পর্যটন বিচিত্রা প্রতিবেদন
ফেব্রুয়ারি এলেই আমাদের মন-প্রাণজুড়ে উৎসবের আমেজ বয়ে যায় বইমেলা নিয়ে। প্রকৃতপক্ষেই লেখক-পাঠক আর প্রকাশকের এমনতর মিলনমেলার জন্য সবাই সারা বছর অপেক্ষায় থাকে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছড়িয়ে থাকা রঙিন স্টল, নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, প্রিয় লেখকদের সঙ্গে আড্ডা; সব মিলিয়ে এটি শুধু একটি বইমেলা নয়, বরং বাঙালির সংস্কৃতি ও সৃজনশীলতার এক বিরাট সম্মিলন।
একুশে বইমেলার সূচনা হয় ১৯৭২ সালে, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দিকে। লেখক চিত্তরঞ্জন সাহা শহীদ দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় কয়েকটি বই নিয়ে বসেছিলেন, যা এই মেলার বীজ বপন করে। এরপর ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি আনুষ্ঠানিকভাবে বইমেলার আয়োজন শুরু করে। ১৯৮৪ সালে একে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। অমর একুশে বইমেলা ২০২৫ শুরু হয়েছে ১ ফেব্রুয়ারি এবং এটি চলবে মাসজুড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানজুড়ে বিস্তৃত এই মেলায় প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দর্শনার্থীরা বই কিনতে ও ঘুরে দেখতে পারবেন। ছুটির দিনে মেলার সময়সূচিতে কিছু পরিবর্তন থাকতে পারে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বাংলা একাডেমির পরিচালনায় এবারের মেলায় দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকাশনী সংস্থাগুলোর পাশাপাশি নতুন প্রকাশকরাও অংশগ্রহণ করেছে।
এবারের বইমেলায় হাজারো নতুন বই প্রকাশ পাচ্ছে। কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গবেষণা, বিজ্ঞান, শিশুতোষ সাহিত্যসহ নানা বিষয়ে সমৃদ্ধ বই সম্ভার রয়েছে। শিশুদের জন্য বিশেষ স্টল ও চত্বর বরাদ্দ করা হয়েছে, যেখানে তারা মজার সব বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে। শুধু বই কেনাবেচাই নয়, বইমেলা মানেই লেখক-পাঠকের সরাসরি মিলনমেলা। প্রতিদিন থাকছে বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, লেখকদের সঙ্গে মতবিনিময়, সাহিত্য আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
ভাষা আন্দোলনের চেতনার প্রতীক হিসেবে এই মেলায় ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে নানা আলোচনা ও স্মরণসভাও অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মেলায় দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রবেশ ও বাহির পথ, সিসিটিভি ক্যামেরা ও নিরাপত্তাকর্মীদের কড়া নজরদারির মাধ্যমে মেলার সুশৃঙ্খল পরিবেশ বজায় রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া মেলায় পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা ও শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে বাংলা একাডেমি বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে।
একুশে বইমেলা কেবল একটি বইমেলা নয়, এটি বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। এটি বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের অন্যতম বড় উৎসব। ভাষা আন্দোলনের চেতনার ধারাবাহিকতায় এই মেলা আজ আন্তর্জাতিক পরিসরেও গুরুত্ব পাচ্ছে। নতুন প্রজন্মকে বইয়ের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে এবং বাংলা সাহিত্যকে আরও সমৃদ্ধ করতে একুশে বইমেলা যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে চলেছে। লেখক-পাঠকের সরাসরি যোগাযোগ, নতুন বই প্রকাশের উন্মাদনা এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চায় এটি বিশেষ ভূমিকা রাখে। একুশে বইমেলা আজ শুধু বাংলা একাডেমি চত্বরেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে সাহিত্যচর্চার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
ভাষাশহিদদের প্রগাঢ় দেশপ্রেম এবং বাংলা ভাষার প্রতি মমত্ববোধের চেতনায় উদ্ভাসিত ভাষার মাঝে একুশের বইমেলা হোক প্রতিটি বাঙালির প্রাণের মেলা। ভাষা এবং ভালোবাসার বইমেলা অমর হোক।