এলিজা বিনতে এলাহী:
মার্কিন সাহিত্য শহরখ্যাত আইওয়া থেকে যখন ভার্জিনিয়ার শার্লটসভিলে এসে পৌঁছালাম, মনে হলো রোমের কোনো পুরনো শহরে এসেছি। মনে হওয়ার কারণ, ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য থমাস জেফারসনের নকশার কেন্দ্রবিন্দু দ্য রোটুন্ডা, যা প্যানথিয়নের অনুরূপে তৈরি করা এবং কলেজ ভবনগুলির নিও-ক্লাসিক্যাল সম্মুখভাগগুলি জুলিয়াস সিজারের সময়কেই মনে করায়।
মার্কিন কমনওয়েলথ রাজ্য ভার্জিনিয়ার একটি স্বাধীন শহর শার্লটসভিলে। আমেরিকার তৃতীয় প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন ও পঞ্চম প্রেসিডেন্ট জেমস মনরোর বাসভূমি শার্লটসভিলে। পুরো শহর গড়ে উঠেছে বলতে গেলে ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়াকে ঘিরে। সাধারণ পর্যটক হিসেবে হয়তো আমি বেছে নিতাম না এই শহর ভ্রমণের জন্য। যাওয়ার পর বুঝেছি মার্কিনিদের জন্য দারুণ গুরুত্বপূর্ণ এই শহর ।
মার্কিন সরকারের আমন্ত্রণে ইন্টারন্যাশনাল লিডারশিপ প্রোগ্রাম ২০২২, সংক্ষেপে আইভিএলপি’র একজন সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম ২১ দিনের একটি প্রোগ্রামে। বাংলাদেশ থেকে ৫ সদস্যের একটি দলকে নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল আমেরিকার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি কীভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে কিংবা বলা যায় আমেরিকার সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে পরিচিত হওয়ার জন্য। আইভিএলপি প্রোগ্রাম পরিচালনা করছে আমেরিকা বিশ্বব্যাপী ১৯৪০ সাল থেকে। বাংলাদেশের কার্যক্রম শুরু হয়েছে ১৯৫২ সাল থেকে। অত্যন্ত গর্বের সাথে বলতে হয়, আইভিএলপি প্রোগ্রামের প্রথম সদস্য হয়ে মার্কিন মুল্লুকে পা রেখেছেন বঙ্গবন্ধু।
সারাদিনের অফিসিয়াল মিটিংয়ের পর চেষ্টা করেছি হেঁটে হেঁটে পুরো শহর ঘুরে বেড়িয়েছি। প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন ও প্রেসিডেন্ট জেমস মনরোর বাসস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ৫ সদস্যের বাংলাদেশকে দলকে। সব গল্প এই স্বল্প পরিসরে বলতে পারছি না। যেমন- দেখেছি শার্লটসভিলে শহরের টুকিটাকি, ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়া আর স্পেস মিউজিয়াম দেখবার আনন্দ ভাগ করছি সবার সাথে এই ভ্রমণ রচনায়।
শার্লটসভিলের রেলওয়ে স্টেশন
হোটেল থেকে খুব কাছেই, বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম। পুরো শহরটাই উঁচু নীচু। পাহাড় কেটে বানানো। বেশ কয়েকটি সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে রেলওয়ে স্টেশনে যেতে হয়। ছোট্ট গোছানো ছিমছাম পরিবেশ। অল্প কিছু যাত্রী অপেক্ষারত রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছিল আমাদেরও তো এরকম অনেক গোছানো স্টেশন ছিল। যতœ করে রাখলে সেগুলোও এরকম লাগতো। আমাদের পাকশী, চট্টগ্রাম রেলস্টেশন তো এর থেকেও সুন্দর! আমার দেশ হোক কিংবা ভিন্ন কোনো দেশের রেলওয়ে স্টেশন হোক। একটি স্মৃতি জমা করি রেলওয়ে স্টেশনের। ছবি তুলবার সময় মনে মনে ভাবছিলাম, কবে বিদেশি পর্যটকরা এসে আমাদের রেলস্টেশনের ছবি তুলবে আমার মতো!
ইউনিভার্সিটি অব শার্লটসভিলে
প্রেসিডেন্টস হাউজগুলো, শহরের বাইরে এবং ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস ভীষণ সবুজ। সেদিন আমাদের কোনো অফিস মিটিং ছিল না। ফ্রি টাইম আর কি। যে যার মতো শহর ঘুরে বেড়াতে পারবে। আমি বেছে নিলাম ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস। আমার কাছে মনে হলো, জেফারসনের স্থাপত্য প্রতিভার প্রশংসা করার সেরা সময় হলো সকাল।
ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় হল কমনওয়েলথ অব ভার্জিনিয়ার একটি সরকারি গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়। এটি শুধুমাত্র ভার্জিনিয়া নামেও পরিচিত। ১৮১৯ সালে টমাস জেফারসনের ঘোষণা অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইউনেস্কো ১৯৮৭ সালে ভার্জিনিয়াকে আমেরিকার প্রথম কলেজিয়েট বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের স্বীকৃতি প্রদান করে।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল গভর্নিং বডিতে ছিলেন জেফারসন, জেমস ম্যাডিসন ও জেমস মনরো। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় মনরো যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। পূর্বতন রাষ্ট্রপতি জেফারসন ও ম্যাডিসন ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দুই রেক্টর এবং জেফারসন নিজে অধ্যয়নের মূল পাঠক্রম নকশা করেন।
সকালের সময়টাতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্য দিয়ে হাঁটলে, আপনি এটি প্রায় নির্জন দেখতে পাবেন। ১৫/২০ মিনিট পর একজন দুজন মানুষের আনাগোনা টের পাওয়া যায়। সময়টা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রীষ্মকালিন বিরতি, তাই কাকপক্ষীরও দেখা পাওয়া যাচ্ছিল না। সেই বিশাল ক্যাম্পাসে কেবল আমি, উদ্ভিদ আর দ্রুপদী স্থাপনাগুলোই রয়েছি শুধু।
এই সময়, আপনি প্রধান লনে একা বসে থাকতে পারেন এবং জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট রোটুন্ডার নিখুঁত প্রতিসাম্য দেখে অবাক হতে পারেন।
মহাকাশগামী যান ‘Discovery’
প্রায় ফুরিয়ে এসেছে আমেরিকার ইন্টারন্যাশনাল লিডারশিপ প্রোগ্রাম-২০২২। শেষ ভিজিটিং শহর ছিল ভার্জিনিয়ার শার্লটসভিলে। সেখানে বিদায় জানাতে সশরীরে উপস্থিত হলেন আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে আইভিএলপি’র প্রোগ্রাম ম্যানেজার কার্লোস।
শার্লটসভিলে থেকে আমরা রওনা হয়ে ওয়াশিংটন এয়ারপোর্টে যাবো। বিদায়বেলায় কার্লোস বললেন ‘তোমাদের অবশ্যই ন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়ামটি দেখা উচিত। ‘When you are in Virginia, it is a must see destination’। স্পেস মিউজিয়াম পরিদর্শন আমাদের ওয়ার্কশপ লিস্টের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। উপরন্ত ওয়াশিংটন অবধি জার্নিটা লম্বা ছিল বিধায় গ্রুপের সবাই মনে মনে একটু নিমরাজি থাকলেও কেউই আপত্তি প্রকাশ করেনি। আমার মাঝেও সেরকম কোনো ভাবান্তর হলো না। কারণ উড়োজাহাজ কিংবা মহাকাশগামী যান, এসব আমি কিছু বুঝি না, আগ্রহও নেই। তবে মহাকাশ পর্যটন শুরু হয়েছে, যা পর্যটনের নতুন ভাবনার একটি ক্ষেত্র এবং তা শুধুমাত্র প্রথম বিশ্বের অল্প কিছু দেশের জন্য প্রযোজ্য।
মহাকাশ নিয়ে পরিবারে আগ্রহ আছে কেবল আমার ছোট ভাই ইমনের। ওর কাছেই অল্প বিস্তর শুনি যখন পারিবারিক আড্ডায় বসি। সত্যি কথা বলতে, স্পেস মিউজিয়াম নিয়ে গুগল করার পরও সেরকম আগ্রহ বোধ করিনি। কারণ ২১ দিনের পরিভ্রমণে বেশ কয়েকটি মিউজিয়াম খুব গভীরভাবে দেখেছি ও জেনেছি কাজের অংশ হিসেবে। কিন্তু স্বীকার করতে বাধা নেই, ভার্জিনিয়ার চ্যান্টিলিতে স্মিথসোনিয়ান এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়াম স্টিভেন এফ উদভার-হ্যাজি সেন্টারে স্পেস শাটল (মহাকাশ যান) পরিদর্শন আমাকে যারপরনাই মুগ্ধ করেছে। এত বড় বড় উড়োজাহাজ, মহাকাশ যান এক জায়গায় জড়ো করে পরিদর্শনের ব্যবস্থা করার পদ্ধতিটি দারুণ উৎসাহব্যঞ্জক।
রাইট ব্রাদার্সের প্রাচীনতম প্লেন থেকে শুরু করে আধুনিক প্লেন সবই আছে এখানে। আস্ত আকাশ যানগুলো রেখে দিয়েছে এখানে। সেই থেকেই বোঝা যাচ্ছে মিউজিয়ামের বিশালতা! মিউজিয়ামে আমি যে পথে ঢুকেছি, কিছু দূর যাবার পরই দেখলাম কনকর্ড। এটিকে অবশ্য অতিরিক্ত শব্দ দূষণের কারণে পৃথিবীতে বাতিল করা হয়েছে। কনকর্ড একবার বাংলাদেশে এসেছিল। তখন আমি ছোট। মনে আছে কেউ কেঊ গল্প করেছিল উত্তরার অনেক উঁচু বিল্ডিংয়ে দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছিল। কতটুকু সত্য ছিল জানি না।
পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট প্লেন, বোমাবাজ দীর্ঘ ফাইটার প্লেন, সব ধরনের মিসাইল, কি নেই এখানে! তবে সবচেয়ে ভালো লেগেছে ডিসকভারি দেখে। এটা মহাশূন্য পাড়ি দিয়ে এখন এই মিউজিয়ামে অবস্থান করছে।
ডিসকভারি সম্পর্কে এই কথ গুলো লেখা রয়েছে মিউজিয়ামে- সবচেয়ে বেশি সময় ধরে চলা অরবিটার, ডিসকভারি ১৯৮৪ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৩৯ বার উড়েছে। এটি যে কোনো মহাকাশ যানের চেয়ে বেশি মিশন সম্পন্ন করেছে— মহাকাশে মোট ৩৬৫ দিন ব্যয় করেছে। ডিসকভারির দীর্ঘ বছরের পরিসেবার হাইলাইটগুলির মধ্যে রয়েছে মীর স্পেস স্টেশনে প্রথম ডকিং মিশন, আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনের সাথে প্রথম ডকিং এবং হাবল স্পেস টেলিস্কোপ স্থাপন। ডিসকভারি প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান নারী কমান্ডার দ্বারা উড্ডয়ন করা হয়েছিল এবং প্রথম নারী মহাকাশ যানের পাইলট দ্বারা চালিত হয়েছিল।
ডিসকভারির সামনে মিনিট কুড়ি অকারণেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। মিউজিয়ামের আলো আধারিতে ভালো ছবি তুলতে পারছিলাম না, তার ওপর ডিসকভারির সামনে ছিল পর্যটকদের দারুণ ভীড়। মন ভরছিল না কিছুতেই। ডিসকভারির চারদিকে একবার ঘুরতেই তো ৫ মিনিট লাগে। সাথে থাকা জামিল ভাই তাড়া দিলেন- ‘আপা, একটিতে এত সময় দিলে, পুরো মিউজিয়াম কখন দেখবেন’। তাই তো!
ডিসকভারি দেখা শেষ হলে দেখলাম অ্যাস্ট্রোনাটদের চাঁদে ব্যবহার করা সেই স্পেস স্যুট। মিউজিয়াম থেকেই জানতে পারলাম, এ পর্যন্ত ১২ জন আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনাট চাঁদে পা রেখেছেন। অনেকে ভুল করে হয়তো ওই অ্যাপোলো ১১-তে আর্মস্ট্রং আর অলড্রিনই শুধু চাঁদে গিয়েছিলেন। এই মিউজিয়ামে আরউইনের (১২ জনের একজন) পুরো স্পেস স্যুটটা আছে।
প্রজাপতি ও মাকড়সাও মহাকাশ দর্শন করেছে। প্রজাপতিগুলো জিরো গ্র্যাভিটিতে তাদের পুরো লাইফ সাইকেল সম্পন্ন করেছে সফলভাবে, কোনো সমস্যা হয়নি। আর মাকড়সার ক্ষেত্রে দেখা হয়েছে এই ছোট্ট মাকড়সাগুলো জিরো গ্রাভিটিতে, একটা জাল পৃথিবীতে যেমনটা নিখুঁতভাবে তৈরি করতে পারে সেখানে পারে কিনা। দেখা গেছে প্রথম দিকে অসুবিধা হয়েছে, পরে সে নিজেই তৈরি করে নিয়েছে। মাকড়সা দুটোর নাম আনিতা এবং এরাবেলা।
স্পেস মিউজিয়ামের বর্র্ণনা এত অল্পতে শেষ হতেই পারে না। ঠিক মতো বর্ণনা করলে ছোট একটি বুকলেট তৈরি হয়ে যাবে! ফিরবার সময় সুভ্যেনির শপে ঢুঁ দিলাম। মনে মনে কার্লোসকে ধন্যবান জানালাম।
লেখক: পর্যটক ও শিক্ষক