মো. আমানুর রহমান
বন, পাহাড়, সাগর, নদী, খাল-বিল, হাওড়, মেঠোপথ এমনকি ধানক্ষেতও আমাকে টানে, প্রাকৃতিক সবকিছুই টানে। তবে পছন্দের ক্রমানুসারে নিশ্চিতভাবেই বন আর পাহাড় সবার ওপরে। সাইকেল নিয়ে ঘোরার সুযোগ পেলে তো কথাই নেই! হলিডে রাইডার্স তাদের পরবর্তী ইভেন্ট রেমা-কালেঙ্গা ঘোষণা করার পরই আমি যোগাযোগ করে নামটা লিস্টে যোগ করাই। বলে রাখা ভালো- সব সাইক্লিস্টের জন্য রেমা-কালেঙ্গা ভ্রমণ স্বপ্নের আর রোমাঞ্চের।
অনেক অপেক্ষার পর ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর সাইকেলে করে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে রাত ১টায় আমাদের যাত্রা শুরু হয়। ভোর সাড়ে ৪টার দিকে মাধবপুরে হোটেল হাইওয়ে ইনে যাত্রাবিরতি করি। কিন্তু অত ভোরে পথে ডাকাতের কথা মনে হওয়ায় কিছুটা আলো না আসা পর্যন্ত সেখানেই থাকার সিদ্ধান্ত হয়। হালকা নাস্তা সেরে আর ফজরের নামাজ শেষে সকাল ৬টায় হাড় কাঁপানো শীতে আমাদের স্বপ্নের ভ্রমণের শুরু। এই সাইকেল সফরে শীত থেকে বাঁচার জন্য কত জন যে কত প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেছিল; এর মধ্যে একটার কথা না বলে পারছি না। মোজার স্বাভাবিক ব্যবহার পা সুরক্ষার জন্য হলেও কান সুরক্ষায় যে এটি সমান দক্ষ এই ভ্রমণে না গেলে তা অজানাই থেকে যেত।
একটু পর আমরা ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে ছেড়ে হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের রাস্তা ধরলাম। ৫/৬ কিলোমিটার পার হতেই শুরু হলো দিগন্তজোড়া চা বাগান। চা বাগানে এর আগে আমার কখনো রাইড দেয়া হয়নি; সেই অভিজ্ঞতারও পরিপূর্ণতা পেল। কুয়াশার চাঁদর ভেদ করে চা বাগানের ছায়াবৃক্ষের পাশ দিয়ে রবি মামা যখন হামা দেয়া শুরু করল আমরা ভুলে গেলাম প্যাডেল চালানো। সেই দৃশ্য ধারণে ক্যামেরা পুরোপুরি অক্ষম, মানসচক্ষেই তা কেবল উপভোগ্য। পাহাড় সমুদ্র নদীতে অনেক সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, সুন্দরবনেও সূর্যোদয় দেখেছি। কিন্তু চায়ের ঘন সবুজ কার্পেটে মোড়ানো টিলাগুলোর পেছনের সূর্যোদয়ের দৃশ্য আমি নিশ্চিত আপনাকেও বাকরুদ্ধ করে দেবে। এর একটু পর সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে জলবিয়োগের বিরতি দিয়ে আবার আমাদের শুরু করি। আমাদের গন্তব্য কালেঙ্গা ফরেস্ট বাংলো। ইট-পাথরের রাস্তা আর মেঠো পথ পেরিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম স্বপ্নের সিঁড়ির দোরগোড়ায়।
বয়স একটু বেশি হওয়ার সুবিধা অনেক সময়ই পাই। এখানেও সরোয়ার ভাইয়ের রুম বন্টনে ব্যতিক্রম হয়নি। হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা সেরে আমাদের ট্রেইল শুরু হয়। উঁচু নিচু টিলায় বনজঙ্গলের ভেতর আমাদের পরবর্তী টার্গেট রেমা। একটু পর পর পাহাড়ি আপহিল, ডাউনহিল, ঝিরিপথ। গিয়ারের সঠিক ব্যবহার শেখার আদর্শ স্থান হলো রেমা-কালেঙ্গা রাইড। ঢাকায় যেখানে ২-৪, ৫, ৬ বা ৩-৬, ৭, ৮-এ চালাতে অভ্যস্ত সেখানে ১-২, ৩ চালানো বা চালাতে অভ্যস্ত হওয়া বেশ কঠিন। গিয়ার চেঞ্জে একটু সময়ের হেরফের হলেই চেইন ড্রপ করবে। আমার ক্ষেত্রে দুইবার হয়েছেও।
গাইড ছাড়া অনুমান নির্ভর পথে ১৪ জন কিশোর, তরুণ যুবা আর বৃদ্ধ ঠিকই পৌঁছে গেলাম রেমার অভীষ্ট লক্ষ্যে। সেখানে জুমার নামাজ সারলাম। পাছে শকুনের অভয়ারণ্য দেখতে গিয়ে ফিরতে সন্ধ্যা হয়- সেই ভয়ে সাবধানতার জন্য আমরা রেমা থেকেই আবার ফিরে আসি। ফিরতে ফিরেতে প্রায় বিকাল।
সত্যি সত্যিই পুরোটা পথ ছিল অসাধারণ রোমাঞ্চে ভরা। আপনি রাঙামাটি বান্দরবান বা খাগড়াছড়িতে কিছু দূর পরপর টংয়ে চা খেতে পারবেন, কলা, পেঁপে আনারস খেতে পারবেন। কিন্তু রেমা-কালেঙ্গায় এসবের কোনো কিছুই আশা করবেনই না। চাহিদা মোতাবেক খাবারদাবার আপনার সাথেই নিতে হবে। অবশ্যই শুকনো খেজুর আর পানি সাথে রাখবেন। পুরো রেমা-কালেঙ্গা আপনি প্রচুর প্রাকৃতিক ভূগর্ভস্থ পানির স্বতঃস্ফূর্ত প্রসবণ দেখতে পাবেন। তারই একটার সাহায্য নিয়ে সাইকেলের কাঁদা পরিষ্কার আর লুবিং করা হয়।
অন্যারা রাইড দিয়েই ফিরে আসে, আমাদের এই রাইডের বিশেষত্ব ছিল রাতে কালেঙ্গায় অবস্থান। কোলাহলবর্জিত নির্জনতা উপভোগের জন্য রেমা-কালেঙ্গা অদ্বিতীয়। তাছাড়া পার্বত্য জেলাগুলোর মতো অনেক পর্যটকের ভিড়ও এখানে নেই। আমাদের সব খাবারদাবারের বন্দোবস্ত বাংলোতেই ছিল। সন্ধ্যায় ঝাল পেঁয়াজ আর পিঁয়াজু ছোলার মুড়িমাখা খেতে খেতে বনের নির্জনতা উপভোগও ছিল দারুণ অভিজ্ঞতা। ধূলিকণাহীন পরিবেশে নির্মল আকাশে যখন অগণিত তারকা দেখছি তখনই দেখি চাঁদের বুড়িও ভরা পূর্ণিমায় অপার্থিব সৌন্দর্য নিয়ে হাজির। রাতের খাওয়া শেষে চাঁদের আলোতেই মুরগির বারবিকিউ খেয়ে রুমে ফিরে এক ঘুমে সকাল। সকাল ৬টার পর রওনা দিয়ে হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ জেলা স্পর্শ করে রাজধানীর বাসায় যখন রাত ৯টায় পৌঁছাই তখন ১৭০ কিলোমিটার রাইড হয়ে গেছে!
লেখক: ভাইস প্রেসিডেন্ট, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড