দেশ থেকে এসেছি অনেক বছর আগে, কলেজজীবনের পরপরই, এরপর কত দ্রুতগতিতে বছরগুলো পার হয়ে গেল! ঘটল কত চিত্র-বিচিত্র ঘটনা, বোহেমিয়ানদের মতো ঘুরে বেড়ালাম ইউরোপের পথে প্রান্তরে, গেলাম সর্ব উত্তরের মানববসতি স্পিটসবের্গেন দ্বীপপুঞ্জে, পৃথিবীর সর্ব উত্তরে ছয় মাস দিন ছয় মাস রাতের রাজ্য উত্তর মেরুতে, গিরিরাজ হিমালয়ে, মধ্য প্রাচ্যের ধু ধু বালিয়াড়ির মাঝে, আল্পসের সর্বোচ্চ শিখর মঁ বøাতে, আন্দেজের কোলে, ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে, তিব্বতের নির্জনতায়, মেক্সিকোর পিরামিডে, আফ্রিকার বুনো প্রান্তরে।
আহা, কী সব অপূর্ব স্মৃতি, সামান্য মনোযোগের আভাস পেয়ে মনের মুকুরে রাখা প্রতিটি স্মৃতি জ্বলজ্বল করে উঠছে, তারপরও কেউ যদি প্রশ্ন করেন, ভ্রমণের মাধ্যমে কোন জায়গাটি সবচেয়ে ভালো লেগেছে, কোনখানে বারংবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে? বিন্দুমাত্র চিন্তা না করেই বলব- সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড়। যেখানে প্রথম যাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সাথে পরিযায়ী পাখি পর্যবেক্ষণের জন্য ২০০২ সালে। সেই প্রথম বাড়ির বাইরে ঈদ, পুরোনো রোজনামচার পাতা থেকে সেই কথাই জানাচ্ছি আজ।
যাত্রা শুরু হলো ২২ ফেব্রæয়ারি, অজানার উদ্দেশে, অদেখার উদ্দেশে। পাখিপ্রেমিক, আলোকচিত্রগ্রাহক রোনাল্ড হালদার ভাইয়ের অতি চমৎকার সব পরিযায়ী হাসের ছবি সমৃদ্ধ টি-শার্টের পেছনে যেন সেই হাওড়ে গেলেই এই রঙ ঝলমলে পাখিগুলো দেখতে পাওয়া যাবে। তখন থেকেই সুপ্ত ইচ্ছা ছিল- দেশের একবারে সীমান্তঘেঁষা পাখির এই গুরুত্বপূর্ণ আবাসভূমিটি দেখে আসার। কাজেই বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সেখানে যাবার খবর পেয়ে একরকম জোর করেই ইনাম ভাইয়ের কাছ থেকে সাথে যাবার অনুমতি আদায় করলাম। সুনামগঞ্জকে বলা হয়, বাংলাদেশের সবচেয়ে সমতল অঞ্চল, যে কারণে এখানে মাইলের পর মাইলব্যাপী বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে পানি থৈ থৈ করা হাওড়। এমনটাও শুনলাম, এখন যে জমিগুলো আমার দেখতে পাচ্ছি তার অধিকাংশই বর্ষাকালে পানির নিচে তলিয়ে থাকে।
সুনামগঞ্জ শহরতলী থেকে সুরমা নদী পথে আমাদের যাত্রা শুরু। সুরমা ভ্রমণের জন্য অতি চমৎকার নদী, অপেক্ষাকৃত কম প্রশস্ত, সর্বদাই শান্তভাবে বয়ে চলেছে মৃদুমন্দ হাওয়াকে সাথি করে, প্রবল স্রোত যেমন নেই এখানে, তেমন নেই বিক্ষুদ্ধ ঢেউ। অনেক সময় মনে হয়, এ যেন মানুষের হাতে তৈরি বড় ধরনের খাল, বিশাল এক গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেছে। দুধারের প্রাকৃতিক দৃশ্য তুলনাহীন। আসলে মাথার ওপর অবারিত নীল আকাশ, পায়ের নিচে শান্ত বহমান জলধারা, চারপাশের উন্মুক্ত প্রকৃতি যে কোনো মানুষকেই কিছুটা কল্পনাবিলাসী করে তুলবে, তবে বাধা এখানেও আছে, সেটা হচ্ছে আমাদের ইঞ্জিনচালিত বোটের বিরক্তিকর একঘেয়ে ঘটঘট উৎকট শব্দ, যাকে বলা চলে রীতিমত উৎপাত!
ও বলা হয়নি, এই ট্রলারই আগামী ৫ দিনের জন্য আমাদের বাড়ি, শুধুমাত্র রাত্রিযাপন নয়- রান্না, খাওয়া থেকে শুরু করে বাথরুম পর্যন্ত সবকিছুই সম্পন্ন করতে হবে এখানেই। পাখি পর্যবেক্ষকের সংখ্যা আটজন, বরাবরের মতো দলনেতা ইনাম ভাই তার ক্যামেরা, টেলিস্কোপ আর দূরবীন নিয়ে ব্যস্ত, মহাকাশ মিলন ভাই আর এমএ মুহিত ন্যস্ত যাত্রার তদারকিতে, পুরোনো ঢাকার আমান ভাই আর আইইউবিয়ের শিক্ষক সাবির ভাই প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছেন তারিয়ে তারিয়ে। সাইফ আর আমি দলের কনিষ্ঠতম সদস্য, তাই বলে অপাংক্তেয় নয় মোটেই, আর আছেন সব যাত্রার একমাত্র বিদেশি সঙ্গী চেক ডাক্তার মারিশ্যা ক্রাউসোভা। নৌকার মাঝির সংখ্যা তিনজন, সর্দার শওকত মাঝির পরিপাটি গোঁফ আর জবা ফুলের মতো রক্তলাল চোখ বারবার এই অঞ্চলেরই কিংবদন্তি হাসন রাজার কথা মনে করিয়ে দেয়।
অভিযানের প্রথম দিনে যাত্রাবিরতি করতে হয়েছে মাত্র একবার এবং তা অবশ্যই পাখি দেখার জন্য। একদা সমগ্র বাংলায় যে পাখিটি সর্বদা চোখে পড়ত, আজ তা আশ্চর্য রকমের দুলর্ভ। আমি শকুনের কথা বলছি। মানুষের অহেতুক ভীতি আর খাদ্য, বাসস্থানের ওপর আগ্রাসনের কারণে পরিবেশের দারুণ উপকারী এই পাখিটি অস্তিত্ব আজ বিপন্ন, আর চোখের সামনে একসাথে চারটি শকুন, সে তো রাজদর্শনের মতই দুলর্ভ। এই বিরল দৃশ্যটি কাছে থেকে অবলোকন করা আর তাদের ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি করার জন্যই আমাদের প্রথম যাত্রাবিরতি।
প্রথমদিন আরও এক ঝাঁক অতি দুর্লভ প্রাণী দেখার হঠাৎ সুযোগ মিলেছিল আমাদের, তবে তা খেচর নয়, জলচর। নদীর এক বাঁকের মুখে শুশুক বা গাঙ্গেয় ডলফিনের ৭-৯ সদস্যের এক দলের সাথে সাক্ষাৎ ঘটল। ভয়ঙ্কর প্রাণী মনে করে অহেতুক শিকার করা আর নদী দূষণের কারণে এদের সংখ্যাও ক্রমশ শূন্যের দিকে এগোচ্ছে, অথচ জীব বিজ্ঞানীদের মতে প্রায় অন্ধ এই জীবগুলো কোনোভাবেই মানুষের ক্ষতি তো করেই না বরং নানা উপকারে আসে, এভাবেই দিন দিন মানুষের অজ্ঞানতা আর কুসংস্কারের ফলে এদের বিলুপ্তি ঘটছে, যেভাবে বাংলাদেশ থেকে প্রায় চিরতরে হারিয়ে গেছে মেছো কুমির বা ঘড়িয়াল।
সন্ধ্যার অল্প পরেই আলো স্বল্পতার কারণে সেই রাতের মতো যাত্রাবিরতি করতে হলো যেকোনো লোকালয় থেকে অনেক দূরে কোনো এক অজ এলাকায়, অনাকাক্সিক্ষত অতিথির উপদ্রব এড়াতে নৌকা থামানো হলো নদীর বুকে জেগে সদ্য জেগে ওঠা চরে। কাদায় ভর্তি সেই চরে হাঁটু পর্যন্ত না ডুবিয়ে হাটা প্রায় অসম্ভব কাজ। তবে লোকালয় থেকে যত দূরেই থাকি না কেন, মশাদের গুনগুন গান কিন্তু সেটা মনে করতে দেয়নি!
সকালে ঘুম ভাঙল সহযাত্রীদের উত্তেজিত কথাবার্তায়, সবার কথার সারমর্মই এক- এই ভোরে গ্রামের শিশু থেকে শুরু করে আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই স্নান করতে নেমেছে, সূর্যদেব এখনো তার দর্শন দেননি, তবে খুব শীঘ্রই যে মেঘ আর কুয়াশার চাদর হটিয়ে তার অস্তিত্বের জানান দেবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই, আর তখন সূর্যোদয়ের অপরূপ রঙ ভোরের মেঘে ছড়িয়ে গোটা প্রকৃতিকেই এক অপরূপ আভায় রাঙিয়ে তুলবে, আর অপরূপ সেই দৃশ্যকে ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহার করে স্নানার্থীদের ভালো কিছু ছবি তোলা সম্ভব হতে পারে, এটাই সবার আলোচ্য বিষয়।
যেমন কথা, তেমন কাজ। মোটামুটি সবাই ক্যামেরা ও ভিডিও ক্যামেরা হাতে নৌকার ছাদে চলে গেলেন, কিন্তু সবার মনেই একই প্রশ্ন কি কারণে আপামর জনসাধারণ এতো ভোরে ঠান্ডার মাঝে পানিতে নেমেছে! কে যেন বলে উঠল- আজ তো ঈদ! এরা তো ঈদের গোসল করছে। আজ ঈদের দিন, পরিবারের বাইরে প্রথম ঈদ করছি, আশ্চর্য কারো মনেই হয়নি, একবারের জন্যও না! অতএব, ঈদ মোবারক!
আবার যাত্রা শুরু টাঙ্গুয়ার উদ্দেশে, হাওড় এলাকায় অনেক আগে প্রবেশ করলেও মূল হাওড়ে তখনো প্রবেশ করিনি আমরা, কয়েক ঘণ্টা নিরবিচ্ছিন্ন যাত্রার পর চোখে যেন কিছুটা দৃষ্টিবিভ্রম দেখা দিল। দৃষ্টিবিভ্রমই বটে, না হলে দেশের সবচেয়ে সমতল এলাকা, মাইলের পর মাইলে হাওড়ের জলা, এখানে পাহাড় আসবে কোথা থেকে। চোখ ভালো মতো রগড়ে আবার তাকালাম, আরে পাহাড়ই তো! তাও চা বাগানের ছোটখাটো টিলা নয়, একবারে সুউচ্চ পাহাড়, অনেকটা টেকনাফ থেকে আরাকানের পাহাড় দেখতে যেমন লাগে সে রকম পাহাড়শ্রেণি। হতবিহŸল অবস্থা কাটালেন মিলন ভাই, অনেকটা ঘোষণা দেবার ভঙ্গিতে বললেন- মেঘালয়! মেঘালয়!!
তাই তো, আমরা এখন সীমান্তবর্তী এলাকায়, দূরে মেঘালয়ের পাহাড়শেণি আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে, পাহাড়ের মাথায় মেঘ জমে আছে, দূর থেকে মনে হচ্ছে পেঁজা তুলোর ভেলা ভিড় করে আছে, সহযাত্রীদের কেউ বলে উঠল যথার্থ নাম মেঘালয়- মেঘের আলয়।
পথে পানাবিলে দেখা হলো বিশ্বব্যাপী বিপন্ন এবং মাছ ধরায় অপরিসীম দক্ষতার অধিকারী পাখি অসপ্রের (কালিগাল মেছো চিলে) সাথে, সে উড়ে এসেছে ইউরোপের কোনো প্রান্ত থেকে, নাতিশীতোষ্ণ শীতের আশায়। এরকমই এক বিশাল বিলের মাঝে ব্যতিক্রমী নীল ছোপ দেখা যেতেই সবার উৎসুক হয়ে নৌকা থামাল, যা ভাবা হয়েছে তাই, সুবিশাল জল-কাদাময় ভূখÐের এক কোণায় কয়েকশ পদ্ম নীল কালেম পাখির ঝাঁক। মানুষের রসনা তৃপ্ত করতে করতে এদের অস্তিত্ব ধ্বংসপ্রায়, বাংলার এসব নির্জন বিরান প্রান্তরেই আজ তাদের আস্তানা।
টাঙ্গুয়ার হাওড়ে যেখানে ফি-বছর পাখি পর্যবেক্ষকরা নৌকা থামিয়ে আস্তানা গাড়েন, সেখানে নোঙর ফেলার সাথে সাথেই কুড়া ঈগলের সাথে দেখা হলো, কাছেই গাছের মাথায় তার বিশাল বাসা, সেখানে ছানা লালন-পালন আর খাদ্য জোগাড়েই সে ব্যস্ত। এই প্যালাসাস ফিশ ঈগল বা পালাসি কুড়া ঈগল বিশ্বের অন্যতম বিরল প্রজাতির শিকারি পাখি। প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর জোট-আইইউসিএন কতৃক প্রণীত বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় পাখিদের তালিকায় রেডবুকে এদের নাম আছে।
বাসোপযোগী গাছ এবং খাদ্যের উৎস জলাভূমি ধ্বংসের কারণে এদের এক সময় বাংলাদেশের হাওড় প্রধান সমস্ত এলাকায় ও সুন্দরবনে দেখা গেলেও এখন প্রধানত সুনামগঞ্জেই দেখা যায়। এরা মৎস্যভোজী। পালাসি কুড়া ঈগলের উড়ার ভঙ্গি সত্যিকার অর্থেই রাজকীয়, বিশাল ডানার বিস্তার, কালো লেজের ঠিক মাঝখানের সাদা পালকের সারি লেজকে তিনরঙা পতাকায় পরিণত করেছে (তা উড়ন্ত অবস্থায় চিহ্নিত করতেও সুবিধাজনক), আর পাখা সঞ্চালনের ভঙ্গি উড়াকে করেছে সুষমামন্ডিত।
পাখি অন্তঃপ্রাণ ইনাম ভাই তখনি ভিডিও ক্যামেরা হাতে সেই অপরূপা ঈগলকে ফ্রেমবন্দি করতে গেলেন, সারাদিনের ভ্রমণ শেষেও আশ্চর্য রকমের প্রাণবন্ত এই কাজপাগল মানুষটি! আমরা তখন আগামী ক’দিনের আবাসটি দেখে নেওয়ার সাথে সাথে মাঝির তৈরি চায়ের অপেক্ষারত।
পরদিন সাতসকালে উঠেই যাত্রার তোড়জোড়, বড় ট্রলার বা বজরাটি নোঙররত, অপেক্ষাকৃত ছোট এক নৌকা আনা হলো, যাতে আমরা টেলিস্কোপ, ভিডিও ক্যামেরাসহ সারাদিন হাওড়ে পাখি গণনার কাজ করব। বিশাল বিস্তীর্ণ টাঙ্গুয়ার হাওড়, যে দিকেই তাকাই থৈ থৈ পানি, অনেক জায়গা থেকেই কিনারা দেখা যায় না, তার মধ্যে একরত্তি নৌকায় আমরা কজন প্রকৃতিপ্রেমিক, খানিকপরই হাঁসের দলের সন্ধান পাওয়া গেল।
দেশি মেটে হাঁস, নীলমাথা হাঁস, খুন্তে হাঁস, গিরিয়া হাঁসের দল খাবারের সন্ধানে চরতে বেরিয়েছে, আহ, কি অপরূপ সৌন্দর্য তাদের, তেল চকচকে ভেজা শরীরে সূর্যের আলো যেন ঠিকরে পড়ছে, কিছু মানুষ কেমন করে পারে এই পাখিগুলোকে গুলি করতে?
এক জলার মতো জায়গায় প্রায় হাজার পাঁচেক উত্তুরে খুন্তে হাঁসের বিশাল ঝাঁক দেখা গেল, অবিকল খুন্তের মতো তাদের ঠোঁটের গড়ন, প্যাক প্যাক করতে করতে খাবারের সন্ধানে চষে বেড়াচ্ছে জলাগুলো।
সুদর্শন পাখি নেউ পিপির (যাদের অনেকেই লম্বা লেজের কারণে জলময়ূর বলে) দল ভেসে যাচ্ছে নল খাগড়ার বনে, হঠাৎ হাওড়ের এমন এক জায়গায় হাজির হলাম আমরা, যেখানে শুধু হাঁস আর হাঁস, জল পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না থিকথিকে হাঁসের দঙ্গলের ভিড়ে! অনেকক্ষণ গণনার পর জানা গেল প্রায় দেড় লাখ হাঁস আছে সেই এক জায়গাতেই, তাদের ফাঁকে ফাঁকে কিছু বড় খোঁপা ডুবুরি ইতস্তত মাছ শিকারে ব্যস্ত। আমরা বেশ দূরে অবস্থান করে টেলিস্কোপের সাহায্যে গুনছিলাম বলে পাখির দলে তা কোনো আলোড়নের সৃষ্টি করেনি, কিন্তু হঠাৎ এমন এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা ঘটল, যা চর্মচক্ষে দেখার সৌভাগ্য খুব মানুষের হয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস!
একেবারে কোনো রকম জানান না দিয়েই দেখি মহাকাশের উল্কার মত সেই বিশাল হাঁসের ঝাঁকের ওপর দুই দিক থেকে দুটি পৃথিবী সবচেয়ে দ্রæতগতির প্রাণী (জলচর, স্থলচর, খেঁচর মিলিয়ে) পেরিগ্রিন শাহিন ( পেরিগ্রিন ফ্যালকন) তীব্র গতিতে ধেয়ে আসছে, যা সেই ভাসমান পাখিগুলোর কাছে মূর্তিমান বিভীষিকা, যেকোনোটার প্রাণ তখন সুতোর ওপর ঝুলছে, প্রাণভয়ে দেড় লাখ হাঁস একসাথে সপাটে ডানা ঝাপটিয়ে উড়াল দেয়ার মাধ্যমে যে স্বর্গীয় দৃশ্যের অবতারণা করল তাতে এক মুহূর্তের জন্য হলেও গোটা আকাশ যেন ঢেকে গেল সেই ঝাঁকে, এই দৃশ্য মহাকবি কালিদাস দেখলে হয় তো হংসবধ্য কাব্য লিখে ফেলতেন, আর আমরা বেরসিকের দল কেমন স্থাণুভাবে দাঁড়িয়ে সেই সৌন্দর্যসুধা উপভোগ করতে থাকলাম।
দুপুরে খানিকপর ফেরার পথে জেলেদের মাছধরার বাঁশ ফাঁদের ওপর কুচকুচে কালো পানকৌড়ির ঝাঁকের ভেতরে বিশ্বের অন্যতম বিরল পাখি সাপপাখি বা উদয়ী গয়ারের দেখাও মিলল, টাঙ্গুয়ার এই হাওড়টি যে জীববৈচিত্র্যে কত সম্পদশালী!
ইনাম ভাইয়ের কাছেই জানা গেল, এই বিশাল হাওড়ের জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য প্রতিদিন কয়েক হাজার টন ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হতো, যা বাংলাদেশে কখনোই সম্ভব হত না, কিন্তু এই বিশাল হাঁসের ঝাঁকের বিষ্ঠা সেই প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগাড় দেয়!
মাঝির রান্না টাটকা মাছের ঝোল দিয়ে উদরপূর্তি করে ছোট ছোট দলে সবাই বিভিন্ন অ্যাডভেঞ্চারে বের হলাম। মিলন ভাই সাইফকে নিয়ে রওনা দিলেন মেঘালয়ের পাহাড়ের উদ্দেশে, তার এক কথা- পাহাড় ছুঁয়ে তারপর ফেরত আসবেন। আমি আর মারিশ্যা আরেক প্রান্তে রওনা দিলাম কাছের গ্রামগুলো দেখার আশায়, ইনাম ভাই বরাবরের মতো ঈগলের ছবি তুলতে ব্যস্ত।
টাঙ্গুয়ার চিত্তহরণকারী সূর্যাস্তের কথা আর নাই বা বলি, সে কেবলমাত্র চোখে দেখার জিনিস এবং অনুভবের জিনিস। সন্ধ্যার বেশ খানিক পর ফিরে আসার সময় দেখি- আমান ভাই ছইয়ের পাশে আরাম করে চন্দ্রাহত মানুষের মতো বসে আছেন। শুধু বললেন- ‘ভাই, সূর্য ডোবার সময়টাতে ঈগলটাকে দেখলাম দারুণভাবে উড়ে এসে বাড়িতে বসল, আহা, বুকটা ভরে গেছে! এ জীবন সার্থক!!’
পরদিন যাওয়া হলো হাওড়ের অন্যপ্রান্তে, দেখা মিলল বিপন্ন মরচেরঙ ভুতি হাঁসের, যাদের সংখ্যা আমাদের জানামতে গোটা বিশ্ব লাখখানেকেরও কম। অথচ অবাক করা বিষয় হলো আমরা সেদিন দর্শন পেলাম নব্বই হাজারের মতো মরচেরঙ ভুতি হাঁসের! পরবর্তীতে ঢাকায় এসে ইনাম ভাই এই সংখ্যা জানানোর পর গোটা বিশ্বে তাদের সংখ্যা একেবারে দ্বিগুন ধরা হয়েছে, যা রীতিমত আশা জাগানিয়া।
আরও দেখা মিলল উত্তুরে ল্যাঞ্জা হাঁস, ইউরেশীয় সিথী হাঁস, গাডওয়াল হাঁস, দেশি মেটে হাঁস লালঝুঁটি ভুতি হাঁসের বিশাল ঝাঁকের। উল্লেখ্য, রামসার সাইট ঘোষিত এই হাওড়ে ২৬ প্রজাতির হাঁস এ পর্যন্ত দেখা গেছে, এমনকি সুদূর চীন থেকে আসা মান্দারিন হাঁস পর্যন্ত। শেষমেষ প্রায় তিন লাখ হাঁস গুনলাম আমরা। এই হাঁসগুলোর বিষ্ঠা সার হিসেবে এই বিশাল জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করতে মূল ভূমিকা পালন করছে।
আবার ফেরার পথে, দূরে নদী বাঁকে মনে হলো গাছে গাছে সাদা বিশাল আকৃতির সব ফুল ফুটে আছে। এত বড় কোনো ফুল হতে পারে? সাত-পাঁচ ভেবে কাছে যেতেই টাঙ্গুয়ার আরেকটি জাদুকরী দৃশ্য দেখা গেল- নদীর ধারে দেশ কিছু গাছ আলো করে নানা ধরনের বক ধ্যানে মগ্ন, এগুলো তাদের রাত্রিকালীন আবাস, আহা পুরাণে স্বর্গের বর্ণনা বুঝি এমনটাই হয়!
তাই এতদিন পরও কায়মনোবাক্যে বলি- জীবন যত জায়গায়ই যাই না কেন, যত কিছুই করি না কেন, আমার সবচেয়ে স্মরণীয় ভ্রমণ ২০০২ সালে শীতের টাঙ্গুয়ার হাওড়ে।
লেখক:তারেক অণু