বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর ও মধ্যনগর উপজেলাধীন ১০টি মৌজা জুড়ে ছোট বড় ১০৯টি বিলের সমন্বয়ে টাঙ্গুয়ার হাওরের অবস্থান। মেঘালয়ের পাদদেশে অবস্থিত টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকার আয়তন প্রায় ১২৬৫৫.১৪ হেক্টর, যা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির জলভূমি। অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বৈচিত্র্যময় জীববৈচিত্র্য এবং স্থানীয় সংস্কৃতির অনন্য মিশ্রণ টাঙ্গুয়ার হাওরকে করে তুলেছে বাংলাদেশের পর্যটন মানচিত্রে একটি উজ্জ্বল রত্ন। এখানে প্রকৃতি যেন নিজ হাতে সাজিয়েছে এক অপূর্ব নিসর্গ। বিস্তীর্ণ জলরাশি, শাপলা-শালুকের দোল, দূরে পাহাড়ের সবুজ রেখা আর পাখিদের কলতান মিলিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এক স্বপ্নিল পরিবেশ।
টাঙ্গুয়ার হাওরের ভৌগোলিক অবস্থানও খুবই আকর্ষণীয়। এর উত্তরে ভারতের মেঘালয় পাহাড়, যেখান থেকে নেমে আসা অসংখ্য ঝরনা ও পাহাড়ি জলধারা হাওরের প্রাণ জোগায়। দক্ষিণে সুনামগঞ্জ সদর, পূর্বে জামালগঞ্জ আর পশ্চিমে ধর্মপাশা। প্রায় একশত বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই হাওরের বিস্তৃতি। বর্ষাকালে এটি একটি বিশাল জলরাশিতে পরিণত হয়, যেখানে গ্রামগুলো দ্বীপের মতো ভেসে থাকে। এটি শুধু একটি পর্যটন গন্তব্য নয়, বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত অঞ্চল। এই হাওর পরিবেশবান্ধব পর্যটনের এক অনন্য উদাহরণ।
পরিবেশবান্ধব পর্যটন এমন এক ধরনের টেকসই ভ্রমণ পদ্ধতি, যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য এবং স্থানীয় সংস্কৃতির সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়। এটি এমনভাবে পরিচালিত হয় যাতে কোনো এলাকার স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ ও ব্যবস্থাপনায় পরিবেশ, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি না করে প্রকৃতিকে উপভোগ করার একটি দায়িত্বপূর্ণ ভ্রমণ যা ঐ এলাকার জনগণের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কৃতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না এবং স্থানীয় জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। পরিবেশবান্ধব পর্যটনে স্থানীয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকায় তারা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয় এবং অর্জিত আয়ের একটি অংশ ঐ এলাকার পরিবেশের উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের পাশাপাশি পরিবেশ বান্ধব পর্যটনের বিকাশে ব্যবহার হয়ে থাকে।
টাঙ্গুয়ার হাওরে মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০টিরও বেশি ঝরা (ঝরনা) এসে মিশেছে। দুই উপজেলার ১৮টি মৌজায় ৫১টি হাওরের সমন্বয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর জেলার সবচেয়ে বড় জলাভূমি। পানিবহুল মূল হাওর ২৮ বর্গকিলোমিটার এবং বাকি অংশ বসতি ও কৃষিজমি। হাওর এলাকার ভেতরে ও তীরে ৮৮টি গ্রাম আছে। একসময় গাছ-মাছ-পাখি আর প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের আধার ছিল এই হাওর।
শীত মৌসুমে পানি শুকিয়ে কমে গেলে এখানকার প্রায় ১০৯টি বিলের পাড় (স্থানীয় ভাষায় কান্দা) জেগে উঠলে শুধু কান্দার ভিতরের অংশেই আদি বিল থাকে, আর শুকিয়ে যাওয়া অংশে স্থানীয় কৃষকেরা রবিশস্য ও বোরো ধানের আবাদ করেন। এ সময় এলাকাটি গোচারণভূমি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। বর্ষায় থৈ থৈ পানিতে নিমগ্ন হাওরের জেগে থাকা উঁচু কান্দাগুলোতে আশ্রয় নেয় পরিযায়ী পাখিরা —রোদ পোহায়, জিরিয়ে নেয়। স্থানীয় এনজিও ও সরকারি ব্যবস্থাপনায় সেখানে পুঁতে দেওয়া হয়েছে বাঁশ বা কাঠের ছোট ছোট বিশ্রাম-দণ্ড।
পাখি
টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্যের মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন জাতের পাখি। স্থানীয় জাতের পাখি ছাড়াও শীতকালে, সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আগত পরিযায়ী পাখিরও আবাস এই হাওর। হাওর ও এর আশপাশের এলাকায় ২০৮ প্রজাতির পাখি দেখা যায়। পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বিরল প্রজাতির প্যালাসেস ঈগল, বড় আকারের গ্রে কিংস্টর্ক রয়েছে এই হাওরে। স্থানীয় জাতের মধ্যে শকুন, পানকৌড়ি, বেগুনি কালেম, ডাহুক, বালিহাঁস, গাঙচিল, বক, সারস, কাক, শঙ্খ চিল, পাতি কুট (এই হাওরের ২৮-২৯%) ইত্যাদি পাখির নিয়মিত বিচরণ এই হাওরে।
সরীসৃপ ও উভচর
টাঙ্গুয়ার হাওর ৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২০ প্রজাতির সাপ, বিরল প্রজাতির উভচর, ৪ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটিসহ নানাবিধ প্রাণীর আবাস। বিলুপ্ত কাছিমের মধ্যে রয়েছে হলুদ কাছিম, কড়ি কাইট্টা ও পুরা কাইট্টা। তবে বর্তমানে বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে জাত কাছিম ও ধুম কাছিম। মার্বেল টোড ব্যাং বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে বিরল হলেও টাঙ্গুয়ায় সহজপ্রাপ্য। এছাড়া রয়েছে ঝিঁঝিঁ ব্যাং ও সারসারি ব্যাং। সাপের মধ্যে আছে জালবোরা, কোবরার দুটি জাত ও দাঁড়াশ সাপ।
মৎস্যসম্পদ
টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রায় ২০০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। এ হাওরের বিখ্যাত মাছের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করা যায় মহাশোলের কথা।
উদ্ভিদবৈচিত্র্য
টাঙ্গুয়ার হাওরের উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে হিজল, করচ, বরুণ, পানিফল, হেলেঞ্চা, বনতুলসী, নলখাগড়া, বল্লুয়া, চাল্লিয়া, সিংড়া, শালুক, শাপলা, গুইজ্জাকাঁটা, উকল ইত্যাদি।
১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে টাঙ্গুয়ার হাওরকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়, তখনই অবসান হয় দীর্ঘ ৬০ বছরের ইজারাদারির। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে ২০ জানুয়ারি এই হাওরকে ‘রামসার স্থান’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আইইউসিএন এই হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করছে। হাওর এলাকার মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, সম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ড সরকারের মধ্যে ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে ১২ ফেব্রুয়ারি একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দের ৯ নভেম্বর থেকে হাওরের নিয়ন্ত্রণ নেয় জেলা প্রশাসন। সুইস অ্যাজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশন (এসডিসি) এবং আইইউসিএন ২০০৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ‘টাঙ্গুয়ার হাওর সমাজভিত্তিক টেকসই ব্যবস্থাপনা’ প্রকল্প পরিচালনা করছে।
টাংগুয়ার হাওর ভ্রমণকালে আইইউসিএন-এর পক্ষ থেকে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো—
- ভ্রমণকালে নৌকায় ময়লা আবর্জনা জমিয়ে রাখার জন্য ঝুড়ি রাখতে হবে।
- কোনোরূপ খাবারের অংশ বা উচ্ছিষ্ট, প্যাকেট, খোসা বা পাত্র হাওরের পানিতে ফেলা যাবে না।
- মাইক ব্যবহার করে বা অন্যকোন প্রকারে শব্দ তৈরি করা যাবে না।
- রাতের বেলা অবস্থান করলে অস্বাভাবিক উজ্জ্বল আলো তৈরি করা যাবে না।
- পাখি বা বন্যপ্রাণী লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়া যাবে না কিংবা অন্য কোন প্রকারে এদের নিরাপদ অবস্থান ও চলাফেরায় বিঘ্ন সৃষ্টি করা যাবে না।
- টাংগুয়ার মাছ, বন্যপ্রাণী বা পাখি ধরা যাবে না বা এদের জীবন হুমকির মধ্যে পড়ে এমন কোন কাজ করা যাবে না।
- টাংগুয়ায় কোনো গাছপালা, বন জঙ্গল বা লতা পাতার ক্ষতিসাধন করা যাবে না।
- টাংগুয়ায় শামুক, ঝিনুক বা অন্য কোন প্রকার জলজ বা স্থলজ প্রাণী/কীটপতঙ্গের ক্ষতিসাধন করা যাবে না।
- টাংগুয়ায় ভ্রমণকালে হাতে চালিত নৌকার ব্যবহার বাঞ্চনীয়।
- টাংগুয়ায় ভ্রমণকালে প্রতিটি দর্শনার্থী একজন প্রকৃতিপ্রেমীর মত বিনা উপদ্রপে প্রাকৃতিক রূপ উপভোগ করবেন এটাই প্রকৃতিবান্ধব পর্যটনের প্রত্যাশা।
এছাড়া সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও পর্যটকদের জন্য অবশ্য পালনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো—
বর্জনীয়
- উচ্চ শব্দে গান-বাজনা করা/শোনা যাবে না।
- হাওরের পানিতে অজৈব বা প্লাস্টিক জাতীয় পণ্য/বর্জ্য ফেলা যাবে না।
- মাছ ধরা, শিকার বা পাখির ডিম সংগ্রহ করা যাবে না, পাখিদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে কোনো ধরণের বিঘ্ন ঘটানো যাবে না।
- ডিটারজেন্ট, শ্যাম্পু বা রাসায়নিক ব্যবহার করা যাবে না।
- গাছ কাটা, গাছের ডাল ভাঙ্গা বা বনজ সম্পদ সংগ্রহ করা যাবে না।
- কোর জোন বা সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ করা যাবে না।
- মনুষ্য সৃষ্ট জৈব বর্জ্য হাওরে ফেলা যাবে না।
করণীয়
- জেলা প্রশাসন কর্তৃক নির্ধারিত নৌপথ ব্যবহার করুন।
- লাইফ জ্যাকেট পরিধান করুন।
- দূর থেকে পাখি ও প্রাণী পর্যবেক্ষণ করুন, ফ্ল্যাশ ছাড়া ছবি তুলুন।
- স্থানীয় গাইড ও পরিষেবা গ্রহণ করুন।
- ক্যাম্পফায়ার বা আগুন জ্বালানো থেকে বিরত থাকুন।
টাঙ্গুয়ার হাওর যাওয়ার উপায়
দেশের প্রায় সব জেলা থেকে সুনামগঞ্জে বাসে আসা যায়। সুনামগঞ্জ হয়ে টাংগুয়ার হাওর যেতে চাইলে আপনাকে প্রথমেই সুনামগঞ্জ জেলা শহরে আসতে হবে।
ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ: প্রতিদিন ঢাকার সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে মামুন ও শ্যামলী পরিবহনের বাস সরাসরি সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় এবং মহাখালী থেকে ছেড়ে যায় এনা পরিবহনের বাস। এসব এসি/নন-এসি বাসে জনপ্রতি টিকেট কাটতে ৭৩০-১,০৫০ টাকা লাগে আর সুনামগঞ্জ পৌঁছাতে প্রায় ছয় ঘণ্টা সময় লাগে।
সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ: সিলেটের কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড থেকে সুনামগঞ্জ যাবার লোকাল ও সিটিং বাস আছে। সিটিং বাস ভাড়া ১০০ টাকা, সুনামগঞ্জ যেতে দুই ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। অথবা শাহজালাল মাজারের সামনে থেকে সুনামগঞ্জ যাবার লাইট গাড়িতে ২০০ টাকা ভাড়ায় যাওয়া যায়।
সুনামগঞ্জ থেকে টাঙ্গুয়া: সুনামগঞ্জ থেকে লেগুনা/সিএনজি/বাইক করে তাহিরপুরে সহজেই যাওয়া যায়। তাহিরপুরে নৌকা ঘাট থেকে সাইজ এবং সামর্থ্য অনুযায়ী নৌকা ভাড়া করে বেড়িয়ে আসুন টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে।
এছাড়া টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়া যায় নেত্রকোনা জেলা দিয়েও। আপনার জন্যে সুবিধাজনক হলে বর্ষাকালে কমলাকান্দা কিংবা মধ্যনগর বাজার হয়ে ট্রলার নৌকাযোগে টাঙ্গুয়ার হাওরে যেতে পারবেন।
হাউজবোট ও নৌকা ভাড়া
বর্তমানে নানা মানের হাউজবোট, সেমি হাউজবোট কিংবা গতানুগতিক নৌকা পাওয়া যায় টাংগুয়া ঘুরে দেখার জন্যে এবং প্রয়োজনে রাতে থাকার জন্যে। প্যাকেজ অনুযায়ী বিভিন্ন মানের হাউজবোটের ভাড়া একেক রকম। সাধারণত এক রাত থাকা, সব বেলার খাবার ও টাঙ্গুয়ার হাওরসহ আশেপাশের সকল স্পট ঘুরে দেখার প্যাকেজ প্রিমিয়াম বোট গুলোর ক্ষেত্রে জনপ্রতি ৬,০০০- ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। মোটামুটি মানের সেমি হাউজবোট গুলোর প্যাকেজ ৪,৫০০- ৬,০০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এছাড়া পুরো হাউজবোট রিসার্ভ করলে মান ও ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী ৪০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। সাধারণত হাউজবোট গুলোর প্যাকেজে সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত থাকে। তারপরেও বুকিং বা ভাড়া করার আগে তাদের প্যাকেজ দেখে নিন, প্রয়োজনে দরদাম করে নিন। শুধু ডে ট্রিপ হলে খরচ কিছুটা কম হবে।
তবে গত ১০ জুন সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ জেলায় ভ্রমণে আসা পর্যটকগণ কর্তৃক পর্যটকবাহী হাউজবোটে বিভিন্ন সেবা গ্রহণে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। হাউজবোটগুলো বিভিন্ন পর্যটন স্পটের বুকিং গ্রহণ করে। কিন্তু যাত্রীদের প্রতিশ্রুত সেবা প্রদান করে না এবং যান্ত্রিকত্রুটির নাম করে নির্ধারিত পর্যটন স্পটে নিয়ে যায় না। পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে চুক্তি লঙ্ঘন করে। এছাড়া হাউজবোটগুলোতে উচ্চ আওয়াজে গান বাজানো হয়, বিভিন্ন ময়লা আবর্জনা হাওরে ফেলা হয়। এসব কারণে গত ২২ জুন টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকার প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতি রোধকল্পে টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচ টাওয়ার ও আশপাশের এলাকায় পর্যটকবাহী হাউজবোটসমূহের গমনাগমন পরবর্তী নির্দেশনা প্রদান না করা পর্যন্ত স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। একই সাথে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর যাবতীয় কার্যকলাপ থেকে সকলকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
এক্ষেত্রে নৌকা হতে পারে আপনার ভ্রমণের উপযুক্ত বাহন। নৌকা ভাড়া মূলত ৩টি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। নৌকায় ধারণ ক্ষমতা, নৌকার সুযোগ সুবিধা, কি কি ঘুরে দেখবেন, রাতে থাকবেন নাকি ড্রে ট্রিপ এবং সিজনের উপর। সাধারণত ছোট নৌকা ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা, মাঝারি নৌকা ৩৫০০ থেকে ৪৫০০ টাকা এবং বড় নৌকা ৫০০০ থেকে ১০,০০০ টাকায় সারাদিনের জন্য ভাড়া করা যায়। এক রাত নৌকায় থাকতে চাইলে টাকার পরিমাণ বাড়বে। রান্নার জন্য নৌকার মাঝিকে খরচের টাকা দিলে সে বাবুর্চি নিয়ে যাবে কিংবা নিজেই রান্নার ব্যবস্থা করে ফেলবে। কি করবেন তা অবশ্যই মাঝির সাথে আগে আলোচনা করে দরদাম ঠিক করে নিবেন।
এছাড়া খরচ কমানোর জন্যে লোকাল বডির নৌকাগুলো ভাড়া করতে পারেন। তবে কিছু বিষয়ের উপর লক্ষ্য রাখুন যেমন- নৌকায় বাথরুম আছে কিনা, বিদ্যুৎ, লাইট ও ফ্যানের ব্যবস্থা ব্যবস্থা আছে কিনা। নৌকা ভাড়া করতে দরদাম করে নিতে হবে।
কোথায় থাকবেন
পর্যটকরা সাধারণত নৌকা বা হাউজবোটেই রাত্রিযাপন করে থাকেন। এছাড়া আপনি চাইলে টেকেরঘাট বাজারে রাতে থাকতে পারবেন। চাইলে সুনামগঞ্জ এসে সেখানের কোনো হোটেলে রাত্রিযাপন করতে পারবেন। তবে টাঙ্গুয়ার হাওর বেড়াতে গেলে অবশ্যই আপনার উচিত হাওরের নৌকায় অন্তত এক রাত থাকা। এই অভিজ্ঞতা অবশ্যই আপনার ভালো লাগবে।
খাবার ব্যবস্থা
নৌকা ও হাউজবোট প্যাকেজ খাবারসহ হয়ে থাকে। নতুবা নিজেদের খাবার নিজেরা ব্যবস্থা করে নিতে হবে। দিনে দিনে ঘুরে চলে আসলে তাহিরপুরে খাবার হোটেল থেকে রওনা হবার আগে সকালের ও ফিরে আসার পর দুপুরের খাবার খেতে পারবেন। হাওরের প্রায় ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির মাছের মধ্যে নিজের পছন্দের মাছ দিয়ে আহার পর্ব সেরে ফেলতে পারেন। এছাড়া খেতে পারবেন টেকেরঘাটেও।
আর যদি টাঙ্গুয়ায় রাতে থাকার পরিকল্পনা থাকে এবং নিজেরা রান্না করে খাওয়ার ইচ্ছে থাকে তবে তাহিরপুর থেকে নৌকায় উঠার আগে যে কয়দিন অবস্থান করবেন সেই কয়দিনের বাজার করে নিতে পারেন। আর তাজা মাছ কেনার জন্য হাওরের মাঝখানের ছোট বাজারগুলোতে যেতে পারেন। এছাড়া সাথে নিতে পারেন দেশি হাঁস কিংবা দারুণ সব শুঁটকি।
টাঙ্গুয়া ভ্রমণের সতর্কতা ও পরামর্শ
- হাওর ভ্রমণকালে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে নিন।
- যে কোনো কিছু দামাদামি করে নিবেন।
- একসাথে গ্রুপ করে গেলে খরচ কম হবে। ৪-৫ জন বা ৮-১০ জনের গ্রুপ হলে ভালো।
- কম খরচে বেড়াতে চাইলে ছুটির দিনগুলো পরিহার করুন।
- হাওরে বজ্রপাত হলে নৌকার ভিতরে অবস্থান করুন।
- খাবারের অতিরিক্ত অংশ/উচ্ছিষ্ট, প্যাকেট ইত্যাদি হাওরের পানিতে ফেলা থেকে বিরত থাকুন।
- উচ্চ শব্দ সৃষ্টিকারী মাইক বা যন্ত্র পরিহার করুন।
- রাতের বেলা অতিরিক্ত উজ্জ্বল আলো উৎপন্ন করবেন না।
ভ্রমণে সঙ্গে নিন
পাওয়ার ব্যাংক, রেইনকোর্ট বা ছাতা, নিয়মতি সেবনীয় ওষুধ, টয়লেট পেপার, ব্যাগ ঢেকে ফেলার মতো বড় পলিথিন, স্যান্ডেল, সানগ্লাস, ক্যাপ বা হ্যাট, গামছা (যা সহজে শুকাবে), খাবার পানি, টর্চ ব্যাকআপ ব্যাটারিসহ এবং সহজে শুকায় এমন জামাকাপড়।
পরিশেষে টাঙ্গুয়ার হাওর শুধু বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত জলাভূমি নয়, বরং এটি পরিবেশবান্ধব পর্যটনের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। কিন্তু এই হাওরের অস্তিত্ব আজ নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। অযাচিত ও অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন, বর্জ্য দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং মানবসৃষ্ট অন্যান্য সমস্যা হাওরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই টাঙ্গুয়ার হাওরকে টিকিয়ে রাখতে হলে পরিবেশবান্ধব পর্যটনের নীতিমালা কঠোরভাবে মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। পর্যটকদের উচিত দায়িত্বশীল আচরণ করা, পরিবেশ রক্ষার প্রতি সচেতন থাকা এবং স্থানীয় জনগণের প্রতি সম্মান দেখানো।
পাশাপাশি সরকারের, পরিবেশবাদী সংগঠন এবং স্থানীয় প্রশাসনের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই হাওরের টেকসই রক্ষা সম্ভব নয়। টাঙ্গুয়ার হাওর শুধু একটি ভ্রমণ গন্তব্য নয়, বরং এটি আমাদের দেশের প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের প্রতীক। এই সৌন্দর্য এবং সম্পদ রক্ষা করা আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব। পরিবেশবান্ধব পর্যটনের চর্চা আমাদের শেখায় কিভাবে প্রকৃতির সঙ্গে সম্প্রীতি রেখে জীবনযাপন করা যায়। আসুন আমরা সবাই মিলে টাঙ্গুয়ার হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করি, কিন্তু একইসঙ্গে তার পরিবেশ রক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করি। কারণ টাঙ্গুয়ার হাওর শুধু আমাদের নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও।