পর্যটন বিচিত্রা ডেস্ক
অনুরোধের আতিশয্যে একটি পারিবারিক ভ্রমণ পরিকল্পনা করতে হয়েছে। অর্ধ শতাব্দী ধরে যাদের সাথে যোগাযোগ নেই, এমনই একগুচ্ছ আত্মীয় আমাদের খুঁজে বের করলো। এদের পুর্বপুরুষ (পুর্বনারীও বলা যায়) অভ্যন্তরীণ অভিবাসন প্রক্রিয়ায় বসতি স্থাপন করেছিল হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে। আমাদের পৈতৃক বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরার বেলাবো এলাকায়। আমরা যখন একেবারে শিশু, তখন আমাদের চাচাতো বোন বিলাতি বুছাব (বিলাতি বুবু- এই নামটাই আমরা জানতাম, অন্য কোনো নাম ছিল কিনা জানি না) এবং তার এক বোন সপরিবারে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন চুনারুঘাটে। আমাদের এলাকার অল্প জমি বিক্রি করে ওখানে বেশি জমি কেনা যেতো। অভিবাসনের এটাই ছিল কারণ।
১৯৭০ সালের দিকে একবার আমি ওই বাড়িতে গিয়েছিলাম বেড়াতে। এরপর অনেক বছর পেরিয়েছে। বুড়িগঙ্গার পানি অনেক কলুষিত হয়েছে। জীবনের সকাল, দুপুর, বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। শরীর শিথিল আর ভারী হয়েছে। মাথার ওপর চুলের সংখ্যা এবং রঙয়ে পরিবর্তন এসেছে। এর মাঝেই এই ঘটনা। আমাদের চাচাতো বোন-দুলাভাইগণ অন্য জগতে পাড়ি জমিয়েছেন। উনাদের কন্যারা এবং তদীয় পুত্র-কন্যারা আমাদের খুঁজে বের করলো এবং চেপে ধরলো। একবার যেতেই হবে বেড়াতে। দিনরাত ফোন করে ওরা আমাদের উত্যক্ত করতে লাগলো। অবশেষে ভালোবাসার ‘অত্যাচারে’ অতিষ্ঠ হয়ে চুনারুঘাট বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম। আমরা অনেক ভাইবোন। মাত্র তিন দুগুণে ছয়জন রাজি হলো যেতে। আমার বড়ভাই আর আমি সস্ত্রীক, আর আমার ছোটবোন মিনি সস্বামীক।
একটা ভাড়া করা মাইক্রোবাস নিয়ে সকাল সকাল রওনা দিলাম ছয়জন। দীর্ঘ শ্মশ্রুম-িত চালক হর্ন বাজানোতে পারদর্শী, অন্য চালকদের মতোই। অনেকদিন আগে দাপ্তরিক কাজে কলম্বো গিয়েছিলাম, দেখা হয়েছিল বৃটিশ নাগরিক জেরি ক্লুয়েটের সাথে। কথায় কথায় জানা গেল- বাংলাদেশে যাওয়া না হলেও নেপালে ছিলেন পাঁচ বছর। ওখানে অবস্থানের সময়ে যে বিষয়টি তার কাছে সবচেয়ে লক্ষণীয় মনে হয়েছে তা হলো, নেপালের ড্রাইভাররা খুব বেশি হর্র্ন বাজায়। ‘বাংলাদেশের ড্রাইভাররাও কি একই রকম?’ জেরির জিজ্ঞাসা। আমার জবাব ইতিবাচক। হর্ন বাজানো তো ড্রাইভারদের প্রধান বিনোদন।
এক সপ্তাহের প্রোগ্রামে জাপানে গিয়েছিলাম। পুরো সময়ের মাঝে একজন বাস ড্রাইভারকে একবার হর্ন বাজাতে শুনেছি, ব্যাক গিয়ার দিতে গিয়ে। জাপানি ড্রাইভারের বোকামিতে বাংলাদেশ আর নেপালের ড্রাইভাররা নিশ্চয়ই হাসবে। হর্ন না বাজালে গাড়ি চালানোর আনন্দ কোথায়?
নরসিংদী গিয়ে মনে পড়ল- আত্মীয় বাড়িতে নেয়ার জন্য আগের দিন যে মিষ্টি কিনেছিলাম ওগুলো রেখে এসেছি। কিছুক্ষণ দোষারোপ চললো। তারপর সিদ্ধান্ত হলো নাশতা খাওয়ার জন্য যেখানে থামবো, ওখান থেকেই মিষ্টি কিনে নেবো। নাশতার বিরতি আশুগঞ্জের উজান ভাটি হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে। ভালোই। আমাদের সঙ্গী নারীদের সবার পরনে ছিল শাড়ি। অচেনা একটা মেয়ে এগিয়ে এসে বললো- ‘আপনারা সবাই শাড়ি পরেছেন? খুব সুন্দর লাগছে আপনাদের’। মেয়েটির পরনে ছিল সালোয়ার কামিজ। শাড়ি কি এভাবে দর্শনীয় বস্তুতে পরিণত হবে?
মিষ্টি কিনে, প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত যোগ আর বিয়োগ শেষে আবার রওনা। সরাইল মোড় পার হওয়ার পর রাস্তায় যানবাহন কমতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর মাধবপুর। অর্ধ শতাব্দী আগে যখন এসেছিলাম, মাধবপুর তখন ছিল ছোট্ট একটা বাজার। এখন রীতিমতো শহর। আরও কিছুদূর এগিয়ে পানসি হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে সংক্ষিপ্ত স্বাস্থ্য বিরতি। আবার সচল গাড়ির চাকা। এবার তেলিয়াপাড়া। সীমান্তসংলগ্ন একটি রেলস্টেশন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তেলিয়াপাড়ার নাম অনেক শুনেছি।
সিলেট বিভাগে হলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পার্শ্ববর্তী জেলা হবিগঞ্জে মূল সিলেটের প্রাকৃতিক, নৈসর্গিক বৈচিত্র্য পুরোপুরি দেখা যায় না। তবু চা বাগানের মাঝখান দিয়ে চলতে গিয়ে পুরোনো কথাটাই আবার মনে পড়লো- Journey is more important than the destination. দুই পাশে চোখ জুড়ানো সবুজ। রাস্তায় যানবাহনের ভিড় নেই। কোলাহল দূষিত ঢাকা থেকে বেরিয়ে এসে কিছু সময়ের স্বস্তি।
চুনারুঘাট কলেজ গেটে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর দেখা মিললো আমাদের এস্কোর্ট টিমের। এখান থেকে আরও পনেরো কিলোমিটার দূরে যেতে হবে গ্রামের ভেতরে। টিম লিডার সাদেকের গাড়ি অনুসরণ করে চললাম। রাস্তা বেশ খারাপ। এটুকু পথ পাড়ি দিতে লাগলো প্রায় এক ঘণ্টা।
গিয়ে দেখি এলাহি কাণ্ড। বাড়ির উঠানে শামিয়ানা টানানো, আর ডেকোরেটরের চেয়ার টেবিল সাজানো; একেবারে বিয়ে বাড়ির মতো। ছয়জন অতিথিকে আপ্যায়নে আরও প্রায় ষাটজন পার্শ্ব অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এ বাড়ির মালিক থাকে সৌদি আরবে। তার পরিবার এবং বর্ধিত পরিবারের সদস্যরা এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এখানকার চেয়ারম্যান, মেম্বার, হেড মাস্টার, গণ্যমান্য সবাই এখানে আমন্ত্রিত।
চুনারুঘাট উপজেলার এই জায়গাটার নাম গাজীপুর। এখান থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে ভারতের সীমান্ত। কথাবার্তায় বোঝা গেলো- অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় পার হয়ে গেলেও পূর্বপুরুষদের অভিবাসী তকমাটা এখনো ওদের গায়ে লেগে আছে। এখানেই জমিজমা, চাষবাস, ব্যবসা-বাণিজ্য।
স্থানীয় পরিবারে ছেলেমেয়ের বিয়ে দিয়ে সম্পর্ক স্থাপন করে জনস্রোতের মূলধারায় যুক্ত হবার প্রয়াস। এতকিছুর পরও স্থানীয় অস্থানীয় ভেদরেখাটা ঘোচেনি। ‘ওদের কোনো সমস্যা হলে আমরা ওদের পাশে থাকি’। চেয়ারম্যান সাহেব একথা বলে প্রচ্ছন্নভাবে বুঝিয়ে দিলেন মাঝে মাঝে সমস্যা হয়।
বোঝাই যাচ্ছে খাবারের আয়োজনে বাড়াবাড়ি ছিল। দ্বিপদ, চতুষ্পদ, জলচর প্রাণিজ আমিষ ছাড়াও শাকসবজি, ভর্তা-ভাজি, পোলাও, সাদা ভাত, দই-মিষ্টি কোনোকিছু বাদ যায়নি। ব্যাপক সাধাসাধি, চাপাচাপির মাঝে ভোজন পর্ব শেষ হলো।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য হবিগঞ্জ। ওখানেই রাত্রি যাপনের আয়োজন। ভ্রমণ আর ভোজনে ক্লান্ত শরীর। কিন্তু মেজবানদের বায়নার শেষ নেই। এক পল্লী ডাক্তারের বাড়িতে যেতে হলো চা খেতে। ফেরত পথে চুনারুঘাট শহরের কাছে বিলাতি বুছাবের মেয়ে মাজেদার বাসায় যেতেই হলো। মাজেদার ভাষ্যমতে এক কিলোমিটার, আদতে শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে।
এর মাঝে হবিগঞ্জের সাংবাদিক শোয়েব চৌধুরী কয়েকবার খোঁজ নিয়েছেন আমাদের। অতি সজ্জন এই ভদ্রলোকের কথা আমি কখনো ভুলবো না। উনার সাথে আমার সরাসরি কোনো পরিচয়ও নেই। আমার অফিস থেকে হবিগঞ্জে রাত্রি যাপনের জন্য হোটেল বুকিংয়ের অনুরোধ জানানো হয়েছে উনাকে। প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি আন্তরিকতায় উনি সে অনুরোধ রক্ষা করেছেন।
হবিগঞ্জ পৌঁছাতে সন্ধ্যা পার হলো। সোনার তরী হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখ শোয়েব চৌধুরী। চেক-ইনের আনুষ্ঠানিকতা সারলেন উনিই। এরপর অপ্রত্যাশিত একটি অনুরোধ। রাতের খাবার খেতে হবে উনার বাসায়। অনেক আপত্তিতেও কাজ হলো না। নৈশভোজ উনার বাসায়ই।
আড়াই ঘণ্টার মাঝে কেনাকাটা, রান্নাবান্না সেরে চমৎকার আয়োজন করলেন এই দম্পতি। ভাবির আতিথেয়তা অসাধারণ। এত অল্প সময়ের নোটিশে এতগুলো মানুষ খাওয়ার জন্য হাজির- কোনো বিরক্তি ছাড়া শতভাগ আন্তরিকতায় আপ্যায়ন করালেন সুস্বাদু ঘরোয়া ব্যঞ্জনে। গল্প করলেন, ছবি তুললেন যেন কত কাছের পরমাত্মীয়। আজ আমাদের আত্মীয় দিবস। পুরোনো আত্মীয় বাড়িতে বেড়ালাম, নুতন আত্মীয়ের খোঁজ পেলাম। ঢাকার বাইরে এসেছি। একটা দর্শনীয় স্থান দেখে যাওয়া উচিৎ। শোয়েব ভাইয়ের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত হলো, কাল ফেরার পথে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান দেখে যাবো। রাতে হোটেলে ফিরলাম। এভাবেই কাটলো একটি আপ্যায়নমুখর দিন।
সকালে নাশতা করে রওনা হলাম। সাতছড়ি পৌঁছাতে ঘণ্টাখানেক লাগলো। পর্যটকের ভিড় মোটামুটি। সেন্ট মার্টিন বা সুন্দরবনের করমজলের মতো এত কোলাহল নেই। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে একটা পায়ে হাঁটা সেতু পার হলাম। নিচে পানি নেই। বর্ষার সময় পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয়। এই জলধারাগুলোকেই বলা হয় ছড়া বা ছড়ি।
গাছের ছায়াঘেরা পথ ধরে হাঁটা সব সময়ই আনন্দের। সুন্দরবন, রাঙামাটি, চিম্বুক, লাওয়াছড়ার সবুজ বনানী কখনোই ক্লান্তিকর, একঘেয়ে মনে হয় না। একবার বেড়িয়ে এলে আবার যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আজ এই সাতছড়ির উদ্যানে এসে ভিন্ন একটা অনুভূতি জাগলো মনে। এই উদ্যানের যারা অধিবাসী-বৃক্ষ-লতা, ফুল-পাখি, সাপ-ব্যাঙ, বানর- এরা কত স্বাধীন, স্বনির্ভর! এই উদ্যান ওদের নিজস্ব আবাসভূমি। এখানকার মাটি, পানি, বাতাস, সূর্যালোক ওদের আহার জোগায়। কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। মানুষের অহেতুক আনাগোনা ওদের জন্য বিরক্তিকর। মানবজীবনের জটিলতা ওদের স্পর্শ করে না। উন্নত প্রযুক্তি, আর্থসামাজিক উন্নয়ন, মাথাপিছু আয়, রাজনীতি, কূটনীতি, যুদ্ধ, শান্তি আলোচনা, জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক ওদের জীবনে অপ্রাসঙ্গিক। মানুষেরও যদি হতো এমন একটি হানাহানিমুক্ত শান্তির জীবন!
সাতছড়িতে আমাদের অবস্থান দীর্ঘ হয়নি। মূলত পথ ধরে হাঁটা আর ছবি তোলার মাঝেই সীমিত রইলো আমাদের ভ্রমণ। একটা অবজারভেশন টাওয়ার আছে। আর রয়েছে এক ঘণ্টার একটা ট্রেইল। ষাটোর্ধ বয়সি আমাদের এই দলের সবাই অতটা শক্ত সমর্থ নয়। ওসবের মাঝে আর যাওয়া হলো না। এবার ফেরার পালা। সাতছড়ি ছেড়ে ছয়জন রওনা হলাম ঢাকার পথে। পেছনে পড়ে রইলো আত্মীয় পরিজন আর উদ্যানের সুখী অধিবাসীরা।