পর্যটন বিচিত্রা প্রতিবেদন
দুর্দমনীয় আকর্ষণ সুন্দরবনের আসল বৈশিষ্ট্য ভয়ংকর সৌন্দর্য। পৃথিবীর আর কোনো ম্যানগ্রোভ বনে বাঘ নেই, সুন্দরবনে আছে। প্রতিবছর লাখো পর্যটক বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন দেখতে যান। বিশেষ করে শীত মৌসুমে এই সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। এই অন্যন্য বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের টেকসই পর্যটন ব্যবস্থাপনা এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
দেশের পর্যটন শিল্প বিকাশের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকলেও নানা প্রতিবন্ধকতায় অনেকটাই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশি বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো যথেষ্ট উপাদান থাকা সত্বেও কেবল প্রচার প্রচারণা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে এই খাতের সঠিক বিকাশ হচ্ছে না।
সুন্দরবনে বিভিন্ন ট্যুর অপারেটর সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের বিভিন্ন স্পটে নির্দিষ্ট স্টপিজ নেই, চলাচলের জন্য কোনো পথ নির্দেশক নেই। এছাড়া পর্যটকরা পর্যাপ্ত গার্ডও পান না। পর্যটকের সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি সুযোগ-সুবিধা বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন। এছাড়া দেশি পর্যটকের তুলনায় বিদেশিদের সুন্দরবন ভ্রমণের ফি অনেক বেশি। এতে তারা ভ্রমণে আগ্রহ হারাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ এবং কার্যকর উদ্যোগ নিলে পর্যটন খাত হিসাবে সুন্দরবন দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়া ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা ও রিসোর্ট বা হোটেল-মোটেল নির্মাণ হলে পর্যটক আরও বাড়বে। সেই সাথে যে তিন মাস (বর্ষাকাল) সুন্দরবন ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তা সরকার উঠিয়ে নিলে ওই সময়েও নিয়মিত ট্যুর পরিচালনা করা যাবে। পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে পারলে সুন্দরবন পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে বলে মনে করছেন পর্যটক বিশেষজ্ঞরা।
বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবন এখন দেশের রাজস্বখাতে গুরুপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সুন্দরবনে পর্যটকদের জন্য এখন সাতটি ইকোপার্ক রয়েছে। গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সুন্দরবনে দর্শনার্থীদের থেকে আয় বেড়েছে। সুন্দরবনকে ঘিরে ইকো-ট্যুরিজমের ব্যবস্থা করা হলে তা থেকে আয়কৃত অর্থ দেশের অর্থনীতির চাকাকে আরও গতিশীল করবে। সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য প্রতিটি জাহাজে ৭৫ জনের বেশি পর্যটক না নেওয়ার বিধিনিষেধ আছে বন বিভাগের। তবে সেই নিয়ম মানছেন না অনেকে। সা¤প্রতিক সময়ে পর্যটনশিল্প সুন্দরবন পর্যন্ত বিকশিত হয়েছে। পর্যটনের মাধ্যমে অনেকের নতুন আয়ের সংস্থানও হয়েছে। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে যে হারে জাহাজ বনে যাতায়াত করছে, তাতে বন আর বনের আবহাওয়ায় থাকে না। বিশেষ করে সার্ভিস লঞ্চগুলো ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ মানুষ বোটে তুলে যাত্রীদের জীবন যেমন বিপদাপন্ন করে তোলে, বনের পরিবেশও তেমনি নষ্ট করে দেয়।
সুন্দরবনে ট্যুর পরিচালনাকারী মালিকরা জানিয়েছেন, সুন্দরবন ভ্রমণে বন বিভাগের যেসব সক্ষমতা থাকা দরকার তা নেই। জনবলের সংকট রয়েছে। পর্যটক ও ট্যুর অপারেটরদের আসা-যাওয়ার তথ্যসংবলিত কোনো সফটওয়্যার নেই।
তবে সুন্দরবন ভ্রমণে ট্যুর অপারেটর, পর্যটক ও বন বিভাগের জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। আপাতত ওই নীতিমালা অনুযায়ী কাজ করা হচ্ছে।
এছাড়া পর্যটকদের জন্য বাড়েনি সুযোগ-সুবিধা। পর্যটকদের জন্য প্রাথমিক ও জরুরি চিকিৎসা, রাতে অবস্থান, বিশুদ্ধ পানি ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনও নিশ্চিত হয়নি। বনের মধ্যে থাকা ওয়াচ টাওয়ার, জেটিগুলোও নাজুক অবস্থায় রয়েছে। বনের অধিকাংশ এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। ফলে সুন্দরবনে প্রবেশের পর পর্যটকদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে হয়।
সুন্দরবনে প্রতি মৌসুমেই সাধারণত দেড় থেকে দুই লাখ দেশি-বিদেশি পর্যটকের আগমন ঘটে। এ থেকে দুই কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব আদায় হয়। দেশের অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হচ্ছে সুন্দরবন। যাকে ঘিরে মানুষের রয়েছে অনেক আগ্রহ। সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগেই মানুষ এখানে আসছে ঘুরতে। পর্যটনের বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে এখানে। তবে এখানে পর্যটন শিল্পের বিকাশে সরকারি উদ্যোগ কম।।
সুন্দরবনে পর্যটকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনও নাজুক। প্রতিটি লঞ্চে মাত্র দুই জন করে বনরক্ষী দেওয়া হয়। বনরক্ষীরা বয়স্ক ও তাদের অস্ত্র চালানোর পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই। পর্যটকদের আবাসনের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাদের লঞ্চ বা বোটের মধ্যে রাত কাটাতে হয়। পর্যটকদের বহনকারী লঞ্চ বেঁধে রাখার মতো ভালো ব্যবস্থা নেই। বন বিভাগের জেটিতে লঞ্চ বাঁধতে দেয় না। ফলে মাঝ নদীতে নোঙর করে রাখতে হয়।
তবে আশার বিষয় হলো- বিদেশি পর্যটক টানতে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন অঞ্চল ঘিরে বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এর আওতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধসহ গোপালগঞ্জ থেকে বাগেরহাট ও খুলনা সুন্দরবন এলাকায় বিশেষ পর্যটন অঞ্চল গড়ে তোলা হবে।
দ্য ওয়েব ক্রুজের মালিক আবুল ফয়সাল মো. সায়েম পর্যটন বিচিত্রাকে বলেন, শীতকালে পর্যটকরা সুন্দরবনে বেশি ভ্রমণে আসেন। এজন্য এই সময়ে পর্যটকদের প্রচুর চাপ থাকে। জুন-জুলাই-আগস্ট- এই তিন মাস ভ্রমণ নিষিদ্ধ। এই সময় মূলত বর্ষাকাল। বাকি সময়গুলোতে ট্যুর পরিচালনা করা হয়। তবে খুব কম। সরকার যদি তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় তবে সারা বছরই ভ্রমণ পরিচালনা করা যাবে।
শীতে প্রচুর পর্যটকের সমাগমের কারণে পরিবেশের ওপর কোনো প্রভাব পড়ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, পর্যটকদের কারণে বর্তমানে সুন্দরবনের পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর কোনো প্রভাব পড়ছে না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আগে ঢাকাসহ বিভিন্ন থেকে জায়গা থেকে স্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে সুন্দরবনে ঘুরতে আসত। মাইকে উচ্চ শব্দে গান বাজত। স্যালো মেশিনের শব্দ হতো। একসঙ্গে ৩০০-৪০০ পর্যটক আসত। এতে পরিবেশের ক্ষতি হতো। কিন্তু এখন সেই সুযোগ নেই। এখন সুন্দরবনে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ভ্রমণ নিষিদ্ধ। একটি জাহাজে ৭৫ জন পর্যটকের বেশি ভ্রমণ করা যায় না। এছাড়া নদীতে কোনো ধরনের ময়লা আবর্জনা, বোতল ফেলা হয় না। জাহাজের মধ্যেই সবকিছু করা হয়।
তিনি আরও বলেন, সুন্দরবনে প্রচুর বিদেশি পর্যটক ভ্রমণ করতে আসেন। বিদেশি নাগরিক হওয়ায় দেশীয় পর্যটকের তুলনায় তাদের গুনতে হয় অনেক বেশি টাকা। এজন্য সুন্দরবনে বিদেশিদের ভ্রমণ ফি কমানোর দাবি জানিয়েছেন আবুল ফয়সাল মো. সায়েম।
তিনি আরও বলেন, তিনদিন সুন্দরবন ভ্রমণে একজন বিদেশি পর্যটকের কাছ থেকে নেওয়া হয় ১১ হাজার টাকা। অপরদিকে দেশীয় পর্যটকের কাছ থেকে নেওয়া মাত্র ১১শ’ টাকা। প্রচুর বিদেশি পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণে আসেন। তারা হয় তো বেশি টাকা দিয়েই ভ্রমণ করছেন। তবে ফির পরিমাণ কমানো হলো তাদের জন্য ভ্রমণ আরও সহজ হবে বলে মনে করেন ওয়েভ ক্রুজের এই মালিক।
সুন্দরবন ভ্রমণকে পরিবেশবান্ধব করার বিষয়ে বেশকিছু মতামত দেন আবুল ফয়সাল মো. সায়েম। তিনি বলেন, জাহাজ থেকে কোনো ধরনের ময়লা আবর্জনা ফেলা যাবে না। ফেললে এ ক্ষেত্রে জরিমানা বিধান চালু করা উচিৎ।
এমভি ভেলার মালিক রফিকুল ইসলাম নাসিম বলেন, আমরা অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত সাধারণত ট্যুর পরিচালনা করি। বাকি সময়গুলো নিয়মিত ট্যুর করা হয় না। বর্ষকালে নিষেধাজ্ঞা থাকায় ট্যুর পরিচালনা করা হয় না। তবে বর্ষায় সুন্দরবনের অন্যরকম সৌন্দর্য থাকে। এই সময় ভ্রমণ পরিচালনা করতে পারলে অনেক ভালো হতো।
তিনি বলেন, সুন্দরবন ভ্রমণে বিদেশিদের জন্য অনেক ব্যয়বহুল। এছাড়া অপরিকল্পিত ভ্রমণ ব্যবস্থাপনার কারণে বিদেশি পর্যটকদের আগ্রহ অনেক কমে গেছে।
দেশের পর্যটন শিল্পের শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্য সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সদস্য রফিকুল ইসলাম নাসিম বলেন, আমরা শুরু থেকেই পরিবেশবান্ধব ভ্রমণ পরিচালনার চেষ্টা করছি। তবে সুন্দরবনকে যেন পিককি স্পটে পরিণত করা না হয়। যেমন- লঞ্চ ভরে আসলাম, ডিজে পার্টি করে আবার চলে গেলাম। সুন্দরবন ভ্রমণের জায়গা, গবেষণার জায়গা, এটা যেন গণস্পটে পরিণত না হয়।
ট্যুর পরিচালনায় কাঠামোগত সমস্যার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সিগন্যাল বাতি না থাকায় রাতে লঞ্চ চলাচলে সমস্যা হয়। জাহাজ নোঙর করার জায়গা নাই, পন্টুন নাই। পর্যাপ্ত জনবল নাই, ফরেস্ট গার্ড নাই।
নাসিম মনে করেন, সুন্দরবন ভ্রমণ পরিচালনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা দরকার। কারণ সুন্দরবনকে কক্সবাজারের মতো বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। এটা যেন না হয়। বিদেশিদের যাতে আরও সুন্দরবন ভ্রমণে আগ্রহ জন্মায় সেজন্য ট্যুর পরিচালনায় আরও সুন্দর ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।
পর্যটন বিশেষজ্ঞ মহিউদ্দিন হেলাল বলেন, প্রতিবছর লাখো পর্যটক সুন্দরবন দেখতে যান। এই অন্যন্য বিশ^ ঐতিহ্য সুন্দরবনের টেকসই পর্যটন ব্যবস্থাপনা এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
তিনি বলেন, সুন্দরবনে শীতকালে পর্যটকদের প্রচুর চাপ থাকে। শীত ছাড়া বছরের অন্য সময় বিশেষ করে বর্ষায় ভ্রমণ পরিচালনার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিবেচনায় নিতে পারে। তবে পরিবেশের ওপর যেন প্রভাব না পড়ে। বিদেশিদের সুন্দরবন ভ্রমণে অতিরিক্ত ফি’র বিষয়টি বিবেচনার আহ্নব্বান জানান তিনি।