এলিজা বিনতে এলাহী
আমার ভালোবাসার সমস্ত জায়গাজুড়ে রয়েছে ভ্রমণ। নিজেকে আমি একজন ইতিহাস অনুরাগী ও ইতিহাস প্রেমিক মনে করি। হয়তো কথাগুলো নানা সময়ে অনেকবারই বলেছি। হরিপ্রভা তাকেদার কথা লিখতে গিয়ে আবার নিজেকে বেশি করে ঐতিহ্য প্রেমিক মনে হলো আর প্রীত হলাম। এই ঐতিহ্য প্রিয়তার কারণেই দারুণ এক নারী ভ্রামণিকের সন্ধান পেয়েছি।
গোটা বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক স্থাপনা চিনিয়েছেন আমাকে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া। যাকারিয়া স্যারের বই হাতে নিয়ে বাংলাদেশের কোণায় কোণায় ভ্রমণ করে ইতিহাস খুঁজেছি আমি। আর প্রাণের শহর, জাদুর শহর ও ঐতিহ্যের শহরের বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি আমাকে দেখিয়েছেন ড. মুনতাসীর মামুন স্যারের ঢাকা নিয়ে লেখা শতাধিক বই।
২০১৬ সাল থেকে ঐতিহ্য ভ্রমণের যাত্রা শুরু হয়েছিল মুনতাসীর মামুন স্যারের তিন খণ্ডের ‘স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ পড়ার মাধ্যমে। এই বইয়ের একটি প্রবন্ধের শিরোনাম ‘ঢাকার প্রথম আধুনিক মহিলা’। এরকম শিরোনাম বোধ করি সবার নজর কাড়বে। প্রথম নাম জানলাম হরিপ্রভা তাকেদা। বলতে দ্বিধা নেই সেই প্রবন্ধে প্রথম জেনেছি ১৯ শতকের একটি অগ্রসর জনগোষ্ঠী ব্রাহ্ম সমাজের কথা। হরিপ্রভা মল্লিক কী করে হরিপ্রভা তাকেদা হয়েছেন; সেটি জেনেও কম আপ্লুত হইনি। জাপান ভ্রমণ, জাপানি নাগরিককে বিয়ে, ভ্রমণ বই ‘বঙ্গ মহিলার জাপান যাত্রা’ সব মিলিয়ে অল্প হলেও ঘোর লাগা একটি সময় কেটেছে একজন নারীকে নিয়ে। তাই হরিপ্রভা তাকেদা নামটি মনে গেঁথে ছিল দারুণভাবে। কিন্তু এমনটি নয় যে, সাথে সাথেই হরিপ্রভা তাকেদাকে নিয়ে গবেষণা শুরু করেছি কিংবা কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করেছি। তারপর জীবনের নানা জটিলতায়, বাস্তবতায় ও ২০১৭ সালে বিদেশে পড়তে যাওয়ার কারণে হরিপ্রভা আমার স্মৃতি থেকে প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল।
দেশে ফিরলাম ২০১৮-তে, আবার বাংলাদেশের ঐতিহ্য ভ্রমণ শুরু করলাম। নানা বইয়ের সন্ধান করছিলাম ঢাকার বিভিন্ন বুকশপ ও লাইব্রেরিতে। এরই ধারাবাহিকতায় শাহবাগের পাঠক সমাবেশে চোখে পড়লো ‘বঙ্গ মহিলার জাপান যাত্রা’ বইটি। অবাক হলাম! ঘরিপ্রভার বই নতুন করে ছাপা হয়েছে।
বাড়িতে ফিরতে ফিরতে রিকশায় বসেই বইটির পাতা উল্টাতে লাগলাম। দুটো নাম সামনে এলো মঞ্জুরুল হক, কাজুহিরো ওয়াতানাবে। একজন প্রবাসী, অন্যজন জাপানি নাগরিক। আজ যদি পেছনে ফিরে তাকিয়ে সেই দিনের মনের অবস্থা সত্যি করে বলতে হয়, তাহলে বলতে হবে- উনাদের দুজনের সাথে কথা হবে, কাজ করার অভিজ্ঞতা হবে, সেই রকম স্বপ্নের ধার ঘেঁষেও যাইনি। আর ট্রাভেল ডকুমেন্টরি ‘হরিপ্রভা তাকেদা: এন আনসাং ট্রাভেলার অব বেঙ্গল’ এর ভ্রুণ সাত আসমান থেকেও অনেক দূরে ছিল।
বইটি পড়ার পর হরিপ্রভার নামের স্মৃতিতে যতটুকু ধুলো জমেছিল, সেটি সরে গিয়ে হীরক খ-ের মতো চকচক করতে লাগলো। ‘বঙ্গ মহিলার জাপান যাত্রা’ পড়ে হরিপ্রভাকে পুরোপুরি জানার পর, নিজেকে একবিংশ শতাব্দীর একজন আধুনিক নারী ভাবতে লজ্জা লাগছিল।
আমার ঐতিহ্য ভ্রমণ চলতে থাকলো, কিন্তু প্রায়শই হরিপ্রভা একজন নারী ভ্রামণিকের রূপে এসে আমাকে উদ্বেলিত করতে লাগলো। নানা চিন্তা ঘুরপাক করতে থাকে মাথায়, নিজের সাথে কথা বলি অনবরত। কিন্তু ভাবনার কথা কাউকে বলতে সাহস হয় না। কেউ যদি পাগল মনে করে, হেসে উড়িয়ে দেয়, শব্দে খারাপ কিছু না বললেও যদি আকার ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করে, আমি পারব না। এমনটি যে হয়নি তা নয়। সেসব কথা থাক আজকে।
হরিপ্রভার একটি মাত্র ছবি আর তার ভ্রমণ বই-এইটুকুই আমার সম্বল। এই দুইটি জিনিসকে সম্বল করে কি ২০/২৫ মিনিটের একটি গল্প বলা সম্ভব! সাথে অর্থের চিন্তা তো রয়েছেই। গবেষণা করতে গিয়ে জেনেছি চলচ্চিত্র নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল জাপান ফাউন্ডেশনের অনুদানে ‘দ্য জাপানিজ ওয়াইফ’ নামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। আর আমি ২০/২৫ মিনিট নিয়ে ভাবনায় ডুবে আছি। একেক জনের গল্প বলার ভাষা একেক রকম। সুতরাং সময়ের তারতম্য হতেই পারে। ধীরে ধীরে স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ শুরু করলাম। আমার টিমের সাথেও পরামর্শ চলতে থাকলো। টিম বলতে বড় সর যেরকম একটি বিষয় বোঝায়, আমাদের টিম মোটেও সেরকম নয়, প্রতিটি কাজ আমিসহ ২/৩ জন বন্ধু মিলেই করি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেটি দুজন মানুষে গিয়ে দাঁড়ায়।
আমার স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ বেশ খানিকটা এগোনোর পর, মুনতাসীর মামুন স্যারের সাথে কথা বললাম ফোনে, স্যারকে বললাম আমার ইচ্ছার কথা। তিনি আমাকে সব রকম তথ্য দিয়ে সহায়তা করলেন। মামুন স্যারের সাথে কাজ শেষ হওয়ার পর, স্যার নির্দেশনা দিলেন প্রয়াত আবুল হাসনাত স্যারের সাথে সাক্ষাতের। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের কালি ও কলম অফিসের আর্কাইভের সাহায্য নিতে হয়েছে হরিপ্রভাকে নিয়ে পুরনো লেখাগুলো খুঁজে পাওয়ার জন্য। কালি ও কলমের সম্পাদক প্রয়াত আবুল হাসনাত স্যার প্রচারবিমুখ একজন ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু তিনি আমার অনুরোধে ক্যামেরায় কথা বলতে রাজি হয়েছেন। হরিপ্রভাকে কী করে জানলেন সেই গল্প শুনেছি তার কাছে। সেই গল্পের সুবাদে জেনেছি পশ্চিমবঙ্গের লেখক সুরজিত দাস গুপ্তের কথা। সুরজিত দাস গুপ্ত ছিলেন হরিপ্রভার বোন অশ্রুপ্রভার ছেলে।
স্বভাবতই আমি আবুল হাসনাত স্যারের কাছে সুরজিত দাস গুপ্তের সাথে কথা বলবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলাম। তিনি আমাকে সুরজিত দাস গুপ্তের ছেলের মোবাইল নাম্বার দিলেন। ২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আমি হায়দ্রাবাদে যোগাযোগ করি। তখন জানতে পারি মাসখানেক আগে লেখক সুরজিত দাস গুপ্ত পরলোকগমন করেছেন। আমি হরিপ্রভার স্মৃতি সংবলিত কিছু রয়েছে নাকি উনার পরিবারের কাছে সেই সম্পর্কে জানতে চাইলাম। কিন্তু হরিপ্রভার কোনো স্মৃতি তাদের কাছে অবশিষ্ট নেই বলে জানালেন।
আবুল হাসনাত স্যার জাপান প্রবাসী লেখক ও গবেষক মঞ্জুরুল হকের ই-মেইল অ্যাড্রেস দিলেন। স্যারের সাথে যোগাযোগ হলো, কথা হলো। মঞ্জুরুল হক স্যার উনার সহকর্মী ও বন্ধু কাজুহিরো ওয়াতানাবের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করিয়ে দিলেন। জাপানে বেশ ভালো যোগাযোগ স্থাপন হলো। বসে ভাবছিলাম ঢাকার হরিপ্রভা নিয়ে যারা কাজ করেছেন তাদের সবার কথা শুনেছি, ভিডিও ধারণ করেছি। কিন্তু জাপানে যারা রয়েছেন তাদেরটি কী করে করবো!
এরকম ভাবতে ভাবতে একদিন মঞ্জুরুল হক স্যারের বার্তা এলো তিনি ঢাকায় আসবেন। আকাশের চাঁদ হাতে পেলে কেমন লাগবে জানি না। তবে স্যারের ঢাকায় আসার খবর, আমার এর থেকেও বেশি কিছু মনে হচ্ছিল। স্যারের সাথে প্রথম দেখা হলো, কথা হলো, কাজ হলো। তারিখটি ছিল ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০। এই যে উনি আশীর্বাদ স্বরূপ যুক্ত হলেন ‘হরিপ্রভা তাকেদা: এন আনসাং ট্রাভেলার অব বেঙ্গল’ এর সাথে আর আমার সাথে। সেই থেকে শুরু করে এই লেখা অবধি তিনি সেই আশির্বাদের হাত দিয়েই রেখেছেন।
তারপর শুরু হলো বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি। স্থবির হলো পৃথিবী। মাঝে আবুল হাসনাত স্যার পরবাসী হলেন। পৃথিবী কিছুটা আড়মোড়া ভাঙল। সবাই একটু নড়েচড়ে বসলাম। হরিপ্রভা তাকেদাও ভ্রমণ শুরু করলো। কাজুহিরো জাপান থেকে উনার অভিজ্ঞতা ভিডিওতে ধারণ করে পাঠালেন।
ধীরে ধীরে টিম কোয়েস্ট প্রথম প্রিমিয়ার শো করবার জন্য তৈরি হলো। ২০২১ সালের ৯ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে তথ্যচিত্র ‘হরিপ্রভা তাকেদা’র প্রথম প্রদর্শনী হলো। বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানে রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। জাপান থেকে মঞ্জুরুল হক, কাজুহিরো ও তামামি কাওয়াকামি শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ভিডিওবার্তায়। তামামি কাওয়াকামি জাপানি সাংবাদিক। তিনি আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন এবং আমাকে জানিয়েছেন হরিপ্রভার নাম এর আগে তামামি শোনেননি।
আমি কেন এই ডুকুমেন্টরি তৈরি করলাম? ঘরিপ্রভাকে কেনই বা ট্রাভেলার বলছি!
৬৪ জেলায় ঘুরতে ঘুরতে ইতিহাসে এরকম অনেক হারিয়ে যাওয়া অনন্য নারী আমি খুঁজে পেয়েছি। আমার কাছে মনে হয়েছে হারিয়ে যাওয়া এই নারীদের কাজগুলোকে সামনে নিয়ে আসা উচিত। শুধু দেশের মানুষের জন্য নয়, পুরো বিশ্বের জানা উচিত সেসব বাঙাালী নারীর কাজগুলো। আমার দেশ, আমার ভূখ- সমৃদ্ধ সেই প্রাচীনকাল থেকেই। আমাদের দেশের নারীরা সব যুগেই আধুনিক ছিল। সময়ের গতির সাথে, পৃথিবীর গতির সাথেই তারা চলেছে। হরিপ্রভার কাজই এর বড় উদাহরণ।
হরিপ্রভা অনন্য তিনটি বিষয়ের জন্য। তিনি প্রথম বাঙালি নারী যিনি জাপান ভ্রমণ করেছেন, প্রথম বাঙালি নারী হিসেবে জাপান সম্পর্কে লিখেছেন, প্রথম বাঙালী নারী যিনি একজন জাপানি নাগরিককে বিয়ে করেছেন। এরকম একজন নারীকে নিয়ে কাজ করার আগ্রহ বা অভিপ্রায় তৈরি না হওয়ার কোনো কারণই নেই।
হরিপ্রভা আর কোনো দেশ ভ্রমণ করেছেন কিনা সেটি জানা যায়নি, আর কোনো ভ্রমণ কাহিনি লিখেছেন কিনা সেটিও জানি না। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে হরিপ্রভা একজন ট্রাভেলার, কারণ তার বইটি শুরু হয়েছে এই কথাগুলো দিয়ে- ‘আমার যখন বিবাহ হয়, তখন কেউ মনে করে নাই যে, আমি জাপান যাইবো। কাহারও ইচ্ছাও ছিল না। কিন্তু আমার বড়ই ইচ্ছা হইতো আমি একবার যাই। সে ইচ্ছা স্বপ্নেই পর্যবসিত হইতো। কারণ চারদিকের অবস্থা প্রতিকূল। অর্থবল সামান্য, শরীর অপটু, সম্মুখে শীতকাল, আতœীয়গণের অনিচ্ছা, অনেকের নানা ভয় প্রদর্শন’। হরিপ্রভার এই অভিপ্রায়ই ব্যক্ত করছে- তার ভেতরে রয়েছে সুপ্ত এক ভ্রমণপিপাসু মন। ভ্রমণের ছোট ছোট জিনিসগুলো তার দৃষ্টি এড়ায়নি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিসগুলোর বর্ণনা তিনি দারুণভাবে লিখেছেন তার বইতে। প্রতিটি জাহাজের বর্ণনাও দিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে রেঙ্গুন পর্যন্ত জাহাজগুলো তার পছন্দ হয়নি। রেঙ্গুনে পৌঁছে জাহাজ তার দারুণ পছন্দ হয়েছে। ভ্রমণযাত্রায় তিনি সমস্ত অনুষঙ্গ নিয়েই উঠেছিলেন। মাঝে মাঝে লিখতেন- সেলাই করতেন, এস্রাজ বাজিয়ে গানও করতেন।
হরিপ্রভার জাপানযাত্রায় আমরা বিভিন্ন শহরের বর্ণনা পাই। নারায়ণগঞ্জ, কলকাতা, রেঙ্গুন, সিঙ্গাপুর, সাংহাই, হংকং এবং সর্বশেষ জাপান। সেখানকার প্রতিটি যাত্রা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। সেখানকার আর্থ-সামাজিক পরিবেশ, রীতিনীতি, কৃষিকাজ, আরও নানা গল্প ফুটিয়ে তুলেছেন তার লেখনীতে।
হরিপ্রভার লেখনীতে আমরা সেই সময়ের জাপানের পারিবারিক, ধর্মীয়, সামাজিক নানা অনুষ্ঠানের বর্র্ণনা পাই। জাপানি কাঠের বাড়ি, কাঠের জুতা, ওচা, জাপানি পোশাক- সবই হরিপ্রভার জন্য নতুন ছিল। ইংরেজি নববর্ষের কথাও রয়েছে হরিপ্রভার ভ্রমণ বর্র্ণনায়। সেই দিন নতুন পোশাক পরার রীতির কথাও তিনি বলেছেন। নাগোয়া থেকে টোকিও ভ্রমণে গিয়েছিলেন হরিপ্রভা। টোকিওর দুটি পার্ক- আসাকু কোয়েন ও অয়েনার বর্র্ণনা পাওয়া যায় তার বইয়ে। জাপানি খাবারে অনভ্যস্ত হরিপ্রভার কিছুটা অভ্যস্ত হতে সময় লেগেছে।
হরিপ্রভার বইয়ের সমস্ত বর্র্ণনা খুব জোড়ালোভাবে ইঙ্গিত করে যে, হরিপ্রভা একজন ভ্রামণিক ও ভ্রমণ লেখক।
লেখক: পর্যটক ও শিক্ষক