছাকাছি পরিকল্পিতভাবে শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা যাবে, যেখান থেকে খুব সহজেই টানেল ব্যবহার করে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য আনা–নেওয়া করা যাবে। আবার ২০২৬ সালে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের টার্মিনাল চালু হলে সারা দেশের পণ্য এই টানেল ব্যবহার করে আনা–নেওয়া সহজ হয়ে যাবে।
দ্বিতীয়ত- শিল্পকারখানা চালুর জন্য গ্যাস ও বিদ্যুতের মতো সুবিধা দেওয়া যাবে এই অঞ্চলে, এ জন্য বাড়তি খুব বেশি বিনিয়োগ করতে হবে না। কারণ, আমদানি গ্যাসের পাইপলাইন নেওয়া হয়েছে এই অঞ্চল দিয়ে। চালু ও চালুর অপেক্ষায় থাকা আড়াই হাজার মেগাওয়াটের দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রও রয়েছে এ অঞ্চলে। অর্থাৎ বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সব সুবিধা রয়েছে এই অঞ্চলে।
এই টানেল মূলত মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত সমুদ্র উপক‚লের সঙ্গে আনোয়ারা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত উপক‚লকে যুক্ত করেছে। এই উপক‚লে মেরিন ড্রাইভ নির্মাণের প্রকল্প নিয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। বৈদেশিক ঋণসহায়তার জন্য প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প ছক তৈরি হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ১৭০ কিলোমিটার লম্বা মেরিন ড্রাইভ নির্মাণে সম্ভাব্য খরচ ধরা হয়েছে ৪২ হাজার কোটি টাকা।
উদ্যোক্তারা বলছেন, এই মেরিন ড্রাইভের পাশে গুচ্ছ গুচ্ছ শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা যাবে। শিল্পাঞ্চল গড়ার জন্য জমিরও সহজলভ্যতা রয়েছে। যেখানে খাসজমিই বেশি।
প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বলেন, এই অঞ্চলে শিল্পায়নে গতি আনবে টানেল। কারণ, কাছাকাছি বন্দর–সুবিধা থাকায় ব্যবসার খরচ কমবে। আবার সুপরিকল্পিতভাবে শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা যাবে।
অর্থনীতিবিদ ও ইউজিসির সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, এই টানেল দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের সাগর উপকূল ধরে বিশাল এলাকা শিল্পায়ন, নগরায়ণ ও পর্যটনের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এই সুবিধা নিতে হলে মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সাগর উপক‚ল ধরে মেরিন ড্রাইভ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। আবার বাংলাদেশ–চীন–ভারত–মিয়ানমার অর্থাৎ বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডরের সড়ক নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এই টানেল। বিসিআইএম কার্যকর হলে সত্যিকার অর্থে আগামী দিনে অর্থনৈতিক হাবে পরিণত হতে পারে এ অঞ্চল।
কোন গাড়ির কত টোল
সেতু কর্তৃপক্ষের নির্ধারণ করা টোল অনুযায়ী, টানেলের মধ্য দিয়ে যেতে হলে প্রাইভেট কার, জিপ ও পিকআপকে দিতে হবে ২০০ টাকা করে। শাহ আমানত সেতুতে ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য ৭৫ টাকা এবং জিপের জন্য ১০০ টাকা দিতে হয়।
আর টানেলের ভেতর চলতে হলে মাইক্রোবাসের জন্য দিতে হবে ২৫০ টাকা। শাহ আমানত সেতুতে এই হার ১০০ টাকা।
৩১ বা এর চেয়ে কম আসনের বাসের জন্য ৩০০ এবং ৩২ বা তার চেয়ে বেশি আসনের জন্য ৪০০ টাকা টোল দিতে হবে। যদিও শাহ আমানত সেতুতে নেওয়া হয় যথাক্রমে ৫০ ও ১৫৫ টাকা।
টানেল দিয়ে যেতে হলে ৫ টনের ট্রাকে ৪০০ টাকা, ৫ থেকে ৮ টনের ট্রাকে ৫০০ টাকা, ৮ থেকে ১১ টনের ট্রাকে ৬০০ টাকা টোল দিতে হবে। তবে শাহ আমানত সেতুতে টোল নেওয়া হয় যথাক্রমে ১৩০, ২০০ ও ৩০০ টাকা। ট্রেইলরের (চার এক্সেল) টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০০ টাকা। শাহ আমানত সেতুতে এই হার ৭৫০ টাকা। চার এক্সেলের বেশি হলে প্রতি এক্সেলের জন্য দিতে হয় ২০০ টাকা করে।
রিসোর্টের মতো সার্ভিস এরিয়া
এই টানেল প্রকল্পের ভেতরেই ‘সার্ভিস এরিয়া’ বলতে একটি বিশেষ অংশের কাজ চলছে। সেখানে অনেক সুযোগ সুবিধা থাকবে। এরমধ্যে ৩০ টি বাংলো, একটি ভিআইপি বাংলো, মোটেল মেস, হেলথ সেন্টার, মাঠ, টেনিস কোর্ট, কনভেনশন সেন্টার, জাদুঘর, সুইমিং পুল, মসজিদ ও হেলিপ্যঠ নির্মাণ করা হচ্ছে।
এটিকে পরবর্তীতে রিসোর্ট হিসেবে জনসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হবে; যেটা থেকে সরকারের আয়ের উৎস হবে।
পর্যটন বিচিত্রা ডেস্ক