মো. জিয়াউল হক হাওলাদার:
২০১৫ সালে সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পার হয়ে এখন বিশ্ববাসীর আগামী ১৫ বছরের উন্নয়নের নীতি হচ্ছে- টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি)। টেকসই উন্নয়নের জন্য জাতিসংঘ আওতাভুক্ত বিভিন্ন সংস্থা কিছু নীতিনৈতিকতা যোগ করেছে। এ সংক্রান্ত বিষয়ে প্রকাশ করছে বিভিন্ন প্রকাশনা।
যেমন- জাতিসংঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থা প্রণয়ন করেছে গ্লোবাল কোড অব এথিক্স বা বিশ্বব্যাপী পর্যটন শিল্পে পালনীয় আচরণবিধি। এগুলো টেকসই পর্যটন উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত সব অংশীজনের (স্টেকহোল্ডার) জন্য প্রযোজ্য। পর্যটন শিল্পের অংশীজন হচ্ছেন- সার্ভিস প্রোভাইডার, ট্যুর অপারেটর, হোটেল-মোটেল-বোটেল এবং বারের মালিক, ট্র্যাভেল এজেন্সি, পর্যটক, সাইট ম্যানেজার, জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান, ট্রান্সপোর্ট মালিকসহ এরকম আরও ২০-২৫টি সেক্টর।
গ্লোবাল কোড অব এথিক্স পর্যটক অর্থাৎ সেবা গ্রহিতা এবং সেবা প্রদানকারী উভয়কেই মেনে চলতে হবে। যেমন- হোটেল-মোটেল-বোটেল এবং রেস্টুরেন্ট-বার-রিসোর্টের কাজে সার্ভিস প্রোভাইডারের মালিক শিশুদের ব্যবহার করবেন না। শিশুদের পর্যটন শিল্পে যৌন হয়রানিমূলক কাজে যুক্ত করবেন না। পর্যটকরা শিশুশ্রম ভোগ করবেন না। শিশুদেরকে যৌন হয়রানি করবেন না। পর্যটকদের কোনো অবস্থায় ট্যুর অপারেটর ঠকাবেন না, কোনো নারী পর্যটককে যৌন হয়রানি করবেন না।
টেকসই পর্যটন উন্নয়নের আরেকটি দিক হচ্ছে- প্রকৃতি-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ, স্থানীয় জনগণের আর্থিক উপার্জন এবং সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা। পর্যটকরা যখন কোনো ডেস্টিনেশনে বেড়াতে যাবেন, খেয়াল রাখতে হবে তারা যেন প্রকৃতির সামান্যতম ক্ষতি না করেন। এমন কাজ করবেন না, যা স্থানীয় সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করা হয়। এ জন্য বলা হয়েছে- ‘ট্র্যাভেল, ইনজয় অ্যান্ড রেসপেক্ট’।
আবার পর্যটকদের খেয়াল রাখতে হবে- ভ্রমণের সময় তাদের ব্যয় করা টাকায় যাতে স্থানীয় জনসাধারণেরও উপকার হয়। এ জন্য স্থানীয় সম্প্রদায়ের প্রস্তুত করা খাবার আস্বাদন ও স্যুভেনির কিনতে পারেন। এক্ষেত্রে যতটা কম দর কষাকষি করা উচিত। কারণ ২-৩ টাকা বেশি দামে স্থানীয় খাবার ও স্যুভেনির পর্যটকরা কিনলে টাকাটা সরাসরি স্থানীয় মানুষই পাচ্ছেন; যারা হচ্ছেন স্থানীয় পর্যটন আকর্ষণ, সম্পদের মালিক এবং বংশ পরম্পরায় এগুলো রক্ষা করে আসছেন।
বাংলাদেশে টেকসই পর্যটন উন্নয়নের জন্য বিশ্ব পর্যটন সংস্থার সঙ্গে ইতোমধ্যে অনেক কর্মসূচি পালন করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ২০১৭ সালের ১৬-১৭ মে চট্টগ্রামে দুদিনব্যাপী বিশ্ব পর্যটন সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় ‘ক্রাইসিস কমিউনিকেশন’ শীর্ষক সেমিনার ও ‘আন্তর্জাতিক টেকসই পর্যটন উন্নয়ন বর্ষ’ পালনের জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়। পরদিন ইউএনডব্লিউটিও’র ২৯তম কমিশন ফর সাউথ এশিয়া ও কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক সম্মেলন হয়। বাংলাদেশ এতে অনেক লাভবান হয়েছে। তখন চট্টগ্রাম বিভাগ নিয়ে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন একটি পিক্টোরিয়াল বই প্রকাশ করে।
ওই সেমিনারে ইউএনডব্লিউটিও’র তৎকালীন মহাসচিব ড. তালেব রিফাই তৎকালীন পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের হাতে ১০ হাজার ইউরোর চেক হস্তান্তর করেন দেশের ওয়াইল্ডলাইফ ট্যুরিজম উন্নয়নের জন্য।
ক্রাইসিস কমিউনিকেশন সেমিনারে বলা হয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে আছে। এর জাতীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার পরিকল্পনার সঙ্গে ট্যুরিজমকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এভাবে পর্যটন শিল্পের আশু বিভিন্ন দুর্যোগ সহজেই মোকাবিলা করা সম্ভব হবে এবং এটি টেকসই উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ইউএনডব্লিউটিও প্রণীত গ্লোবাল কোড অব এথিক্স বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রথমত এটিকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে এবং সরকারের আইন মন্ত্রণালয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মুদ্রণ করে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের কাছে পাঠিয়েছে। গ্লোবাল কোড অব এথিক্স বইটিতে পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষা করে পর্যটন উন্নয়ন, পর্যটন শিল্পে জোরপূর্বক শ্রম ও শিশুশ্রম বন্ধ, শিশুদের যৌন হয়রানি বন্ধসহ স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনসহ নানা বিষয় গুরুত্ব সহকারে স্থান পেয়েছে। এখানে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন, প্রতœবস্তুসহ পর্যটন আকর্ষণ রক্ষা, স্থানীয় জনসাধারণের পর্যটন শিল্পে অংশ্রগহণে জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং পর্যটন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জীবিকায়নের উদ্বুদ্ধকরণের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া টেকসই পর্যটন উন্নয়নের জন্য করণীয় বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
আচরণবিধিতে পশু-পাখির বংশবৃদ্ধির ব্যাঘাত বন্ধ করা, বহন ক্ষমতার বাইরে পর্যটকদের আমন্ত্রণ জানানোর ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া নারী, শিশু, বয়স্ক এবং প্রতিবন্ধীদের পর্যটন গন্তব্যে সহজ গমনাগমনের জন্য অবকাঠামোর সৃষ্টির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়েছে- কোনো পর্যটকের সঙ্গে সহিংস আচরণ থেকে বিরত থাকতে হবে। এরকম পরিবেশ তৈরি করতে হবে যাতে পর্যটক এবং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কেউ জাতি, বর্ণ, ধর্ম এবং লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার না হন।
বাংলাদেশের পর্যটন উন্নয়ন নীতিমালা ২০১০-এ টেকসই পর্যটন উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। আর এই টেকসই উন্নয়নের জন্য গ্লোবাল কোড অব এথিক্স বাস্তবায়নের নিদের্শনা রয়েছে বইটিতে।
আমরা যদি এই গ্লোবাল কোড অব এথিক্স মেনে চলতে পারি, তাহলে বাংলাদেশ টেকসই পর্যটন উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হতে পারবে। এছাড়া জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনেও একটি মডেল দেশ হতে পারবে।
লেখক: বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের কর্মকর্তা।