পর্যটন বিচিত্রা প্রতিবেদন
চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়তলীর ৩৩৬ একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠা এই বিনোদনকেন্দ্রের নাম ফয়’স লেক। কর্মব্যস্ত জীবন থেকে একদিনের জন্য মুক্তি পেতে ছুটে যেতে পারেন নৈসর্গিক সৌন্দর্যমন্ডিত প্রকৃতির কাছে। চট্টগ্রাম শহরের জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে এই হ্রদটির অবস্থান। ১৯২৪ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে খনন করা হয় এই বিশাল হ্রদ। চারপাশে সুউচ্চ পাহাড়ে ঘেরা এই লেকের পাশেই রয়েছে চট্টগ্রামের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় বাটালি হিল। এছাড়াও আসমানি, গগনদ্বীপ, জলটুঙ্গি ইত্যাদি অসম্ভব সুন্দর পাহাড়গুলোর সমারোহ এই লেকের চারপাশ ঘিরে।
পাহাড় ঘেঁষে আছে বেশ ঘন বন-জঙ্গল, যে বনে খেলা করে খরগোশ ও চিত্রা হরিণের মতো সুন্দর বন্যপ্রাণীরা। লেক এলাকায় সাধারণত ১২ থেকে ১৫ প্রজাতির পাখি দেখা যায়। পাহাড়ে রয়েছে চাপালিশ, ছাতিয়ান, বিভিন্ন ধরনের শিরীষ, জারুল, ধরমারা, ভাদি, রেইনট্রি, সেগুন, গামার, সোনালি ঝরনা, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, আমলা, বহেরাসহ নানা জাতের বৃক্ষ।
২০০৪ সাল থেকে কনকর্ড এন্টারটেইনমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড ফয়’স লেক অ্যামিউজমেন্ট পার্কের মাধ্যমে ফয়’স লেক বিনোদন কেন্দ্রের কাজ শুরু করে। ২০০৭ সালে গড়ে উঠে সি-ওয়ার্ল্ড।
ফয়’স লেকের ‘সি-ওয়ার্ল্ড’ হচ্ছে একটি জল থিম পার্ক। স্প্ল্যাশ পুল, ওয়াটার কোস্টার রাইডার ও বিশ্বমানের থিম পার্ক হিসেবে যা যা আশা করা যায় তার সবই সি-ওয়ার্ল্ডে আছে। এছাড়া এখানে একটি অবকাশযাপন কেন্দ্র আছে, যেখানে বিভিন্ন বয়সি ও রুচির মানুষের জন্য কিছু না কিছু আছেই।
অ্যামিউজমেন্ট ওয়ার্ল্ডের উত্তরে টিলার উপরে মূল ফয়’স লেক। সেখানে টিলার উপরে আছে পিকনিক করার মতো জায়গা। সেখান থেকে আরেকটি টিলার উপরে গেলেই আছে একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। চট্টগ্রাম শহরের ‘বার্ডস আই ভিউ’ দেখা যায় এ টাওয়ার থেকে। এই অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশের আহ্ববানে প্রতি বছর অসংখ্য পর্যটক ছুটে আসেন এই লেকে।
ফয়’স লেকে উপভোগ করার মতো অনেক কিছুই আছে। বিশেষ করে বাচ্চাদের জন্য ফয়’স লেক একরাশ আনন্দের জায়গা। এখানে শিশুদের জন্য যেমন নানারকম খেলার ব্যবস্থা আছে, তেমনি বড়রাও খুঁজে পাবেন পাহাড়, লেক সব মিলিয়ে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। শিশুদের জন্য বেশ কিছু আধুনিক রাইড আছে এখানে। যেমন সার্কাস সুইং, বাম্পার কার, বাম্পার বোট, ফ্যামিলি রোলার কোস্টার, জায়ান্ট ফেরিস হুইল, ড্রাই স্লাইড, ফ্যামিলি ট্রেইন, প্যাডেল বোট, ফ্লোটিং ওয়াটার প্লে, পাইরেট শিপসহ মজাদার সব রাইড।
এখানে চলে বাম্পার বোট ও বাম্পার কারের ঠোকাঠুকির প্রতিযোগিতাও। পাশ দিয়ে সার্কাস ট্রেন ঝিকঝিক শব্দে চলে যায়। রঙবেরঙের ঘোড়ার ওপর বসে শিশু-কিশোররা মত্ত হয় আনন্দে। এ রাইডের নাম বেবি কেরাওসাল। তাদের জন্য রয়েছে ভিডিও গেমসও।
হ্রদটিকে কেন্দ্র করে দর্শনার্থীদের জন্য হ্রদে নৌকাভ্রমণ, রেস্তোরাঁ, ট্র্যাকিং এবং কনসার্টের আয়োজন করা হয়ে থাকে।
রোমাঞ্চকর বেজক্যাম্প
প্রকৃতি ও ঐতিহ্য দর্শনের পাশাপাশি রোমাঞ্চপ্রিয় পর্যটকরা তালিকায় রাখতে পারেন ফয়’স লেকের বেজক্যাম্প। এখানে রয়েছে শারীরিক ও মানসিক দক্ষতা বৃদ্ধির নানা কার্যক্রম। কয়েকটি গাছকে কেন্দ্র করে দলগত কার্যক্রম ‘ট্রি টপ অ্যাকটিভিটি’। রোমাঞ্চপ্রিয়দের জন্য পাঁচটি বাধা পেরোনোর ‘অন গ্রাউন্ড অ্যাকটিভিটি’। নেতৃত্ব বিকাশের জন্য ‘টিম বিল্ডিং গেম’। আরও আছে লেকের জলে কায়াকিংয়ের সুযোগ। তির-ধনুকের তালিম নিতে আর্চারি। লেকের এক পাশের গাছ থেকে অন্য পাশে যেতে পারেন ‘ওয়াটার জিপ লাইন’ করে। দৈত্যাকার দোলনা ও হ্যামকে দোল খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে।
দেশের যেকোনো জায়গা থেকে চট্টগ্রাম এসে সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিংবা গাড়িতে করে চলে যেতে পারেন ফয়’স লেকে। এখানে বেজক্যাম্পের কর্মকান্ড গুলো আলাদা আলাদাভাবেও করা যায়, তবে দিনব্যাপী কর্মকান্ড ও রাতযাপনের প্যাকেজ বেশি জনপ্রিয়।
বেজক্যাম্পে দিনভর
লেকের পাড় ধরে বেজক্যাম্পের পথ। ঢুকতেই অভ্যর্থনাকক্ষ ও রেস্তোরাঁ। ভ্রমণের ক্লান্তি কাটাতে এখানে কিছুটা জিরিয়ে নিতে পারবেন। এরপর দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে পাহাড়ি রাস্তা। সোজা পথ ধরে গেলে ‘ক্যাম্পিং হিল’। আর ডান দিয়ে ওপরে উঠলেই ‘অ্যাকটিভিটি হিল’।
কয়েক ধরনের রোমাঞ্চকর কর্মকান্ড দিয়ে সাজানো হয়েছে এই পাহাড়। শুরুতেই আছে ‘জিপ লাইন’। তবে এই কর্মকান্ড সব শেষে করুন। সেখান থেকে কিছুদূর সামনে এগিয়ে গেলেই দেখতে পাবেন ট্রি টপ অ্যাকটিভিটি ও অন গ্রাউন্ড অ্যাকটিভিটি।
এ দুই কসরতেই শারীরিক দক্ষতার পাশাপাশি মানসিক দক্ষতার পরিচয়ও দিতে হবে।
রোমাঞ্চকর আরেকটি সংযোজন হলো দৈত্যাকার দোলনা। সাধারণ দোলনার চেয়ে এটি কয়েক গুণ লম্বা। মাটি থেকে টেনে অন্তত ১০ ফুট উঁচুতে তুলে আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। দোল খেতে খেতে পাহাড়ের চূড়া থেকে উপভোগ করবেন চট্টগ্রাম নগরের সৌন্দর্য।
ক্যাম্পের অন্যতম আকর্ষণ জিপ লাইন। তারে ঝুলে লেকের জলের ওপর দিয়ে এপার থেকে ওপাওে যাওয়া। ছোটদের জন্য ক্যাম্প হিলের পাশেই চিলড্রেনস অ্যাকটিভিটি। সব অ্যাকটিভিটি ও দুপুরের খাবার শেষে জায়ান্ট হ্যামকে শুয়ে কাটাতে পারেন সুন্দর বিকাল। অথবা চাইলে লেকে কায়াক চালিয়েও দিনটি শেষ করতে পারেন।
রাতে থাকলে যা করবেন
বেজক্যাম্পের আসল সৌন্দর্য ফুটে ওঠে রাতে। ঝিঁঝিপোকার ডাক আর শিয়ালের হাঁকে তৈরি হয় রোমাঞ্চকর পরিবেশ। সন্ধ্যার পরই লেকের পাড়ে জ্বলে ওঠে ক্যাম্প ফায়ার। দলে দলে সেখানে বসে গানের আসর।
চাইলে এখানে বসেই কাটিয়ে দিতে পারেন পুরো রাত। অথবা তাঁবুতে ফিরে বিশ্রামও নিতে পারেন। চাঁদের আলোয় হালকা ট্র্যাকিংয়ের ইচ্ছা থাকলে চলে যেতে পারেন ‘ইনটু দ্য ওয়াইল্ড’ পাহাড়ে। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে প্রায় তিন কিলোমিটার আঁকাবাঁকা পথ। চাঁদের আলোয় প্রকৃতিতে ঘেরা এই পথ ধরে দিনের সব ক্লান্তি ভুলে হাঁটতে পারেন। দিনের সব অ্যাকটিভিটির সঙ্গে ক্যাম্পিং যোগ করলে জনপ্রতি খরচ হবে সাত হাজার টাকা। পরদিন সকাল পর্যন্ত থাকবে সব খাবারের ব্যবস্থা।
পর্যটকদের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে প্রতিটি রোমাঞ্চকর কর্মকান্ডের সময় কয়েকজন দক্ষ প্রশিক্ষক থাকেন। পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য দুই স্তরের নিরাপত্তা রয়েছে। পর্যটকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও সেবা দেওয়ার সব ব্যবস্থা এখানে করা হয়েছে।