এসব শহরগুলিতে যাবার পথে ট্রেন থেকে এবং শহরগুলিতে ঘোরাঘুরির সময় সড়কের পাশে দূর থেকে সুন্দরী রাইনের সাথে দৃষ্টি বিনিময় হয়েছে। তখনই মন আকুল হয়েছে তাকে আরও কাছে নিবিড় করে পেতে। খবর নিয়ে জানলাম, বন বা কোলন থেকে রাইন ভ্রমণের জন্য অনেকগুলি সংস্থা ‘রাইন রিভার ক্রুজ’ পরিচালনা করে। তারই সূত্র ধরে ১৬ অক্টোবর সকালে বনে এসে নদীবন্দর এলাকায় রিভার-ক্রুজ পরিচালনাকারী নামকরা সংস্থা ‘কেডি রাইন’র অফিসে আসি। তাদের রয়েছে কয়েক ঘণ্টা থেকে শুরু করে কয়েকদিনের ট্যুরের নানা ধরনের প্যাকেজ। শুধু সময় ও পার্সের সামর্থ্য অনুযায়ী টিকিট কেটে বিলাসবহুল ক্রুজশিপে উঠে পড়া। আমরা ৬ ঘণ্টা ট্যুরের একটা প্যাকেজ নিলাম- বন থেকে ‘কোবলেঞ্জ’ হয়ে ‘রিমাগন’ পর্যন্ত। দুপুরের লাঞ্চ ও অপরাহ্নের চা ট্যুর প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত।
রাইন ও দানিয়ুব ইউরোপের দুই বিখ্যাত নদী। এক সময় এই দুই নদী রোমান সাম্রাজ্যের সীমানা নির্ধারিত করত। বর্তমানে এটি শুধু রাইন ক্রুজকারীদের পুরানো দিনের ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখার অবলম্বন নয়, আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য ও মালামাল পরিহণের প্রধান নৌপথও।
সুইজারল্যান্ডের পার্বত্য অঞ্চলের হিমবাহুর গলিত ধারায় সৃষ্ট কনস্টান্স হ্রদ থেকে উৎপন্ন হয়ে প্রথমে সুইজারল্যান্ড ও জার্মানির সীমানা এবং পরে জার্মানি ও ফ্রান্সের সীমানা নির্দেশ করে এক সময় জার্মানির ভেতরে প্রবেশ করে। তারপর নেদারল্যান্ডের মধ্য দিয়ে ১৩০০ কিলোমিটার পথ পরিক্রমা শেষ করে উত্তর সাগরে মিলিত হয়। এই ১৩০০ কিলোমিটারের মধ্যে জার্মানির সীমানা ও ভেতর দিয়ে অতিক্রম করেছে ৮৫০ কিলোমিটার। জার্মানির ঐতিহ্য, সমৃদ্ধি ও শিল্প-সংস্কৃতিতে এই রাইন নদীর প্রভাব অপরিসীম। জার্মানির অনেক বিখ্যাত শহর রাইন নদীর তীরে অবস্থিত, তার মধ্যে মেইনজ, বিনগেন, গোটেনবার্গ, কোবলেঞ্জ, বন ও কোলন উল্লেখযোগ্য। এছাড়া এই নদীর তীরে রয়েছে আরও ছোট-বড় অনেক শহর।
বেলা ১১টায় আমরা আমাদের নির্দিষ্ট ক্রুজশিপে উঠি। আমরা দোতলার ডেকে উঠে বসি। সাথে আরও বহু বিদেশি ভ্রমণার্থী। তবে আমরা ছাড়া আর সকলই সাদা চামড়ার লোক। পরে দেখেছি, আমরাই একমাত্র তামাটে চামড়ার যাত্রী বলে জাহাজের ক্রু, ক্যাপ্টেন থেকে শুরু করে সকলের বিশেষ খাতির ছিল আমাদের প্রতি। বিশেষ করে শাড়ি পরা আমার স্ত্রী ছিল তাদের অন্যতম দ্রষ্টব্য। যাত্রা শুরুর আগে গাইড ফ্রান্স ও ইংরেজিতে আমাদেও ক্রুজ সম্পর্কে একটা ধারণা দেয় এবং আমাদের করণীয় ও অকরণীয় সম্পর্কে দিক-নির্দেশনা দেয়।
অল্পক্ষণের মধ্যেই যাত্রা শুরু হয়। শিপ উজানে এগোতে থাকে। দুপাশে ছোট বড় পাহাড়, কোনো কোনো পাহাড় বেশ উঁচু। নদীর দুই পাড়ের পাহাড়গুলির অবর্ণনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও অনবদ্য ল্যান্ডস্কেপের জন্য রাইন নদীর বিশ্বজোড়া খ্যাতি। তাই এই রাইন ভ্রমণে প্রতিবছর সারা বিশ্ব থেকে আসে অগণিত পর্যটক। ইউরোপের প্রধান ও আকর্ষণীয় ঋতু ‘অটাম’ বা শরৎ। এই সময়ে নামে পর্যটকদের ঢল।
আমাদের জাহাজ পূর্বতীর ঘেঁষে চলতে থাকে। এই তীরেই বেশি পাহাড় আর অরণ্য। পাহাড়ের বৃক্ষরাজি বা অরণ্যের দিকে তাকিয়ে দেখি নানা রঙে রঞ্জিত বৃক্ষের একটির পর একটি প্রাকৃতিক বাগান। বৃক্ষের রঙ কোথাও হালকা সবুজ, কোথাও ঘন সবুজ, কোথাও হালকা হলুদ বা ঘন হলুদ, কোথাও পিঙ্ক, কোথাও মেরুন। যেন সব আমাদের কৃষ্ণচূড়া পলাশের মতো রঙিন ফুলের গাছ; যেন কোনো শিল্পীর তুলিতে আঁকা দিগন্ত বিস্তৃত বিশাল ক্যানভাস। আসল ঘটনা হচ্ছে অটামের এই সময়ে গাছের পাতা পাকতে শুরু করে এবং এক সময় সম্পূর্ণ পেকে ঝরে যায়। যেহেতু সব গাছের পাতা একই সময়ে পাকে না, তাই পাকার তারতম্যে এমন দেখায়। এক একটা অংশে এক এক বর্ণের সমারোহ। প্রকৃতির এমন সৃষ্টি দর্শককে বাক-রহিত করে। মনে হলো আজ যে দৃশ্য দেখছি, মনের ক্যানভাস থেকে তা কোনোদিন মিলিয়ে যাবে না।
আবার এই বর্ণিল গাছপালা বা অরণ্যের ফাঁকে পাহাড়ের চূড়ায় বা ঢালে মাঝে মাঝে দেখি বড় বড় ক্যাসল বা দুর্গ। কোনো কোনো ক্যাসল ৭০০/৮০০ বছরের প্রাচীন। কালের সাক্ষী এই ক্যাসলগুলি ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে নানা কল্প-কাহিনি ও মিথ। জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখি ইতিহাসের উত্থান-
পতনের সাক্ষী এই ক্যাসলগুলি। দূর থেকে দেখেও বিষ্মিত হই কোনো কোনো ক্যাসলের অনুপম গথিক স্থাপত্যকর্ম।
এক সময় আমাদের দুপুরের খাবার পরিবেশন করা হয়। খাবার ছিল খুবই উপভোগ্য। আমরা রাইনের যে অংশে ভ্রমণ করছি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য সে অংশটিকে বলা হয় ‘রোমান্টিক রাইন’। তাছাড়া এই অংশে এবং এর আগে পিছে নদীর দুপাড়ে পাহাড়ের ঢালে রয়েছে বহু দ্রাক্ষাক্ষেত বা আঙ্গুরের বাগান। পাহাড়ের ঢালে ধাপে ধাপে আঙ্গুরের ক্ষেতগুলিও খুব দৃষ্টিনন্দন। এই আঙ্গুর থেকে জার্মানির বিখ্যাত বিয়ার তৈরি হয়।
বন ছেড়ে কিছুদূর আসার পর আমাদের বামে পড়ে প্রথম বড় শহর ‘কোনিগবিন্টার’, তারপর একে একে ‘বাদ হোনেফ’, ‘উঙ্কেল’ ও ‘লিঞ্জ’। লিঞ্জ একটি অতি প্রাচীন শহর, ‘লিঞ্জ ক্যাসেল’র জন্য বিখ্যাত। প্রায় চার ঘণ্টা চলার পর ‘বাদ হোন্নিনগেন’ শহরকে বামে রেখে আমাদের ক্রুজশিপ দিক পাল্টায়, আমরা আবার উল্টোদিকে রওনা দিই। এবার জাহাজ বাম তথা পশ্চিম তীর ঘেঁষে চলতে থাকে। এপাশে পাহাড় কম, মাঝে মাঝে উচ্চভূমিতে ছোট ছোট শহর গ্রাম।
আমরা জাহাজের ডেকে বসে দাঁড়িয়ে ক্লান্তিহীনভাবে উপভোগ করছি দুপাশের নদী তীরের দৃশ্য। ভাবি এ দেখা যেন শেষ না হয়। পথে আমরা আরও দুটি বড় শহর অতিক্রম করে বিকাল পাঁচটায় রিমাগন শহরে পৌঁছি। ঘাটে জাহাজ ভিড়ে। এখানে আমাদের অবিস্মরণীয় নৌবিহারের সমাপ্তি। জাহাজ থেকে নেমে রাইনকে বিদায় জানাই। তারপর সহযাত্রীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যে যার গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা করি।
লেখক: গবেষক ও পরিব্রাজক (অব. সরকারি কর্মকর্তা)