লেখকঃ মো. আমানুর রহমান – ভাইস প্রেসিডেন্ট, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড
নানাবিধ কারণে আমরা সাইকেল চালাই। যেমন-সুস্বাস্থ্যের জন্য, মানসিক স্বাস্থ্যকে ভালো রাখতে, দূরবর্তী এলাকায় যেতে; আপনাকে গাড়ি ভাড়া করতে হবে না এবং আপনি দূরবর্তী এলাকাগুলি ঘুরতে পারেন যেখানে গাড়ি দিয়ে সম্ভব নাও হতে পারে। আরও কত কি, কলেবর বাড়বে বলে লিখছি না আর।
আমাদের আশপাশে হাজার হাজার লোক সাইকেল চালাচ্ছেন। এদের শতকরা ৯৫ জনই আসলে কম্যুট করার জন্য চালান, মানে হলো বাসা থেকে অফিস বা বাজার বা সন্তানের স্কুল। পর্যটনের জন্য সাইকেল চালান কতজন? আমার মনে হয় না আমাদের দেশে এই ২০২৩ সালে সচল সাইকেল পর্যটকের সংখ্যা সব মিলিয়ে ২০০ জনের বেশি। আসলে ইচ্ছে থাকলেও অনেকে নানান পারিপার্শ্বিকতায় আর সাইকেল পর্যটক হয়ে উঠতে পারেন না।
ধরুন, আপনি কুয়াকাটায় সাইকেল চালাতে চান কিন্তু আপনার নিবাস ঢাকায়। একভাবে আপনি যেতে পারেন, ঢাকা থেকে টানা পদ্মা পাড়ি দিয়ে ৩০০ কিলো চালিয়ে কুয়াকাটা গেলেন অথবা আরেকভাবে পারেন, ঢাকা থেকে পটুয়াখালী লঞ্চে গেলেন, ওখান থেকে চালালেন, তাতে ৭০ কিলো চালানো হবে। আর আপনি গড় পড়তা ১০০ কিলো হয়তো চালাতে পারেনও কিন্তু মনে করছেন ৩০০ কিলো আপনার জন্য অসম্ভব। এখন এই যে লঞ্চে সাইকেল নেবার প্রক্রিয়া কি আপনার জানা?
আবার ধরুন, আপনি শ্রীমঙ্গলে চা বাগানের নিসর্গে সাইকেল চালাতে চান কিন্তু ঢাকা থেকে চালিয়ে শ্রীমঙ্গল আপানার পক্ষে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তাহলে উপায়? উপায় গাড়িতে করে সাইকেল শ্রীমঙ্গল নিয়ে যাওয়া তারপর সেখানে চালানো। গাড়িতে নিয়ে যাওয়া কি সহজ কোনো কাজ? সাইকেলের পার্টস খুলে বক্স করো, তা না হয় ঢাকায় কোনো মেকানিক্স করে দিল, কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছে আবার সেই পার্টস জোড়া দিয়ে পুনরায় সাকেল বানানো, না জানলে কম ঝামেলার ব্যাপার না।
সাইকেল খোলা, লাগানো, পরিবহণ এসব কাজে একা একা নানান ঝক্কি আর খরুচে ব্যাপার। তাহলে আমরা যারা ঘুরছি কীভাবে ঘুরছি? সেটা বলার জন্যই আজকের লেখা। সাইকেল চালানোর জন্য নানান গ্রুপ আছে। অধিকাংশই ফেসবুকভিত্তিক গ্রুপ। বিডি সাইক্লিস্টের নাম হয়তো অনেকেরই জানা। এমনি নানান সাইক্লিং গ্রুপ আছে, তাদের মধ্যে বহুল পরিচিত কয়েকটা যেমন হেমন্ত সাইক্লিস্ট, এসডিসি, হলিডে, সাইক্লিস্ট১, খুলনা সাইক্লিস্ট আরও কত নাম যে আছে। এদের সিংহভাগ ঢাকাভিত্তিক। তবে ঢাকার বাইরে এলাকাভিত্তিক নানান গ্রুপও এখন সক্রিয়।
এসব গ্রুপ কেউ নিয়মিত আবার কেউ অনিয়মিত দূর দূরান্তে রাইড পরিচালনা করে। ওদের সাথে ট্যাগ থাকলেই ব্যাস কোনো গন্তব্য আপনার পছন্দ হলে চলে যেতে পারবেন। প্রতিটা গ্রুপেই আছে নিরলস স্বেচ্ছাশ্রমিক, তারাই আপনাকে সাহায্য করবে সব কিছু শিখে নিতে। গ্রুপগুলোর মধ্যে হেমন্ত সাইক্লিস্ট ঢাকার বাইরে নিয়মিত আর সবচেয়ে বেশি রাইড পরিচালনা করে থাকে। গড়ে প্রতিমাসে হেমন্ত সাইক্লিস্টের একটা লং রাইড থাকে। ইতোমধ্যে তাদের ৬১টি এমন লং রাইড হয়ে গেছে। এমনকি তারা দেশের বাইরেও রাইড পরিচালনা করে থাকে। আগ্রহী যে কেউ হেমন্ত সাইকিস্টের ফেসবুক গ্রুপে নিজেকে অ্যাড করে নিতে পারেন।
ওরা কীভাবে বিষয়টা ম্যানেজ করে? ধরুন হেমন্তের লং রাইড #৬২ যাবে উত্তরবঙ্গে আগামী মে মাসে। সেটা কয়দিনের ট্যুর, আনুমানিক খরচ, রুট ইত্যাদি ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়। এখন হাজার হাজার মেম্বার সবাই তো আর যাবে না, আগ্রহী যারা তাদের নিয়ে একটা আলাদা ফেসবুক গ্রুপ খোলা হয়। সাধারণত এসব রাইড ছুটির দিনগুলিতে নন-এসি বাসে করা হয়। ধরা যাক, যাবার দিন ২ মে বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় পলাশী থেকে রওনা হয়ে রংপুর শুক্রবার সকাল ৮টায় পৌঁছানোর টার্গেট রুটে চালানোর পরিকল্পনা। তাহলে সবাই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে সাইকেল নিয়ে হাজির হবে। স্পটে সাইকেলের বক্স রাখা থাকবে। সামনের চাকা, স্যাডেল, হান্ডেলবার আর প্যাডেল খুলে পুরো সাইকেল বক্সবন্দি করা হবে।
আপনি নিজে পারলে ভাল, না পারলেও সমস্যা নেই, যিনি পারেন তিনি আপনাকে দেখিয়ে দেবেন একদম বিনা পারিশ্রমিকে, অবশ্য এর বিনিময়ে আপনি এক কাপ চা খাওয়াতে নিশ্চয়ই মাইন্ড করবেন না। এভাবেই একটার পর একটা বক্স হতে থাকবে। সাধারণত এক গাড়িতে ৩৬ জনের ব্যবস্থা হয়। তাতে ৩০টি সাইকেল বক্স করে ছাদে দেওয়া হয় আর বাকি ছয়টা সাইকেল বক্স ছাড়া পেছনের সিটে রাখা হয়। বক্সগুলো ছাদে উঠানোর সময় নিজেরা নিজেরাই স্বেচ্ছাশ্রমে উঠিয়ে আবার কাজ শেষে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় যাতে বৃষ্টি বা কুয়াশায় ভিজে না যায়। একটা সাইকেল এভাবে বক্স করতে সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ মিনিট লাগবে।
এরপর হইহুল্লড় করতে করতে পিকনিক আমেজে আপনার সাইকেল সমেত গাড়ি ছেড়ে দিল। আপনি ফিরে গেলেন আপনার সেই কৈশোর তারুণ্যের দিনগুলিতে। পথে কোথাও সবাই মিলে যার যেমন সামর্থ্য খেয়ে নিলেন। এরপর লম্বা ঘুম, পরদিনের জন্য শক্তি সঞ্চয়। মহান আল্লাহর কৃপায় সকালেই পৌঁছে গেলেন রংপুর। সবাই মিলে বক্স ছাদ থেকে নামিয়ে সাইকেল আবার জোড়াতালি দিতে হবে। কাল কিন্তু আপনি নভিস ছিলেন, আজ দেখা যাবে আপনি ৯০ ভাগ কাজ নিজেই পারছেন বাকিটা হয়তো কারো সাহায্য লাগবে। সবার সাইকেল চালানোর জন্য রেডি। খালি বক্সগুলো আবার বাসে সযতেœ তুলে রেখে সকালের নাস্তা সেরে সেই মহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষা। উত্তরবঙ্গে যে আমার প্যাডেলের আগে চলেনি। এ যেন কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের মতো কিংবা প্রথমবার সমুদ্র বা পাহাড় দেখার মতোই অনুভূতি।
রাইড লিডার সবাইকে ডেকে নির্দেশনা দিলেন কোন পথে কোথায় আমরা যাব, কোথায় ব্রেক নেব আর রাতটাই বা কোথায় কাটাবো। ধরা যাক, লালমনিরহাটে রাত্রিবাস। তাহলে সবাই মিলে রংপুর থেকে লালমনিরহাটের পথে এক লাইনে শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে রাইড লিডারের নেতৃত্বে চালানো শুরু হবে। রাতে আগেই ফিক্সড করা লালমনিরহাটে কোনো সাশ্রয়ী হোটেলে সবাই মিলে থাকা। এরপর খাওয়া দাওয়া আড্ডা ঘুম। পরদিনের টার্গেট ধরা যাক পঞ্চগড়। তাহলে বাস চলে যাবে পঞ্চগড় আমাদের ঢাকা ফেরত আনার জন্য। আমরাও সবাই লালমনিরহাট থেকে নির্ধারিত পথে সবাই মিলে পঞ্চগড় চলে যাব। রোববার সবার অফিস ধরার তাড়া। তাই শুরুর মতো শেষের যাত্রায় কোনো ঢিলেমি থাকে না। সাথে দুদিন টানা সাইকেল চালানোয় সবাই ক্লান্ত। সবাই মিলে আবার সাইকেল বক্সিং আবার যথারীতি সকালে পলাশী নেমে আনবক্সিং, এরপর সবাই যার যার মতো আপন নীড়ে ফেরায় ব্যস্ত। পেছনে পড়ে থাকে দারুণ সব সুখস্মৃতি। কয়েকদিন চলে ফেসবুকে পোস্ট আর মেসেঞ্জার গ্রুপে কথার ফুলঝুরি।
এভাবে কয়েকটা রাইড দিলে তখন দেখবেন এরাই আপনার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। বউ ছেলেমেয়ে সব পর! আর সন্দেহের দৃষ্টিতে অন্যরা তাকায়, বুড়ো বয়সে লোকটাকে কি ভীমরতিতে ধরল! আসল কথাই তো বলা হয় নাই। খাওয়া দাওয়া বাদে আসা যাওয়া থাকা মোট খরচ ২৫০০ টাকার মধ্যেই থাকবে আশা করা যায়, সাথে আনন্দ থাকবে লাখ টাকার। একবার ভাবুন তো, সাইকেল ছাড়া ২৫০০ টাকায় পারবেন চার পাঁচটা জেলা ভ্রমণ করতে? উত্তর আমি দিয়ে দিই- অসম্ভব, সাথে আনন্দ থাকবে অফুরন্ত… যা টাকার মানদ-ে মূল্যায়ন করা অসম্ভব। নারীরা ভুল বুঝবেন না, আপনাদের জন্যও ব্যবস্থা আছে। আমাদের সাথে অনেক সময়েই নারী সাইক্লিস্টরাও থাকেন। তাদের যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা সবাই মিলেই করা হয়।
সবকিছু সামলে নেয়া শুরুতে একটু কঠিন, আগাম কিছু প্রস্তুতির দরকার হয়। সে সংক্রান্ত কয়েকটা টিপস-
১) পরিবারকে সময় দিন, কোথাও ঘুরতে নিয়ে যান, যাতে ওই সময় বাগড়া না দেয়।
২) টুকটাক সাইকেল মেরামতের কাজ শিখে ফেলুন।
৩) ধীরে ধীরে নিজের সক্ষমতা বাড়ান, গতিতে ও দূরত্বে। এখন যদি ১৮ কি.মি প্রতিঘণ্টা গতিতে ৩০ কিলো যেতে পারেন, চেষ্টা করুন দুই মাসে ২০ কিমি প্রতিঘণ্টা গতিতে ৫০ কিলোমিটার যেতে।
৪) ভালো সঙ্গী নির্বাচন করুন। তার সাথে সময়ে অসময়ে বের হয়ে যান আশপাশে।
৫) শুক্রবারের গ্রুপ রাইড মিস করবেন না।
৬) যেখানে যাচ্ছেন সে এলাকা সম্বন্ধে কিছু ধারণা নিয়ে নিন।
৭) অবশ্যই হেলমেট আর গ্লাভস পরুন।