ইমরান উজ-জামান
ভদ্রা নক্ষত্রের ঔরসজাত শুভ্র কাশ ফোটা ভাদ্র আর নক্ষত্রের কক্ষপথে চন্দ্রযোগ আশ্বিন। অন্য কথায় বর্ষার ভরা ভাদর আর ব্রত-পার্বণের আশ্বিন মাস।
ফসলি জনগোষ্ঠীর উৎসবকাল। বর্ষার মাস কেটে যেতেই ভাদ্র ছুটে আসে। পাকা তালের রসে তৈরি হরেক রকম খাবার। লোকে বলে- ‘ভাদ্র মাসে খাওয়া চাই তাল। নইলে পরে জুটবে নাকো অন্ন-নুনে ডাল’।
সনাতন হিন্দুধর্মে বর্ণিত নবগ্রহদের রাজা হলেন শনিদেব। স্কন্দ পুরাণে শনি দেবতার জন্ম ভাদ্র মাসের অমাবস্যা তিথিতে বলে উল্লেখ আছে। শনিদেবের পছন্দের ফল নাকি তাল। ভাদ্রমাসের ফল, সুস্বাদু ও লোভনীয় ফল ‘ভাদ্রফল’ তাল। তামিল ভাষায় তালের গাছকে বলা হয়- ‘কাঠপাহাতরু’। মানে দৈব্য গাছ। দৈব্য ফল পাকার মাসও দৈব্য।
সদ্য পাট বেচা টাকা, অঞ্চলভেদে আখের মাড়াই মৌসুম আখ বিক্রির টাকা। ভাদরে বর্ষার পানি সরে যেতে থাকে, জেগে উঠতে থাকে ফসলের চাষযোগ্য জমি। সেই জমিতে লাঙল চালিয়ে তৈরি হয় চাষের জমি। আশ্বিনে শুরু হয় শীতের ফসল বোনা। বীজতলায় বাড়ন্ত ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, টমেটো।
বারমাসে তেরো পার্বণের দেশে ‘ভাদর কাটানি’ একটি প্রচলিত সামাজিক উৎসব। উত্তরবঙ্গে বিশেষ করে নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুরে হয়ে থাকে এই ভাদর কাটানি। পহেলা ভাদ্র থেকে শুরু হয় নববধূর বাবার বাড়ি নাইওর যাওয়া। কমপক্ষে ১৫ দিন পর্যন্ত স্বামীর মঙ্গল কামনায় নতুন বধূ তার স্বামীর মুখ দর্শন করবেন না। এ কারণে বাপের বাড়ি গিয়ে থাকেন। এটাই হলো ভাদর কাটানি উৎসব। কোনো ব্যাখা বা যুক্তি না থাকলেও উত্তরাঞ্চলে এটি আদি প্রথা; যা যুগ যুগ ধরে চলে আসা একটি সামাজিক উৎসব।
নানা পার্বণ তো বটেই, নানা লোকবিশ্বাসে ভরা এই বাংলা। ভাদ্র মাসে নানা ধরনের অসুখ বিসুখ লেগে থাকে। গ্রামীণ ঐতিহ্য ও টোটকা ভাদ্র মাসে মামির হাতে ভাত খেতে হয়। লোক প্রচলন হলো, ভাদ্র মাসে মামির হাতে ভাত খেলে বাকি ১১ মাস ভালো থাকা যায়। এখনো ভাগনেরা মামার বাড়ি গিয়ে মামির হাতে ভাত খায়।
ভাদ্র মাসের আরেক পার্বণ ‘আখা-পালনী’। পাথরে পাথর ঠুকে জ্বালানো আগুন ছিল মানব সভ্যতার প্রথম আবিষ্কার, আগুন অতি পবিত্র এবং প্রয়োজনীয় মানবকুলের জন্য। শুধু আগুন কেন, এই আগুন ব্যবহার করতে যে উনুন ব্যবহার করা হয়, সেই উনুন কি কম পবিত্র, কম পূজ্য। উনুনেই যে হয় রোজকার ভোজাহার। এই উনুনকে স্মরণ বা সম্মান দেয়াই ‘আখা-পালনী’। আখা মানে উনুন। ভাদ্র মুাসের শুক্লা পঞ্চমীতে উনুনে আগুন না জ্বালিয়ে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে, উনুনের ভেতর ধানগাছ ও কচু রেখে, সিঁদুরের তিনটি ফোঁটা দেয়া হয়। আলপনা দিয়ে সাজানো হয়। পার্বণের দিন বাড়িতে উনুন জ্বলে না ঠিকই, তবে তার আগের দিনে সেরে নেওয়া হয় সমস্ত রান্নাবান্না। পরদিন বাড়ির মেয়ে-বৌরা উনুন থেকে ধান-কচুগাছ তুলে পুকুরে বিসর্জন দেয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয় ‘আখা পালনী’।
সনাতন সমাজে আরেক পার্বণ ‘ঝুলন যাত্রা’। ঝুলন পূর্ণিমাকে শ্রাবণী পূর্ণিমাও বলা হয়। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের উৎসব ঝুলন যাত্রা। শ্রাবণ মাসে একাদশী থেকে পূর্ণিমা, এই পাঁচদিন ধরে অনুষ্ঠিত হয় বৈষ্ণব ধর্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎসব ঝুলন উৎসব। শাস্ত্রমতে, বৃন্দাবনে রাধা-কৃষ্ণর প্রেমলীলাকে কেন্দ্র করে দ্বাপরযুগে এই ঝুলন উৎসবের সূচনা হয়েছিল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার ভক্ত অভক্ত নির্বিশেষে সবাইকে অনুগ্রহ করবার জন্য গোলকধাম থেকে ভূলোকে এসে লীলা করেন। ঝুলন শব্দটির সঙ্গে ‘দোলনা’ শব্দটি রয়েছে। তাই এই সময় ভক্তরা রাধা-কৃষ্ণকে দোলনাতে বসিয়ে আরাধনা দেয়।
ঝুলনে নানা আচার অনুষ্ঠান ও সাবেক প্রথার সম্মেলন ঘটে। মাটির পুতুল, কাঠের দোলনা আর গাছপালা দিয়ে ঝুলন সাজানোর আকর্ষণ ছোটদের মধ্যেও রয়েছে। কোথাও কোথাও ঝুলন উপলক্ষে চলে নামসংকীর্তন। ২৫-৩০ রকমের ফলের নৈবেদ্য, লুচি, সুজি নিবেদন করা হয় প্রতিদিন। মৌলভীবাজার কমলগঞ্জে হয় উল্লেখ করার মতো ঝুলন মেলা।
ভাদ্রের শুরুতে পানি প্রধান সাপ-খোপ অধ্যুষিত এলাকায় মনসা বন্দনা হয়ে থাকে। মূলত পাহাড়ি জনপদ সিলেট-মৌলভীবাজার-রাঙামাটি-বান্দরবান বিশেষ করে চা বাগানে বিষহরি বন্দনা হয়ে থাকে। সমুদ্র ও নদী প্রধান অঞ্চলে সর্প বন্দনাকে বলা হয় মনসা বন্দনা। বরিশাল-কুয়াকাটা-খুলনা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে হয় মনসা বন্দনা। চট্টগ্রাম বন্দর এলাকার জেলে সম্প্রদায়ে মনসা বন্দনার দিন পাল্টামনসা বলে এক রকমের কবিগানের প্রচলন আছে। টাঙ্গাইল-জামালপুরে হয় ভাসান গান বা বেহুলার ভাসান। এই গান মুসলিম ওঝা শ্রেণি করে থাকে, তবে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষও দলে থাকে। ভাসান গান মূলত পদ্মপুরাণের সংক্ষিপ্ত রূপ।
শ্রাবণ মাসের শেষ দিন অথবা ভাদ্র মাসের প্রথম দিন খুব সকালে দলের চরিত্রগুলোর সাজসজ্জা শেষে সাজানো নৌকায় উঠে বসে দলপতি। যমুনার বুকে নৌকা চলতে চলতে নৃত্যগীত চলতে থাকে। পথে সাত ঘাটে ভিড়তে হয়, ঘাটের পাশের বাড়ির উঠানে চলে ধারাবাহিক পরিবেশনা। দিন শেষে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া দুধ, কলা, জবা ফুলসহ ঢালা যমুনার পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে সম্পন্ন হয় ভাসান গান।
আছে ‘ভেলা ভাসানি’ ভাদ্র মাসের প্রতি বৃহস্পতিবার ঢাকা-বিক্রমপুর ও আশাপাশের এলাকায় হয় ভেলা ভাসানি। মূলত মুসলমান সম্প্রদায়ের পীর ভক্তকুল পানির মালিক খোয়াজ-খিজির বা খিজির পীরের উদ্দেশ্যে ভেলা ভাসিয়ে থাকেন। কলা গাছ দিয়ে ভিটি তৈরি করে, সেই ভিটিতে বাঁশ দিয়ে ঘর তৈরি করা হয়। সারাদিন চলে ঘর বানানোর কাজ, রঙিন কাগজ কেটে ভেলা সাজানোর কাজ। ভক্তকুল মোরগ-খাসি-গরু-চাল-ডাল-টাকা-পয়সা নিয়ে হাজির হন। বড় বড় ডেকচিতে খিচুরি রান্না হয়, দিনমান চলে খিচুরি খাওয়া।
আসরের পর থেকে শুরু হয় ভেলা ভাসানোর প্রস্তুতি। ফুল-ধান-দূর্বা দিয়ে ভেলার তৈরি সম্পন্ন করা হয়। ভেলায় রাখা হয় মানতের টাকা-পয়সা-ফলমূল-পায়েস। এই পুরো সময় জুড়েই ব্যান্ডপার্টি বাজে বাড়িতে। শেষে ভেলা নিয়ে যাওয়া হয় নদীতে। নদীতে ভেলা ভাসানোর মধ্য দিয়ে শেষ হয় ভেলা ভাসানি উৎসব। ভাদ্রের শেষ বৃহস্পতিবার হয় বড় ভেলা ভাসানি। চাঁদপুরের বেলতলির লেংটার মাজারে হয় সর্ববৃহদ ভেলা ভাসানি। মুন্সীগঞ্জের মনাই পাগলার মাজারে ও প্রমাণ আকারের ভেলা ভাসানো হয়।
ভাদ্র-আশ্বিনে মধুপুরসহ গারো পাহাড়ে হয় ওয়ান্না বা ওয়ানগালা। তিনদিনের ওয়ান্নায় প্রকৃতিকে পবিত্র করে তোলা গারোদের ওয়ান্নার প্রধান বিষয়। ওয়ান্নাতে গারো বা মান্দি জনগোষ্ঠী নতুন ফসল তোলার পর শস্য দেবতা ‘মিশি শালজং’কে ধন্যবাদ জানায়। বাঁশ দিয়ে তৈরি গারোদের দেবতা রাক্কাসিকে চ্যু আর দ্যু (মদ ও মোরগ) দিয়ে পবিত্র করে তোলা হয়। আর এই কাজটি করে মান্দিদের সাংসারেক ধর্মীয় গুরু খামাল।
ভাদ্রের মাঝামাঝি মাগুরার সাতদোহাতে হয় সাতদোহা মেলা। ভাদ্র মাসের শেষ সপ্তাহ যশোরের চৌগাছিতে হয় বলু দেওয়ান ফকিরের মেলা। এ মেলা দুটো সমসাময়িক মেলার মতোই মাজার কেন্দ্রিক। লোক সমাগম হয় খুব। আছে সনাতন ধর্মের শেষ দিন বিশ্বকর্মার স্মরণ পার্বণ।
আশ্বিন মাসের প্রথম দিন সাতক্ষীরায় হয় গুড়পুকুরের মেলা। মূলত মনসা বন্দনা এই গুড়পুকুরের মেলা। সাতক্ষীরা শহরের গুড়পুকুর পাড়ের শতবর্ষী বটবৃক্ষতলে সকাল থেকেই জড়ো হয় মনসা ভক্তরা। বটতলাকে মানুষ মনসাতলা বলে। মনসাতলাকে কেন্দ্র করে দুধ-কলা-জবা ফুল-দূর্বার বাজার বসে। দূর দূরান্ত থেকে আসা মানুষ দুধ-কলা নিয়ে মনসাতলায় প্রণামী দেয়। মনসাতলার আশপাশে বেহুলার গান বসে। বিধাব নারীদের বেহুলার গান একমাত্র সাতক্ষীরাতেই দেখা যায়। গান করে প্রণামি নেয় নারী বেহালার গানের শিল্পী দল। দিন শেষে মনসাতলা শূন্য পড়ে থাকে।
এছাড়া আশ্বিনের পূর্ণিমা তিথিতে হয় প্রবারণা পূর্ণিমা। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বুদ্ধপূর্ণিমা, মহামহিমান্বিত দিন। তারা এই দিন ফানুস ওড়ায় আকাশে। পূণ্য অর্জনে বিধাতার কাছে সবিনয় নিবেদন পাঠায়। রামু-কক্সবাজারে বড় প্রবারণা হয়, ঢাকার বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতেও ফানুস ওড়ানো হয়। প্রবারণার পরের দিন হয় বৌদ্ধদের জাহাজ ভাসানি। রামু-কক্সবাজারে এই জাহাজ ভাসানি হয়। সারাদেশে এ মাসেই বসে দুর্গাপূজার মেলা। সাতক্ষীরার দেবহাটা সীমান্ত নদীতে দশমির দিন বসে বিসর্জনের মেলা।
আছে দুর্গাপূজার মেলা। সারাদেশে হয় দুর্গাপূজার মেলা। বিজয়া দশমীর বিসর্জনের দিন অভিনব অতি সুন্দর দৃশ্যের অবতারণা হয় সাতক্ষীরার দেবহাটায় ভারত সীমান্তের ইছামতি নদীতে। সেদিন দুই দেশের প্রতিমা বিসর্জন একই সময়ে একই নদীর দুই পাড়ে থেকে নৌকায় নৌকায় ভরে যায় ইছামতি নদী।
সামাজিকতায় আশ্বিনের শেষে এক ভিন্ন মাত্রার উৎসব গারু হারকাইন। গ্রামবাংলায় সনাতন হিন্দু ধর্মে একে গারু হারকাইন বললেও মুসলমান সম্প্রদায় বলে আশ্বিনে রান্দে কার্তিকে খায়।
আশ্বিন মাসের শেষদিন ভাত-তরকারি রান্না করে রেখে দেয়া হয়। রাতে নিমপাতা-হলুদ-গিলা-মেথি-মেহেদি বেটে রান্নাঘরের চালের ওপর রেখে দেয়া হয়। ছিলে রাখা আখের খ- দিয়ে মালা, মুড়ি দিয়ে মালা গেঁথে রাখা হয়। মুড়ির মোয়া, খৈয়ের মোয়া, গুড় দিয়ে জুলুপ দেয়া শুকনো শালুক। কুলাতে রাখা নিমপাতা-কাচা হলুদ, লোহার পেরেক, বেতের ডাটি, ধান, দূর্বা রাখা হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেরা এবং ঘরের ছোটদের গায়ে বাটা নিমপাতা-হলুদ-গিলা-মেথি-মেহেদি শরীরে মেখে গোসল করা হয়। এরপর উঠানে বসে কুলাতে রাখা বেতের ডাটি, পেরেক, কাচা হলুদে কামড় দেয়া হয়। এবার গলায় আখের ও মুড়ির মালা ঝুলিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে হয়। সবশেষ গতকাল রান্না করে রাখা ভাত-তরকারি খাওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয় ‘আশ্বিনে রান্দি কার্তিকে খাই’।
এক আনন্দ আর মেলা-পার্বণের মধ্য দিয়ে দুই মাস অতিবাহিত করে বাংলার মানুষ।
বাংলাদেশ যে ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’- এর দেশ তার প্রমাণ এসব মেলা-পার্বণ। এসব অনুষ্ঠানকে শুধু আনুষ্ঠানিকতা বললে ভুল হবে। এসব পার্বণ সমাজের মানুষে মানুষে সংযুক্তি বাড়ায়। মানুষের মননের বিনোদন জোগায়। সব শেণি-পেশা-বয়সি মানুষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমাজের বন্ধন দৃঢ় হয়। বাংলাদেশটাই এক আনন্দলোক, উৎসবের জনপদ