পর্যটন বিচিত্রা ডেক্স
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি হাকালুকি হাওড়টি বছরের বিভিন্ন মৌসুমে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে। মাছের জন্য প্রসিদ্ধ এই হাওড়ে শীতকালে অতিথি পাখিদের আগমনে মুখরিত হয়ে উঠে। প্রতিবছর শীতের সময় প্রায় ২০০ প্রজাতির বিরল অতিথি পাখি আসে এই হাওড়ে। শীতকালে পাখির কলকাকলিতে নতুন ছন্দ পায় হাকালুকি হাওড়। তা ছাড়া, সারা বছরই দেশীয় প্রায় ১০০ প্রজাতির পাখির দেখা মিলে।
বর্ষাকালে আবার নতুন রূপ লাভ করে হাকালুকি হাওড়। চারদিকে অথই পানি, তার মধ্যে মাঝিদের নৌকার দৃশ্য হাকালুকিকে দেয় নতুন শোভা।
প্রতিবছর অক্টোবর মাসের শেষের দিকে হাকালুকি হাওড়ের পানি কমতে থাকে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে হাকালুকি হাওড়ে পানি শুকিয়ে গেলেই পরিযায়ী পাখিরা ভিড় জমায়।
অতিথি পাখির মধ্যে বালিহাঁস, ভুতিহাঁস, গিরিয়া হাঁস, ল্যাঞ্জা হাঁস, গুটি ইগল, কাস্তেচড়া, কুড়া ঈগল, সরালি, পানভুলানি, কালিম, টিটি, পেডি উল্লেখযোগ্য। দেশীয় প্রজাতির নানা পাখির মধ্যে রয়েছে- ছাড়া সাদা বক, কানি বক, পানকৌড়ি, চিল, বাজ ইত্যাদি।
হাওড়ে সকালে ও বিকালে পাখিদের ওড়াউড়ি বেশি দেখা যায়। হাওড়ের সবখানে পাখিদের খাবার রয়েছে। তাই পাখিরা এক জায়গায় দল না বেঁধে বিচ্ছিন্নভাবে পুরো হাওড়ে অবস্থান করে।
হাওরের বিস্তীর্র্ণ ভূমি, বিলনির্ভর মানুষের জীবনযাত্রা এবং অথিতি দেখতে মানুষ ছুটে চলছে হাকালুকির পানে।
পুরো হাওর দর্শৃনের জন্য রয়েছে একাধিক ওয়াচ টাওয়ার। সেসব ওয়াচ টাওয়ারে চড়ে হাওরের রূপলাবণ্য দর্শন করতে পারেন অনায়াসে। অথবা হাওড়ের বুকে জেগে উঠা জলাবনের নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন।
হাওড় ভ্রমণের সময়
হাকালুকি হাওড় ভ্রমণের উপযুক্ত সময় এপ্রিল-অক্টোবর। তবে অতিথি পাখি দেখতে চাইলে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে যেতে হবে। এই সময় হাওড়ের চারপাশ অতিথি পাখির কোলাহলে মুখর হয়ে থাকে। আর বর্ষাকালে হাওড় সমুদ্রের রূপ ধারণ করে। তাই বর্ষাকালে হাওড়ের মজা নিতে চাইলে জুন-আগস্টে আসতে হবে।
কীভাবে যাবেন
সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, মহাখালী থেকে বাসে প্রথমে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া বা বড়লেখায় যেতে হবে। কুলাউড়া, জুড়ি অথবা বড়লেখা থেকে অটোতে করে চলে যেতে পারেন হাকালুকিতে। ট্রেনে করে আসতে চাইলে কমলাপুর কিংবা বিমানবন্দর স্টেশন থেকে সিলেটগামী ট্রেনে চলে আসতে হবে কুলাউড়া রেল স্টেশনে। সেখান থেকে অটোতে করে চলে যেতে পারেন হাওড়ে। তবে হাকালুকি যাওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো ঢাকা থেকে উপবন এক্সপ্রেসে উঠে নামতে হবে মাইজগাঁও স্টেশনে। এটি সিলেটের ঠিক আগের স্টেশন। মাইজগাঁও থেকে দুটি উপায়ে যাওয়া যায় হাকালুকি।
ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার হয়ে: মাইজগাঁও নামার পর গাছপালা ঘেরা একটা রাস্তা ধরে প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার। আবার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার যাওয়া যায়। বাজাওে নেমেই নৌকাঘাটে চলে আসুন। এবার নৌকায় উঠে কুশিয়ারা নদী পাড়ি দিয়ে হাওড়ে ঘুরে বেড়ান। কুশিয়ারা পাড়ি দিতে প্রায় ৪০ মিনিট লাগবে।
গিলাছড়া বাজার হয়ে: কুশিয়ারা নদীর ৪০ মিনিট সেভ করতে মাইজগাঁও থেকে সরাসারি ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে চলে আসতে পারেন গিলাছড়া বাজারে। এখান থেকেই হাওড় শুরু। তবে সমস্যা হলো এখানে বড় নৌকা পাওয়া যায় না। নৌকা আনতে হবে সেই ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার থেকেই।
সিলেট থেকে যাওয়ার উপায়: সিলেট বাসস্টেশন থেকে বাস/মাইক্রোবাস/প্রাইভেটকার/অটোরিকশায় করে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদও যেতে হবে। সময় লাগবে ৪০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা। সেখান থেকে অটোরিকশায় করে গিলাছড়া জিরো পয়েন্ট যেতে হবে। সদর থেকে দূরত্ব প্রায় ৬ কিলোমিটার। সিলেট থেকে সরাসরি মাইক্রোবাস/প্রাইভেটকার ভাড়া করেও যেতে পারেন।
কোথায় থাকবেন
রাত যাপনের জন্য হাকালুকি ভ্রমণ শেষ করে সিলেটে ফিরে আসাই ভালো। কারণ সেখানে রাতে থাকার ভালো ব্যবস্থা নেই। মৌলভীবাজার শহরে বেশকিছু ভালো মানের হোটেল আছে। শ্রীমঙ্গল ও নিকটবর্তী উপজেলার আশপাশে বেশ কয়েকটি রিসোর্ট আছে। অবশ্য জলাভূমির ইজারাদারদের কটেজে থাকার অনুমতি চাওয়া যেতে পারে।
এছাড়া ফেঞ্চুগঞ্জ জেলা পরিষদের ডাক বাংলোতে অবস্থান করতে পারেন। ফেঞ্চুগঞ্জ সারকাখানর আওতাধীন ভিআইপি সুবিধা সংবলিত রেস্ট হাউস রয়েছে। এছাড়া পার্শবর্তী উপজেলা শহর বড়লেখায় রাত থাকতে পারেন।
হাওড় পাড়ে ক্যাম্পিং
শীতকাল হলে শুকনো বিস্তীর্ণ ভূমিতে তাঁবু বানিয়ে রাত কাটানো যেতে পারে। এই ক্যাম্পিং অভিজ্ঞতা আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ক্যাম্পিংয়ের পাশাপাশি বার বি কিউয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বর্ষা-শীত দুই ঋতুতেই হাকালুকির নানান জাতের তাজা মাছ ভোজনে তৃপ্তি দেবে। তবে শীতকালে হাকালুকি যাওয়ার আগে ক্যাম্পিংয়ের সরঞ্জাম নিয়ে যেতে হবে।
খাবার-দাবার
খাবারের ক্ষেত্রে চাল-মাছ-মুরগি সাথে নিয়ে গিয়ে এলাকার শ্রমজীবী মানুষকে টাকা দিলে পছন্দমতো রান্না করে দেবে। নৌকায় উঠার আগে কী আনতে হবে সে বিষয়ে মাঝিদের সাথে কথা বলা যেতে পারে। এরপর প্রয়োজন মতো বাজার করে নৌকায় উঠা যেতে পারে। কিছু টাকার বিনিময়ে নৌকার মাঝিই সুন্দর করে রান্না করে দিতে পারেন। নৌকায় উঠার সময় বিশুদ্ধ পানি, বিস্কুট, চিপস, চানাচুর, বাদাম ও পাউরুটির মতো শুকনো খাবার সাথে নিয়ে উঠা উচিৎ। এছাড়া ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারে স্থানীয় কিছু রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এতে প্রয়োজনীয় খাবার পাওয়া যায়।
ভ্রমণে সঙ্গে নিন
ক্যাম্পিং করার জন্য তাঁবু, রেইন কোট, বড় ব্যাকপ্যাক, শীতের সময় গেলে জ্যাকেট, কাদা-পানিতে চলন উপযোগী জুতা, গামছা, বাইনোকুলার, ক্যামেরা, প্রয়োজনীয় ব্যাটারি, পাওয়ার ব্যাংক, শুকনো খাবার, টর্চ এবং প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম।