লেখকঃ সুমন্ত গুপ্ত
ম্যানেজার স্যার বললেন ভারতের এলাহাবাদে যেভাবে ত্রিবেণীসঙ্গমে মিশেছে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী, তেমনভাবে বাংলাদেশের জকিগঞ্জে মিশেছে বরাক, সুরমা ও কুশিয়ারা ও । তুমি একসাথে ব্যাংকের কাজ টা ও করে আসতে পারবে সাথে ঘুরেও আসতে পারবে, দেখে আসতে পারবে তিন নদীর মিলন স্থান। আমি ভাবলাম দূরত্ব যাই হোক না কেন নতুন স্থান ঘুরে দেখার মজাই আলাদা। আর যেহেতু তিন নদীর মিলন স্থান সেহেতু আমাকে ঐ জায়গা দেখে আসতেই হবে। সকাল বেলায় প্রস্তুতি নিয়ে বের হলাম অফিস পানে সাথে নিলাম আমার প্রিয় ক্যামেরা। অপেক্ষা করছি আফতাব ভাই এর কিন্তু ওনার দেখাই নাই। ঘড়ির কাঁটাতে তখন এগারোটা বাজি বাজি কিন্তু তখনো দেখা নাই। ফোন দিলাম আফতাব ভাই কে বললো দাদা আমি অফিসের নিচে আপনি নামুন। শেষ পর্যন্ত চার চকার গাড়িতে চেপে বসলাম আমরা। আকাশে মেঘের ভেলা কে সঙ্গী করে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে বেরসিক রাস্তার জন্য শরীরের নাট বল্টু ঢিলে হবার জোগাড়। তবে রাস্তার সৌন্দর্য আপনাকে নিশ্চিত ভাবে বশ করবে। মাঝে মাঝে ছবি তোলার নিরন্তর চেষ্টা করছি। চলছি আমরা এগিয়ে পথের ধুলো কে সঙ্গী করে। প্রায় আড়াই ঘণ্টার মধ্যে আমরা এসে পৌছাই জকিগঞ্জ শহরে। দেখা পেলাম জকিগঞ্জ পৌর পাঠাগারের সাথে শহীদ মিনারের। আফতাব ভাই বললেন দাদা আগে কিছু খেয়ে নেন পরে জায়গা দেখতে যাবেন। আর এখানে হোটেলে টাটকা মাছের ঝোল পাবেন খুব সুস্বাদু। সকাল থেকে পেটে কিছু পরে নাই, তাই আমি আর না বললাম না। এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। হোটেলের ভেতরে প্রবেশ করলাম বেশ পরিস্কার পরিছন্ন। আমরা যেতেই টেবিলে গরম গরম ভাত পরিবেশন করা হলো । জানতে চাওয়া হলো কি দিয়ে আমরা আহার পর্ব শুরু করবো। ভিন্ন ভিন্ন পদের মাছের নাম বললো । ছোট মাছ , রানী মাছ, শিং মাছ , কৈ মাছ, পাবদা মাছ, চিতল মাছ, সরপুঁঠি মাছ, বাউস মাছ কোনটা লাগবে। আমি এতো গুলো মাছের নাম শুনে কোনটা রেখে কোনটা খাবো তাই ভাবছিলাম। শেষ পর্যন্ত ছোট মাছ, রানী মাছ দিতে বললাম। এদিকে আমার সাথীরা কৈ মাছ, পাবদা মাছ দিয়ে আহার পর্ব শেষ করলেন। অসাধারণ স্বাদ , খুব একটা মসলার ও প্রয়োগ নেই। তাই খেয়ে ও খুব ভালো লাগলো। পেট পূজা শেষে আমরা চললাম আমাদের গন্তব্য পানে। পথে দেখা পেলাম প্রচুর সুপারি বাগানের। আফতাব ভাই বললেন জকিগঞ্জের সুপারির বেশ কদর। এখানকার সুপারির রং যেমন খাসা, স্বাদও অসাধারণ। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি সুপারিগাছের প্রাচুর্য প্রমাণ করে এই এলাকার সুপারির কদর এর কথা। আমরা পৌঁছে গেলাম আফতাব ভাই এর বাড়িতে। আফতাব ভাই এর বাড়ী ঘুরে দেখলাম। বাড়ী দেখে মনেই হয় না যে বাড়ী টি গ্রামে অবস্থিত। আমি দ্রুত আমার অফিসের কাজ শুরু করে দিলাম । মনের ভেতর তারা দিচ্ছিল কতক্ষণে হাতের কাজ শেষ করবো। আমরা অফিসের কাজ শেষ করে ছুটে চললাম আমার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের পানে।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য কুশিয়ারা তীরের কাস্টমস ঘাটে এসে পৌছালাম । দেখা পেলার খরস্রোতা নদীর। আফতাব ভাই বললেন এ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের পূর্ব-উত্তর কোণের সর্বশেষ উপজেলা জকিগঞ্জ, অপর প্রান্তে ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ জেলা। পাশেই দেখলাম আমাদের সীমান্তরক্ষীদের সতর্ক প্রহরা। দুই দেশের মাঝখানে নদীটি আছে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ হয়ে। নৌকা গুলোতে কোনাটিতে বাংলাদেশের পতাকা আবার কোনটিতে ভারতের পতাকা টাঙ্গানো আছে। আমি আমার ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলতে লাগলাম। হঠাৎ দেখা পেলাম এক বয়স্ক লোক হাঁসের ছানা নিয়ে যাচ্ছেন। আমি আবার ছবি ও তুললাম। আফতাব ভাই বললেন চলেন সামনের দিকে এগিয়ে যাই আপনাকে এখন নিয়ে যাবো তিন নদীর মোহনায়। আমরা যাব আমলসীদ পয়েন্ট, এখানে মিলিত হয়েছে তিন-তিনটি নদী। জকিগঞ্জ সদর থেকে উত্তর-পূর্বমুখী রাস্তা ধরে ১৩ কিলোমিটার যাওয়ার পর পড়ল আমলসীদ বাজার। সেখান থেকে একটু সামনে গিয়ে ডানে মোড় নিলাম। মোড় থেকে একটু সামনে গিয়ে টিলার মতো একটা উঁচু ঢিবি। কিছু দূর যাবার পর রাস্তার অবস্থা খুব করুন। গাড়ি সামনেই যেতে চাইছে না। অগত্যা গাড়ি থেকে নেমে পদব্রজে রওনা দিলাম আমরা। কয়েক মিনিট হাঁটার পর আমারা পৌঁছে গেলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। এক সাথে তিনটি নদীর সঙ্গম স্থান দেখা ভাগ্যের ব্যাপার। নদীর স্রোত ধারা বলে দিচ্ছে এটি যে তিন নদীর মিলন ক্ষেত্র। ভারতের মনিপুরে জন্ম নেওয়া বরাক মিজোরাম আর আসামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আমলসীদে এসে দুই ধারায় ভাগ হয়েছে। এই দুটিই আমাদের সুরমা ও কুশিয়ারা। এই দুই নদী জকিগঞ্জ উপজেলাকে তিন দিক থেকে জড়িয়ে আছে। দেখা পেলাম নদীর পাশে বাঁশবাগান এর পাশে সবজি ক্ষেতের। আমাদের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী প্রহরীর বেশে টহল দিচ্ছেন। পানকৌড়ি, সারস, বকসহ অচেনা বেশ কিছু পাখিকে খাবারের সন্ধান করতে দেখলাম অসাধারণ দৃশ্য। হঠাৎ করে শব্দ হল দেখলাম বড় একটি মাছ ধরা পড়েছে পেতে রাখা ফাঁদে । আফতাব ভাই এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন জানতে চাইলে বললেন, এটা হলো বাঁশ-বেত দিয়ে বানানো এক ধরনের বড় আকৃতির মাছ ধরার ফাঁদ, স্থানীয় নাম ‘ফর্গা’। পানির ওপর কয়েকটি ফর্গা নাক উঁচু করে ভেসে থাকে এটি । কোথায় থেকে ছুটে এলেন এক বয়স্ক লোক এসেই নৌকা নিয়ে ছুটে গেলেন মাছ ধরতে। বড় আকারের একটি আইড় মাছ ধরা পড়েছে জালে। নদীর থেকে উঠে আসার পর জানতে চাইলাম কি কি মাছ আছে এই নদীতে । তিনি বললেন তাঁদের বড়শিতে নানা জাতের মাছ ধরা পড়ে। তবে বাইন, আইড়, সরপুঁটিই বেশি ধরা পড়ে। কতো বছর ধরে মাছ ধরছেন জানতে চাইলে তিনি বললেন বাপ চাচার আমল থেকেই মাছ ধরছি। এখন আর আগের মত জালে মাছ ধরা পরে না। দেখা পেলাম ঐ এলাকার মুরুব্বী রফিক চৌধুরীর সাথে। পরিচয় দেবার পর তিনি বললেন বরাক মোহনার এই মিলিত স্রোতের বিশেষত্ব হচ্ছে এখানটায় প্রায় সারা বছরই পানির যথেষ্ট প্রবাহ থাকে। শুষ্ক মৌসুমে এমন স্রোত দেশের অনেক নদীতেই দেখা যায় না। আমলসীদ পয়েন্টে তিন নদীর আকৃতি ইংরেজি ‘ওয়াই’ অক্ষর উল্টো করে ধরলে যে রকম দেখায় অনেকটা সে রকম। রফিক সাহেবের সাথে কথা বলতে বলতে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। নদীর পারে নানা জাতের বাহারি লতা-গুল্ম আর নলখাগড়ার বন পেরিয়ে কিছুদূর এগিয়ে গেলাম । সেখানে রঙের আবহ ছড়িয়ে ফুটেছে বর্ণিল সব বুনো ফুল। এদিকে সূর্য মামার বিদায় বেলা উপস্থিত হবার দরুন অসাধারণ রূপ ধারণ করেছে। এদিকে আফতাব ভাই তারা দিতে লাগলেন দাদা সিলেটে ফিরবেন না। আমি ও দেক্লাম সূর্য দেবের পাটে যাবার সময় হয়ে গেছে। আমার সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে চললাম শহর পানে।
যাবেন কীভাবে:
সিলেটের কদমতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে জকিগঞ্জের উদ্দেশে বাস ছেড়ে যায়। বাসে ভাড়া পড়বে ১২০ টাকা। জকিগঞ্জ উপজেলায় যাওয়ার পথে কালীগঞ্জ লাইনে পড়বে আমলসীদ পয়েন্ট। সেখানে দেখা পাবেন তিন নদীর মিলন স্থান। তবে চাইলে সিলেট থেকে ব্যক্তিগত গাড়ি অথবা ভাড়া করে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে। তবে বাসে গেলে নিশ্চিত হয়ে নেবেন বাস কালীগঞ্জ হয়ে যাবে কি না। দিনে দিনেই সিলেটে ফেরা যাবে জকিগঞ্জ থেকে।