পর্যটন বিচিত্রা ডেস্ক
যদি আপনি প্রকৃতির অফুরন্ত সৌন্দর্য উপভোগ করতে চান তাহলে কাশ্মীর আপনার জন্য আদর্শ স্থান। সেখানে অভিবাদন জানাবে তুষারাবৃত পর্বত চূড়া, ছবির মতো উপত্যকা, নির্মল হ্রদ, বিশাল বৃক্ষ এবং দোদুল্যমান পুষ্প। ট্র্যাকিং, ভেলা ও ডিঙি নৌকায় চড়ার মত দুঃসাহসিক কাজগুলো করারও সুযোগ আছে।
কাশ্মীর ভ্রমণকারী বিদেশি পর্যটকদের তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন বাংলাদেশিরা। ভারতনিয়ন্ত্রিত অঞ্চলটিতে সবচেয়ে বেশি পর্যটক যায় মালয়েশিয়া থেকে। এর পরই রয়েছেন থাইল্যান্ডবাসী।
কাশ্মীরের দর্শনীয় স্থান
কাশ্মীরের পুরো শহরটাই যেন স্বর্গরাজ্য, দিগন্তজোড়া উঁচু উঁচু পাহাড়ের মাঝে দেখা মিলবে সাদা বরফের খেলা। শহরের ভেতরে রয়েছে দেখার মতো নানা জায়গা। শহরের বাইরে অপেক্ষা করছে আরেক সৌন্দর্য। কাশ্মীরের ইয়োশমার্গ, সোনালগাহ, গুলমার্গ কিংবা পহেলগাম ভ্রমণ স্বপ্নের চেয়েও কম নয়।
শ্রীনগর: এটি ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী। এটি ঝিলম নদীর তীরে অবস্থিত। শ্রীনগরে প্রথমেই চোখে পড়বে পাহাড়ের চূড়ায় বরফের মতো সাদা তুষার কনা। এখানে আছে মোঘল গার্ডেন, টিউলিপ গার্ডেন, হযরত বাল মসজিদ, ডাল লেক ও নাগিন লেক।
এর মধ্যে শ্রীনগরের জনপ্রিয় পর্যটন স্থান হচ্ছে ডাল লেক। এই লেকে হাউসবোটে থাকার অভিজ্ঞতা আপনাকে মুগ্ধ করবে। সেই সঙ্গে শিকারায় ভেসে শপিং করতে ভুলবে না। শ্রীনগরের এই ভাসমান বাজার সত্যিই আপনাকে তাক লাগিয়ে দেবে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে শিকারায় কেনাকাটা তো করবেনই, সেই সঙ্গে ছবি তোলাও মিস করবেন না।
এছাড়া শ্রীনগর ট্র্যাকিং, পাখি দর্শন, নৌকা চড়া এবং ওয়াটার স্কিইংয়ের জন্য সুপরিচিত।
গুলমার্গ: কাশ্মীরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হচ্ছে গুলমার্গ। শ্রীনগর থেকে মাত্র ৫২ কিলোটিার দূরে সবুজ ঘাসে বিস্তৃত গুলমার্গ সারা বছরই বরফে ঢাকা থাকে। এখানে আছে পৃথিবীর সবচাইতে উঁচু গলফ কোর্স যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৪০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত।
এটিকে স্কিয়ারদের স্বর্গ বলা হয়। মধ্য ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এখানে স্কিইং করা যায়। এছাড়া এখানে গন্ডোলা ক্যাবল কারে চড়তে পারেবন। আর দেখতে পাবেন বাবা ঋষির মাজার, আফারওয়াত পিক, সেন্ট ম্যারি চার্চ।
পেহেলগাম: শ্রীনগর থেকে ৯৭ কিলোমিটার দূরে পেহেলগাম অবস্থিত। ট্যাক্সিতে করে যাওয়া যায়। এখানে দেখার মতো অনেক কিছু আছে। লিদার নদী, বেতাব ভ্যালি, চান্দেরওয়ারি, আরু ভ্যালি, ধাবিয়ান, কাশ্মীর ভ্যালি পয়েন্ট, কানিমার্গ ইত্যাদি।
আপনি যদি মাছ ধরতে ভালোবাসেন, তাহলে লিদার নদীতে ট্রাউট মাছ ধরতে পারেন। এখানকার স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ পানিতে সেরা ট্রাউট মাছ পাওয়া যায়। বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক পর্যটক এখানে ট্রাউট মাছ ধরতে আসেন।
এখানকার বাইসারান মিনি সুইজারল্যান্ড হিসেবে পরিচিত। জুলাই থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি গেলে দেখা মিলবে আপেল বাগান। ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ পাবেন পেগেলহাম ভিউ পয়েন্টে।
তবে পেহেলগামে গেলে চিজ গ্রাম দেখে আসতে ভুলবেন না। স্থানীয় ভাষায় এই বিশেষ ধরনের চিজকে বলা হয় কালারি। গোটা ভারতে এর থেকে ভালো চিজ আর কোথাও পাবেন না। তবে কাশ্মীরের এই চিজ গ্রাম এখনো সেভাবে পর্যটকদের কাছে পরিচিত নয়।
সোনামার্গ: শ্রীনগর থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সোনামার্গে উপত্যকা ও ঝর্নার দেখা মিলবে । এখানে আছে থাজিয়ান হিমবাহ। এছাড়া দেখা মিলবে সিন্ধু নদীর। রয়েছে স্নো বাইক ও ঘোড়ায় চড়ার সুযোগ।
তবে কাশ্মীরে গেলে সেভেন লেক ট্র্যাকিং মিস করবেন না। সোনামার্গ থেকে শুরু হয় এই ট্র্যাকিং। পুরো সেভেন লেক ট্র্যাকিং শেষ করতে আট দিন সময় লাগে। হিমালয়ের অসাধারণ দৃশ্য আপনি প্রত্যক্ষ করতে পারবেন এই ট্র্যাকিংয়ের পথে। এই অভিজ্ঞতা আপনি কোনো দিন ভুলতে পারবেন না। তবে সঙ্গে ট্র্যাকিং জুতা নিতে হবে।
গুরেজ উপত্যকা: শ্রীনগর থেকে ১৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গুরেজ ভ্যালি। এই প্রান্তিক এলাকায় এখনো সেভাবে পর্যটকদের ভিড় হয় না। আপনি যদি নিরিবিলিতে অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে কয়েকটা দিন কাটাতে চান, তাহলে গুরেজ উপত্যকা অবশ্যই ঘুরে আসতে পারেন। কিষাণগঙ্গা নদীর ধারে এখানে ছোট ছোট কয়েকটি গ্রাম আপনাকে মুগ্ধ করবে।
এছাড়া কাশ্মীরে কিছু জায়গা রয়েছে শহর থেকে একটু দূরে। অনেকের কাছে জায়গাগুলো অজানা, তবে ভালো লাগার মতো। যেমন: মার্তু মন্দির। এটি শ্রীনগর থেকে ৬৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ছোট্ট শহর ককেরনাগে রয়েছে মাছ ধরার ব্যবস্থা। ছটপলে রয়েছে আছে কাঠবাদাম ও আপেল বাগানের সমাহার। আরও ঘুরে আসতে পারেন নুব্রা উপত্যকা ও দুধপতরির মতো জায়গায়।
কাশ্মীর ভ্রমণের সময়
কাশ্মীরের রূপ দেখতে হলে আপনাকে আসতে হবে কমপক্ষে তিনবার- বরফ, ফল ও ফুলের মৌসুমে। কাশ্মীর উপত্যকায় শীত, বসন্ত গ্রীষ্ম ও শরৎ- এই চারটি ঋতুই উপভোগ করার মতো। চারটি ঋতু থাকলেও প্রধানত দুটি ঋতুই দীর্ঘ মেয়াদী। তাহলো শীত ও গ্রীষ্মকাল।
বাংলাদেশের শীতকাল হিসেবে ইংরেজি বছরের ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস। এই সময় কাশ্মীরে চারিদিকে শুধু বরফ আর বরফ, সাথে স্নোফল। এই সময় গেলে চারপাশের এক নয়নাভিরাম দৃশ্য চোখে পড়বে। তবে বরফ দেখতে হলে যেতে হবে স্নোফলের পর শীতকালের শেষে।
এপ্রিল থেকে মে, এই সময়ে কাশ্মীর বেড়াতে যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময়। এই সময় ফুলে ভরা থাকে চারদিক, বিশেষ করে টিউলিপ ফুল ও স্বর্গীয় সৌন্দর্য চেরি ফুল।
টিউলিপ স্বল্প মেয়াদী যা ২০-২৫ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। ১ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত টিউলিপ গার্ডেন খোলা থাকে। এপ্রিলের শেষে সম্পূর্ণ ফুটন্ত টিউলিপ দেখতে পাওয়া যায়। এপ্রিল ও মে মাসে সাদা সাদা চেরি ফুলও ফোটে। এই ফুল দেখে শুধু মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকবেন।
বাংলাদেশের শরৎকাল হিসেবে সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরের সময়টাতে বরফ কিছুটা কম থাকে। তবে নানা ধরনের ফল পাওয়া যায় এই সময়ে, বিশেষ করে আপেল আর চীনা বাদাম।
১৫ অক্টোবর থেকে ১৫ নভেম্বরে কাশ্মীর উপত্যকায় মাঠে মাঠে ছেয়ে যায় বেগুনি রঙের জাফরান ফুল। জাফরান ফুলের লাল পাঁপড়ি থেকে তৈরি হয় জাফরান। একে বাণিজ্যিকভাবে রেড গোল্ড বলা হয়। উন্নত জাতের জাফরান স্পেন, ইরান ও ভারতের কাশ্মীরে উৎপাদিত হয়। আর ঐতিহ্যপূর্ণ চিনার গাছের পাতার আগুন আপনার মনে ফাগুন ধরিয়ে দিতে যথেষ্ট।
কীভাবে যাবেন কাশ্মীর
কাশ্মীর যেতে পারেন প্লেনে, ট্রেনে বা বাসে। বিমানে যাওয়ার ক্ষেত্রে ঢাকা থেকে প্রথমে দিল্লি যেতে হবে, তারপর সেখান থেকে শ্রীনগর। সেখান থেকে গাড়িতে করে কাশ্মীর।
ট্রেনে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথমে ঢাকা থেকে মৈত্রী এক্সপ্রেসে করে কলকাতা যেতে হবে। কলকাত থেকে ৩৫-৩৬ ঘণ্টা জার্নি করে ‘জম্বু’ যেতে হবে। জম্বু যাওয়ার জন্য ট্রেন আছে। কলকাতার হাওড়া থেকে জম্বুর উদ্দেশে ছেড়ে যায় ট্রেন। জম্বু থেকে ৮-১০ ঘণ্টার সফর শেষে শ্রীনগর যেতে হবে। সেখান থেকে গাড়িতে করে পৌঁছে যাবেন কাশ্মীর।
আর বাসে প্রথমে গ্রিনলাইন, সোহাগ বা শ্যামলি পরিবহণে কলকাতা থেকে জম্বু গিয়ে সেখান থেকে শ্রীনগওে পৌঁছে গাড়িতে করে কাশ্মীরে যেতে হবে। কলকাতা থেকে জম্বু অথবা শ্রীনগরে ডোমেস্টিক বিমানেও যেতে পারেন।