লেখকঃ মনিরুল ইসলাম – হেড অব ফাইনান্স, আসগর আলী হাসপাতাল
পটুয়াখালীর সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কোলে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য নিয়ে জেগে আছে সোনার চর। বুড়াগৌরাঙ্গ নদের মোহনায় বঙ্গোপসাগরে দ্বীপটির অবস্থান। মোট আয়তন মাত্র ১০ বর্গ কিলোমিটার। সোনার চর পূর্ব-পশ্চিমে চার কিলোমিটার। সমুদ্র সৈকতটি পূর্ব-পশ্চিম হওয়াতে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়।
আমাদের লঞ্চের নামটি বেশ কাব্যিক ‘এমভি আসা-যাওয়া’। আরও কাব্যিক হয়ে উঠলো যখন সে রাজনকে রেখেই গলাচিপার উদ্দেশে যাত্রা করলো। ঢাকা শহরের চিরচেনা যানজট চলতি পথের মানুষকে স্থবির করে রাখলেও সময়কে ধরে রাখার সাধ্যি তার নেই। ফলাফল রাজন লঞ্চ ধরতে ব্যর্থ হলো।
গলাচিপা পৌঁছে স্পিডবোট ধরে চর মোন্তাজ যেতে হবে। স্পিডবোট পেতে হলে যেতে হবে সেই বোয়ালিয়া অথবা পানপট্টি ঘাট। বোয়ালিয়া যাওয়ার রাস্তা সম্পর্কে আগে থেকে কোনো ধারণা ছিল না, থাকলে যেতাম কিনা সন্দেহ আছে। রাস্তা বলতে আসলে কিছু অবশিষ্ট নেই। অল্প কিছু ইট আছে, অধিকাংশই উঠে গিয়ে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে, দু’একটা যা আছে তাও বুড়ো মানুষের দাঁতের মতো নড়বড়ে। কোনোভাবেই স্থির হয়ে বসা যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে মাথায় আঘাত পেয়েছি। ঝালমুড়ির মতো ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে যখন আমাদেরকে বোয়ালিয়া নামালো, তখন দেখি ঘাটে কোনো স্পিডবোট নেই। আগামীকাল এসব এলাকায় নির্বাচন, তাই গণপরিবহণ চলাচল বন্ধ। ভাগ্যিস, আতিক সাহেব আগেই ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন, না হলে এবারের মতো ওইখান থেকেই ফেরত আসতে হতো।
তেঁতুলিয়া নদীর কুলরেখাবিহীন জলরাশি কেটে ছুটে চললো আমাদের স্পিডবোট। বড় বড় ঢেউয়ের কবলে পড়ে একবার ওপরে উঠছে তো আরেকবার নিচে নামছে। ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর হলেও বেশ উপভোগ্য ছিল। ঢেউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে যখন চর মোন্তাজ পৌঁছালাম তখন দুপুর হেলে পড়ছে। তোফাজ্জল ভাইকে ফোন দিয়ে ঘাটে আসতে বললাম।
গেট থেকে আমাদের জাহাজ চলতে শুরু করলো। হ্যাঁ জাহাজই তো- এত বড় ট্রলারকে জাহাজ বললে অন্যায় কিছু হবে না! নিজেকে কলম্বাস কলম্বাস মনে হচ্ছে, যেন নতুন কোনো ভূখন্ড আবিষ্কার করতে বেরিয়েছি। তোফাজ্জল ভাইয়ের সাথে দুজন লোক আছেন, আর আছে তার ভাইয়ের ছেলে ওসমান। বড়জোড় ১২-১৩ বছর বয়স হবে তার। মাদ্রাসায় পড়ে, কিন্ত মাদ্রাসা বন্ধ থাকায় সেও চলেছে আমাদের অভিযানে সামিল হতে। ঠান্ডার প্রকোপ সেরকম নেই। কিন্ত ফিনফিনে বাতাস কাঁপন ধরিয়ে দেয়। ট্রলারের ডেকের অর্ধেকটা মাছ ধরা জালের দখলে। জালের ওপর গা এলিয়ে শুরু হলো আড্ডা। সেই সাথে চলছে ছবি তোলা, ভানু ভাই তার বিখ্যাত সেলফি স্টিকের এস্তেমাল ভালোভাবেই শুরু করেছেন। খাল পেরিয়ে তেঁতুলিয়া নদী হয়ে বুড়াগৌরাঙ্গ নদের মোহনা পেরিয়ে আবার খালে ঢুকে গেলাম। মনে হয় নদীতে ঢেউয়ের তালে দৌড়ে পরিশ্রান্ত হয়ে পানিরা খানিকটা বিশ্রামের আশায় খালে ঢুকে পড়ছে। গভীর হলেও প্রশস্ত নয় খালটি, যদিও ভাটার সময় পানি তালানিতে ঠেকে। বিট অফিসে থেমে অনুমতি নিয়ে আবার চলতে শুরু করলাম ক্যাম্প সাইটের দিকে।
সূর্য পশ্চিম দিকে বেশ খানিকটা হেলে পড়েছে, যেকোনো সময় পৃথিবীর এ প্রান্ত অন্ধকার করে অন্য কোনো প্রান্ত আলোকিত করতে চলে যাবে। এমন সময় তোফাজ্জল ভাই বললেন- ‘আমারা ক্যাম্প সাইটে চলে এসেছি, নামতে হবে’। ছোট একটা পাকা ঘাটের মতো আছে, সেখানে সিঁড়ি দেওয়াতে নামতে আর অসুবিধা হলো না। ঝাউ গাছের মাঝ দিয়ে সামনে এগোতেই খোলা চত্বরে চলে এলাম। বাঁ-দিকটায় অবারিত জলরাশি, ডানদিকে বেশ ঘন জঙ্গল। আশপাশে বড় বড় গাছ উপড়ে পড়ে আছে। সূর্যের আলো চলে যাওয়ার আগে ক্যাম্পের জন্য জায়গা নির্ধারণ করে তাঁবুগুলো খাটাতে হবে। অন্ধকার নেমে আসার আগে মাহাবুব আশপাশটা রেকি করে নিলো। যেহেতু সময়ের স্বল্পতা আছে, বেশি খোঁজাখুঁজি না করে, একটি জায়গায় ক্যাম্প করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। পর পর সাতটি তাঁবু পাতা হলো।
ক্যাম্প লাইটের আলোয় কবির আর সুজন চা বানানোর প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। নতুন কেনা চুলা, কেটলি, গ্যাস- এগুলোর পরীক্ষা হবে আজ। আগুনের চারদিকে কুকুরকুলী হয়ে আড্ডা চলছে। চায়ের ডাকে সবাই যার যার মগ নিয়ে হাজির। এরকম পরিবেশে এক কাপ চা যে কত আনন্দদায়ক সেটা বলে বোঝানো যাবে না। খাবারও তৈরি হয়ে এলো, যার যার প্লেট নিয়ে বসে পড়লাম। খাবার শেষে আশপাশে চেক করে ঘুমের রাজ্যে ডুবে গেলাম।
ঘুম ভাঙল তোফাজ্জল ভাইয়ের ডাকে। দেরি করা যাবে না, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রওনা হতে হবে। ভাটা শুরু হয়ে গিয়েছে। ট্রলারের তলা কাদায় আটকে যাওয়ার আগেই রওনা হতে হবে। আমরা শহুরে মানুষেরা মাঝে মধ্যে শহর ছেড়ে জঙ্গলে আসি হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে। কিন্ত দুই একটি দিন আশা-তাড়নাহীনভাবে কাটিয়ে মন আরও অপূর্ণতায় ভরে যায়! আবার আসবো- মনকে এই বুঝ দিয়ে ধেয়ে চলি আবার ইট-পাথরের শহরের দিকে।