পর্যটন বিচিত্রা ডেস্ক
৭০ বছর ধরে যুক্তরাজ্য শাসন করে আসা রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ৮ সেপ্টেম্বর মারা গেছেন। তার বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর। বাকিংহাম প্যালেসের ভেতরে রানির মুত্যু সংক্রান্ত সাংকেতিক ভাষা ছিল ‘লন্ডন ব্রিজের পতন হয়েছে’ (London Bridge is down)। ব্রিটেনের এই রানি সিংহাসন আরোহণের পর থেকে বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেছেন। বিশ্বের নানা দেশে তার সমাজসেবামূলক কর্মকা- রয়েছে। তবে বাংলাদেশের প্রতি রানির ভালোবাসা ছিল আজীবন।
রানি এলিজাবেথ দুই বার ঢাকা সফর করেছেন। সেই সফরে এ দেশের মানুষের প্রতি প্রকাশ করেছেন গভীর ভালোবাসা। তাই রানিকে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষেরও স্মৃতি অম্লান।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ প্রথমবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা সফরে আসেন ১৯৬১ সালে। ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজকীয় ওই সফরে তার স্বামী প্রিন্স ফিলিপও তার সঙ্গে আসেন। তারা থেকেছিলেন রমনা পার্কের রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধায়। এখন সেই ভবনটি ফরেন সার্ভিস একাডেমি হিসেবে পরিচিত।
রানি এলিজাবেথ সেসময় বুড়িগঙ্গা নদীতে স্টিমারে চড়ে নৌবিহার করেন। বুড়িগঙ্গার দুই পাড়ে হাজার হাজার মানুষ হাত নেড়ে রানিকে স্বাগত জানান। রানি বাংলার মানুষের এই অভ্যর্থনায় সিক্ত হয়েছিলেন। নিজেও বার বার হাত নেড়ে হাসিমুখে মানুষের ভালোবাসার জবাব দিয়েছিলেন। রানির নৌবিহারের সময় বুড়িগঙ্গায় যাত্রী পারাপারের নৌকাগুলো বর্ণিল সাজে সাজানো হয়েছিল। স্টিমার থেকে ঘাটে নামার পর ৩৬ বছর বয়সি রানিকে কিশোরীরা অভ্যর্থনা জানায়। তিনি সেবার আদমজী জুট মিলও পরিদর্শন করেন। কীভাবে জুট মিলে চট উৎপাদন হয়, সেটা দেখার আগ্রহ ছিল তার।
এরপর ১৯৮৩ সালের নভেম্বর মাসে স্বাধীন বাংলাদেশে সফরে এসেছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। সেসময় তিনি বাংলাদেশের একটি গ্রামের নারীদের দেখতে গিয়েছিলেন। চারদিনের সরকারি সফরের একদিনে তিনি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বৈরাগীরচালা গ্রাম দেখতে গিয়েছিলেন। ঢাকা থেকে ট্রেনে করে শ্রীপুর, সেখান থেকে গাড়িতে করে বৈরাগীরচালায় যান রানি। সেখানে তিনি গ্রামের সংস্কৃতি দেখেন। কীভাবে মুড়ি ভাজা হয়, ধান থেকে ঢেঁকি দিয়ে চিড়া ও চাল তৈরি হয়, এসব তিনি দেখেন। পুকুরে মাছ অবমুক্ত ও মাছ ধরা দেখেন। পুকুর ঘুরে দেখেন, পুকুরের পাশে কুঁড়েঘরে বসেন। পুকুরের পাড়ে কুটির শিল্প, তাঁতশিল্প, পোল্ট্রির ফার্ম ঘুরে দেখেন।
রানির এই সফর এখনো গ্রামটির মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। রানির আগমন উপলক্ষ্যে ওই গ্রামে ব্যাপক উন্নয়নকাজ হয়েছিল, যা পরবর্তী সময় এলাকায় কলকারখানা গড়ে উঠতে সাহায্য করে। এছাড়া ঢাকায় সেভ দ্য চিলড্রেনের কার্যালয় ও জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়েছিলেন রানি এলিজাবেথ। রানির সম্মানে ১০ টাকা মূল্যের একটি স্মারক স্ট্যাম্পও (ডাক টিকিট) প্রকাশ করেছিল বাংলাদেশ সরকার।
রানির মৃত্যুতে বিশ্বের মতো বাংলাদেশও শোক প্রকাশ করেছে। তার মৃত্যুতে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকার।
এক নজরে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ
* রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের পুরো নাম এলিজাবেথ আলেকজান্ড্রা ম্যারি। * ১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল লন্ডনের ১৭ ব্রুটন সেন্টে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
* রাজা জর্জ এবং রানি এলিজাবেথের প্রথম সন্তান ছিলেন তিনি।
* বাড়িতে পারিবারিকভাবে শিক্ষিত হওয়া রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ স্থলসেনাবাহিনীর নারী বিভাগ অগজিলিয়ারি টেরটোরিয়াল সার্ভিসে কর্মরত থেকে জনসাধারণের দায়িত্ব পালন করেন।
* চাচা এডওয়ার্ড অষ্টম ১৯৩৬ সালের ১১ ডিসেম্বর পদত্যাগ করলে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হন তিনি এবং তার বাবা রাজা ষষ্ঠ জর্জ হন। তার বয়স তখন ১০ বছর।
* ১৯৪৭ সালে তিনি গ্রিক ও ডেনমার্কের প্রাক্তন রাজপুত্র ডিউক অব এডিনবরা ফিলিপকে বিয়ে করেন।
* বাবার মৃত্যুর পর ১৯৫২ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন তিনি।
* এলিজাবেথ-ফিলিপ দম্পতির চারটি সন্তান রয়েছে। তারা হলেন- ওয়েলসের যুবরাজ চার্লস (জন্ম ১৯৪৮), রাজকুমারী অ্যান (১৯৫০), ইয়র্কের ডিউক যুবরাজ অ্যান্ড্রু (১৯৬০) এবং ওয়েসেক্সের আর্ল যুবরাজ এডওয়ার্ড (১৯৬৪)। ফিলিপ ২০২১ সালের এপ্রিলে ৯৯ বছর বয়সে মারা যান।
* ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাবা রাজা জর্জ মারা গেলে এলিজাবেথ কমনওয়েলথের প্রধান হন এবং সাতটি কমনওয়েলথভুক্ত দেশের রেজিমেন্টের প্রধান হন।
* তিনি ১৯৫৩ সালের ২ জুন ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে রাজকীয় মুকুট পরেন।
* রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, জ্যামাইকা, অ্যান্টিগুয়া এবং বারবুডা, বাহামা, বেলিজ, গ্রেনাডা, পাপুয়া নিউ গিনি, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস, সেন্ট লুসিয়া, সেন্ট ভিনসেন্টসহ ১৫টি রাজ্যের রানি হিসেবে ছিলেন। তার শাসনামলে ১৪ জন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেসিডেন্ট ছিলেন।