মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়া সফরে সর্বকনিষ্ঠ সদস্য দ্রাবিড়ের বয়স সাড়ে চার আর বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য বিশ্বজিৎ ভাদুড়ী দাদার বয়স ৫৪। সহকর্মী রুহুল ভাইকে দেশে রেখেই আমরা পাড়ি দিই মালয়েশিয়া। উড়াল জাহাজের টিকিট কিনেও অফিসের কাজের জন্য রুহুল ভাইয়ের আর শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়নি।
ভ্রমণ সূচিতে স্থির হলো- ৩১ ডিসেম্বর বালিতে থাকা। ইন্দোনেশিয়ার কুটা বিচের বিখ্যাত আতশবাজির আনন্দ কোনোভাবে বঞ্চিত হতে চাইনি। পৃথিবীর বৃহত্তম দ্বীপের দেশগুলোর অন্যতম ইন্দোনেশিয়া। বালি, ইন্দোনেশিয়ার তেমনি একটি স্বতন্ত্র দ্বীপ রাজ্য। ১৩ হাজারের বেশি দ্বীপপুঞ্জ সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য আর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে অনন্য এই দেশটি। সবচেয়ে বড় ফুল র্যাফলেশিয়া অ্যারনোল্ডো আর গ্রেটার বার্ডস অব প্যারাডাইসের জন্য বিখ্যাত।
গ্রিক ভাষায় ইন্দোস আর নেসস থেকে উৎপত্তি ইন্দোনেশিয়া; যার অর্থ ইন্ডিয়ান আইল্যান্ড। প্যাসিফিক রিং অব ফায়ার- এ অবস্থিত দেশটির মাটি ভূ-গাঠনিকভাবে খুব অস্থির। ৪০০টি আগ্নেয়গিরি রয়েছে ইন্দোনেশিয়ায়। এর মধ্যে ১৩০টিই সক্রিয়। গত কয়েক বছরে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ আর সুনামির কারণে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এই দেশটি বার বার সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি ঘটেছে বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক বেশি। বছরে দুটি ঋতু দেখা যায় বর্ষা ও শুষ্ক। বিষুব রেখা বরাবর অবস্থিত দেশটির তাপমাত্রা খুব বেশি উষ্ণ বা শীতল নয়। ৩৪টি প্রদেশ রয়েছে ইন্দোনেশিয়ায়। এর মধ্যে জাভা, বালি এবং লুম্বক আয়তনের দিক থেকে বড়।
বালিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রবাল দ্বীপ- নুসা পেনিডা, নুসা লেম্বানগান, নুসা কেনিঙ্গন ইত্যাদি। পাশেই রয়েছে লুম্বক প্রদেশের বিখ্যাত আরও কিছু দ্বীপ। এসব দ্বীপের প্রত্যেকটির স্বতন্ত্র সংস্কৃতি আর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। দিনে-রাতে কমপক্ষে তিনবার এসব প্রবাল দ্বীপের সৌন্দর্য আর বৈশিষ্ট্য বদলে যায়। সূর্যোদয় আর রাতের আলো-আঁধারের নিরবতায় দ্বীপ রাজ্য যেন সৌন্দর্যের ভিন্ন পসরায় নিজেকে সাজায়। বালি ভ্রমণে অধিকাংশ পর্যটকই ভ্রমণের তালিকায় দ্বীপ- নুসা লেম্বানগান, নুসা পেনিডা এবং গিলি ট্রায়নগানকে অন্তর্ভুক্ত করে।
আমাদেরও সাতদিনের বালি পর্বের ভ্রমণ সূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল- কুটা আর উবুদের বিভিন্ন দর্শনীয় মন্দির- তানাহলট, ঊলুয়াতু, নুসা দুয়া সমুদ্র সৈকত, ড্রিম বিচ, পাদাংপাদাং সিক্রেট সমুদ্র সৈকত, জিমবারান বিচে সামুদ্রিক মাছে ক্যান্ডেল ডিনার, থার্টিফার্স্ট নাইটে কুটা বিচের আতশবাজি, উবুদের রাইস ট্রেরেস, আর্ট গ্যালারি, কফি প্ল্যানটেশন, ট্রারাঙ্গান জলপ্রপাত, জীবন্ত আগ্নেয়গিরি- কিন্তামানি, মাংকি ফরেস্ট, বার্ড জু ইত্যাদি। দ্বীপের তালিকায় রেখেছিলাম নুসা লেম্বানগান, নুসা কেনিঙ্গন, নুসা পেনিডা এবং গিলি ট্রায়নগানকে।
ভ্রমণের শুরুতে খুব উত্তেজনায় ছিলাম বালির কোরাল দ্বীপ ভ্রমণ এবং পানির নিচের বিভিন্ন এক্টিভিটিস নিয়ে। স্কুবা ড্রাইভিং জন্য বালি এবং লুম্বকের গিলির দ্বীপ খুব বিখ্যাত। পানির রাজ্যে জীববৈচিত্র্য অসাধারণ বর্ণিল ও অন্য রকম বিস্ময়কর।
ভ্রমণের ষষ্ঠ দিনে আমরা রওনা দিই নুসা লেম্বানগান থেকে নুসা পেনিডায়। বিখ্যাত ডাইনোসর বিচ বা কেলিংকিং বিচ নুসা পেনিডা দ্বীপের অন্যতম আকর্ষণ। নীলাভ-সবুজ পানি, সোনালি ঝকঝকে রোদ আর মাখন রঙের সাদা সৈকতে ডাইনোসর আকৃতির বিচটি বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র ও অনন্য।
নুসা লেম্বানগানে আসতে হয় কুটার সেনোর বিচ থেকে বোটে। সৈকতের একেবারে কিনারায় অবস্থিত স্বপ্নের মতো সুন্দর একটি রিসোর্ট নুসা লেম্বানগানের মহাগিরি। প্রবাল দ্বীপে মহাগিরির সুইমিং পুলের পাশে কাঁচের মতো স্বচ্ছ নীল জলের পাশে রঙ বেরঙের আলোতে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে আমাদের আনন্দ আয়োজন। ভ্রমণসঙ্গীদের ঘুমের মধ্যে রেখেই খুব ভোরে আমি আর সূর্য একটা মোটরবাইক নিয়ে রওনা হই নুসা পেনিডার উদ্দেশে। সেদিন ছিল বালিতে ‘গালুনগন’ উৎসব। প্রতি ছয়মাস পর পূর্ণিমা তিথিতে ‘গালুনগন’ উৎসব পালিত হয়। দ্বীপের অধিবাসীরা রঙ বেরঙের বিভিন্ন পোশাক পরে মাথায় পূজার নৈবদ্য নিয়ে ভিড় করে বিভিন্ন মন্দিরে। বছর কয়েক ধরে এই দ্বীপটি অন্যরকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে পর্যটকদের কাছে পরিচিতি পেয়েছে। মোটরবাইকে ৪৫ মিনিট যাওয়ার পর ইয়েলো ব্রিজের নিচে টিকিট কাউন্টারের পাশে বাইক পার্ক করে রেখে খুঁজতে থাকি স্পিডবোটের টিকিট কাউন্টার। লাল রঙের এক লাখ মিলিয়ন রুপাইয়া দিয়ে টিকিট কিনি; যা বাংলাদেশের টাকায় মূল্যমান ৬শ’। মোটরবাইকের নম্বরসহ একটা ফটো তুলে রাখি। যেন ফিরতি পথে অসংখ্য কালো বাইকের রাজ্য থেকে নিজেদের বাইকটা খুঁজে পাই। রওনা করি স্পিডবোটে। সবুজ রঙের পানির বুক চিরে রাজহংসীর মতো। আধা ঘণ্টার পানিপথ পাড়ি শেষে পেলোবন হারবারে নেমে পড়ি। পুনরায় আরেকটি বাইক ভাড়া নিই ভরপেট পেট্রোলসহ সত্তর হাজার রুপাইয়ার বিনিময়ে। অগ্রিম টাকা শোধ করে রওনা দেয়ার পূর্বে মোটরবাইকের মালিক জানালেন ফেরার পর তাকে না পেলে আমাদের অপেক্ষার প্রয়োজন নেই। চাবি মোটরসাইকেলে রেখে চলে গেলেই হবে। সেখানে নাকি এরকমই রেওয়াজ। একথা শুনে মনে মনে তুলনা করলাম আমাদের দেশের চালচিত্রের সঙ্গে।
আমরা চলছি, পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথ বেয়ে। কিছু দূর পর আবার পিচঢালা রাস্তা, অনেকটা আমাদের দেশের রাঙামাটি যাওয়ার রাস্তার মতোই। পথে অনেক বিদেশি ও বিদেশিনিকে দেখলাম স্কুটি ও বাইক চালাচ্ছে। স্মার্টফোনে জিপিএস দেখে দেখে পথ চলছে। মাঝে মধ্যে রাস্তা ভুল করে স্থানীয় পথচারীদের জিজ্ঞেস করে আবার সঠিক পথের সন্ধান করছি। প্রায় ঘণ্টাখানেক মোটরবাইকে চলার পর রাস্তা ভুলে সামনের রাস্তায় চলে যাই। পুনরায় তীর চিহ্নিত সঠিক পথের সন্ধান খুঁজি। কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তা কোথাও কোথাও বেশ ভাঙা। স্থানীয় মানুষজন খুবই সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবের। পাহাড়ি রাস্তায় যদি বাইক চালানোর পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকে তবে অ্যাডভেঞ্চারে না আসাই নিরাপদ। প্রায় দেড় ঘণ্টা টানা গাড়িতে চড়ার পর দেখা মেললো ডাইনোসর বিচ বা কেলিংকিং বিচের পার্কিং এলাকার। নুসা পেনিডার অন্যতম আকর্ষণীয় সৈকতে প্রবেশের জন্য টিকিট কিনতে হয় ৫০ হাজার রুপাইয়ার বিনিময়ে। মোটরবাইক রেখে অন্য পর্যটকদের অনুসরণ করে কিছু দূর যাওয়ার পরই ভারত মহাসাগরের এক অনন্য সৌন্দর্যের সামনে দাঁড়াই।
সবুজ গাছপালা পেরিয়ে সাদা সৈকতের পর দিগন্তজোড়া স্বচ্ছ নীলাভ সবুজ রঙের সমুদ্র। অনেক পর্যটক এখানে উপরিভাগের সৌন্দর্য দেখে চলে আসেন। বালি ভ্রমণের প্রথম থেকেই আমার অনেক ইচ্ছা ছিল ডাইনোসর বিচের সিক্রেট পয়েন্ট দেখা। উপরিভাগ থেকে ডাইনোসর বিচের সৌন্দর্য দেখে নিজেদেরকে আর বিরত রাখতে পারিনি।
সেদিন নুসা পেনিডায় কেলিংকিং বিচের উপরিভাগে ছিল পর্যটকের জটলা। স্মার্টফোন আর ক্যামেরায় বিভিন্নভাবে ছবি তুলে স্মৃতিতে রেখে দিচ্ছে রহস্যময় সৈকতটিকে। সারা গায়ে উল্কি আঁকা ব্রাজিলের এক বিখ্যাত মডেলের ফটোশুট চোখে পড়লো। পায়ে হেঁটে নিচে নামার সময় কেউ বলছে ৪০-৫০ মিনিট কেউ বা বলছে আরও কিছু বেশি সময় লাগবে। বার বার আমি সূর্যের মুখের দিকে তাকিয়ে পাড়ি দিই দুর্গম পথ। এক পর্যায়ে নিজেকেই সান্ত¡না দেয়ার সুরে বলতে থাকি- ‘ভয়ের কি আছে? আমাদের তো একদিনে ১৪ ঘণ্টা পাহাড়ে হাঁটার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ আর এমনকি!’
পাহাড় আর সমুদ্রের দুর্গম প্রকৃতির বন্য সৌন্দর্যের বিমুগ্ধতা পৌঁছে যায় মনের গভীরে। প্রায় দেড় যুগ পূর্বে হিমালয়ের শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার সাথে প্রথম দেখা দার্জিলিংয়ে। এক দুনির্বার আকর্ষণ আর রহস্যের চাঁদও যেন খুঁজে পাই হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘায়। সেই বছরই আমাদের প্রথম ট্রেকিংয়ের অভিজ্ঞতা হয়। রুদ্রপ্রয়াগ থেকে মন্দাকিনীর কিনার ধরে ধরে পৌঁছে গিয়েছিলাম উত্তরাঞ্চলের চার ধামের অন্যতম হিমালয়ের শৃঙ্গে- তীর্থ কেদারনাথে। গৌরীকুÐ থেকে চড়াই উৎড়াই পথে ২৮ কিলোমিটার পায়ে হাঁটার পথ। সেবার হিমালয়ের শ্বেত শুভ্র শৈবতীর্থ কেদারনাথ শৃঙ্গকে দেখেছিলাম হাতের নাগালের দূরত্ব থেকে।
এভাবে কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই সিক্রেট বিচের জন্য রওনা হলাম। পাহাড় বেয়ে কিছুদূর নিচে নামার পর গাছপালার মাঝখান দিয়ে ডাইনোসর বিচে যাওয়ার জন্য পথ পেয়ে যাই। কিছু পথ অতিক্রম করে দেখতে দেখতে ডাইনোসরের মাথার দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। প্রথমে একটু সহজই মনে হয়। কিন্তু দ্বিতীয় ধাপে যাওয়ার পরই আসল রহস্যের শুরু হয়। খুবই সরু পাহাড়ি পথ। কোথাও মাটি কোথাওবা অসমতল পাথর। মাঝে মধ্যে দুপাশ একদম ফাঁকা। শুধু কিছু চিকন কাঠের লাঠি ও বাঁশ দিয়ে সিঁড়ির হাতলের মতো করে বানানো। কোথাও বেশ সরু পথটি। কোনো রকমে দুজন একসাথে যাওয়া যায়। বিভিন্ন উচ্চতার এলেবেলে সিঁড়ি। মনে হলো ভুটানে টাইগার নেস্টে যাওয়ার সময় ওপরে উঠে ১৩শ’ সিড়ি অতিক্রম করেছিলাম কিন্তু এবারের অভিজ্ঞতা একেবারে ভিন্ন। সরু কাঠ আর বাঁশ ধরেই সবাইকে নিচে নামতে হয়েছিল, পাথরের খাঁজে খাঁজে কোথাও একটু প্রশস্ত পথ কোথাওবা পথে থেমে অন্যকে যাওয়ার রাস্তা দিতে হয়। একসাথে ২-৩ জন উঠানামা করা যায় না। ট্রেকিংয়ের সময় সাথে করে খাওয়ার স্যালাইন, পানি নিয়ে যেতে হয়। কোরাল, পাথর, বালি আর বাতাসে আর্দ্রতার জন্য প্রচুর ঘাম হয়। শরীর থেকে লবণ বের হয়ে রক্তের চাপ কমে যায়। আবহাওয়া আর্দ্র থাকলেও দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থেকে যায়। নিচে নামার পথ অনেক খাড়া, পা একটু পিছলে গেলেই ঘটে যেতে পারে বিপত্তি। মিনিট বিশেক পর প্রচÐ গরম আর তাপে এক সময় মনে হয় শরীর থেকে বৃষ্টির মতো পানি ঝরছে। নিচে নামতে গিয়ে শরীরের ক্লান্তি আর অবসাদে আতঙ্কিত হয়। ভাবি, আবারও একই পথে ফিরতে হবে।
ডাইনোসর বিচের সামনের তিন দিকের সৌন্দর্য যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। নীল স্বচ্ছ পানিতে জোয়ারের সময় সিক্রেট পথটি ডুবে যায়। পানিতে ভরে যায় ডাইনোসরের নিচের দিকের গোপন সুড়ঙ্গটি। তৃষিত মুগ্ধ নয়নে চারপাশের সবুজ আর নীলের জলরাশি দেখি। একই সাথে দেখছিলাম প্রকৃতি আর ওপরের নীল আকাশকে। প্রচন্ড তাপদাহে আর ঝকঝকে রোদে ক্যামেরায় কিছুই দেখতে পাইনি। পানিতে হেঁটে হেঁটে কিছু দূর গিয়ে একদম সামনে থেকে সাগরের ঢেউয়ের খেলা দেখে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ফেরার জন্য। আমাদের হাতে সময় সীমিত, সেল ফোনে নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না। মনে মনে অনুভব করছিলাম নুসা লেম্বানগানে থাকা ভ্রমণসঙ্গীরা আমাদের জন্য দুশ্চিন্তায় আছে। তাছাড়া কুটায় ফেরার আমাদের ফার্স্ট বোট ছেড়ে যাবে বিকাল সাড়ে ৪টায়। ঘড়িতে যখন বেলা সাড়ে ১১টা তখন আর দেরি না করে সিক্রেট বিচ থেকে মই ধরে উপরে উঠতে শুরু করি। ডাইনোসরের মাথায় উঠে ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর মধ্যাকর্ষণ বলের বিপরীত দিকে ঠেলে এগোতে থাকি গন্তব্যে। অতিরিক্ত ঘামের কারণে শরীরে কোনো শক্তিই যেন অবশিষ্ট নেই। মুখের ভেতরে একটা কাঁচা আমের ললিপপ পুরে রেখেছিলাম যেন গলা শুকিয়ে না যায়। তবুও অতিরিক্ত ঘামে আর গরমে গলা শুকিয়ে যেন কাঠ।
আবার পথ চলতে শুর করি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাইনোসর সিক্রেট বিচের নীলাভ-সবুজ পানি আমাদের সামনে দৃশ্যমান হয়। এই পথ পারি দিতে আমাদের ৪০ মিনিট সময় লাগে। বিচে নামার একদম শেষ পর্যায়ে পর্যটকদের সুবিধার জন্য একটা মই লাগানো আছে, সেই মই বেয়ে আমরা কেলিংকিং সিক্রেট বিচে পা রাখি।
বিচের এক পাশে কয়েকটা গাছ রয়েছে। অনেক পর্যটক সেখানে বসে বিশ্রাম নেন। তেমন মানুষ নেই, সবেমোট ১২-১৫ জন হবে। ছায়াঘেরা গাছের এক পাশে কিছু স্থানীয় মানুষ কোমল পানীয় ও পাহাড়ি ফলের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। আমাদের হাতে সময় খুব বেশি নেই। ছায়াঘেরা গাছের নিচে মিনিট দশেক বিশ্রাম নিলাম।
চারপাশের মনোরম পরিবেশের সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনাতীত। দুপাশ ঘিরে বিশাল উঁচু পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে সবুজ গাছপালা আর নীল আকাশ আর নীলাভ সমুদ্রের জলরাশির মিলেমিশে একাকার। হঠাৎ ঘড়ির দিকে নজর গেল। দুুপুর প্রায় ১২টা, বিদায় ঘণ্টা বেজে গেছে। আমাদেরকে যেতে হবে, নুসা পেনিডা থেকে লেম্বানগানে। অন্যথায় বালিতে ফিরে যাওয়ার ফার্স্ট বোট আমাদের রেখেই চলে যাবে সানুরে।
আর দেরি না করে তৎক্ষণাৎ রওনা হয়ে যাই। এবার আমাদেরকে অভিকর্ষ বল ভেদ করে উপরের দিকে বেয়ে উঠতে হবে। হাতের ওপর ভর দিয়ে দিয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। উঁচু-নিচু সিড়ি, প্রায় ৪০ মিনিট পাহাড়ি পথ বেয়ে গন্তব্যের প্রায় ৯০ শতাংশ অতিক্রম করার পরই ঘটলো বিপত্তি। অতিরিক্ত ঘামে রক্তচাপ কমে যাওয়ায় চোখ অন্ধকার হয়ে যায়। সিঁড়ির একপাশে বসে জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বাতাস থেকে অক্সিজেন নিই। সূর্যের কথা মতো মাথা কিছুক্ষণ নিচে দিকে ঝুঁকে অপেক্ষা করছিলাম। ক্রমেই দৃষ্টিসীমা ঝাপসা থেকে স্পষ্ট হয়ে আসে। আবারো পথ চলতে শুরু করে ১০ মিনিটের মধ্যে উপরের উঠে আসি। লবণের অভাব পূরণের জন্যে ডাউস সাইজের দুটো ডাব খেয়ে নিলাম। বরফ ঠান্ডা পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে রেস্তোরাঁ থেকে হালকা কিছু খেয়ে নিই শক্তি সঞ্চয়ের জন্য। রেস্তোরাঁর পাশেই ছিল একটা কালো জামের গাছ। হাতের নাগাল থেকে কয়েকটা জাম পেড়ে মুখে দিতেই মিষ্টি স্বাদের রসে মুখ ভরে যায়। রেস্তোরাঁয় কথা বলে আরও কিছু জাম পেড়ে নিই নুসা লেম্বানগানে থাকা আমাদের ভোর আর সফরসঙ্গীদের জন্য। ক্যালরি বাড়ানোর জন্য পথে মধ্যে আবারো একটি রেস্তোরাঁয় নাসি গোরেং আর কিচেন সাটো দিয়ে আগে ভাগেই মধ্যাহ্নভোজ সেরে নিই একটু আগে ভাগেই।
মার্জিয়া লিপি
লেখক: গবেষক ও পরিবেশবিদ।