মার্জিয়া লিপি
প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা বন, হাওড় আর প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় কাজ করার জন্য নানান রূপে বাইক্কা বিল দেখেছি। পেশাগত জীবনের শুরুতে বন বিভাগে এবং পরবর্তী সময় ইউএসএআইডিতে কাজ করার কারণে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং শ্রীমঙ্গল ও সিলেটের বিভিন্ন জাতীয় উদ্যান, অভয়ারণ্য, হাওড়, জলাশয়, বিল ও অভয়াশ্রম ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে কাজ করার কারণে শীত আর গ্রীষ্ম দুই মৌসুমেই বাইক্কা বিলকে দেখার সুযোগ হয়েছে। শ্রীমঙ্গলে নির্ধারিত কাজ শেষে রাধানগরের নিসর্গ ইকো কটেজ থেকে ঢাকায় ফেরার পথে রওনা হই বাইক্কা বিলের উদ্দেশে। জেলা সদর মৌলভীবাজার কিংবা শ্রীমঙ্গল থেকে বাইক্কা বিল যেতে কোনো স্থানীয় পরিবহণ নেই। পর্যটকদের যেতে হয় ভাড়া গাড়িতে। শ্রীমঙ্গল-মৌলভীবাজার সড়ক এবং হাজীবাজার থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে বাইক্কা বিল অভয়াশ্রম। গাড়িচালক শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে সকাল ৮টায় রওনা করে বাইক্কা বিলে পৌঁছাই তখন ঘড়ির কাঁটায় ৯টা বাজতে ২০ মিনিট বাকি। সমাজভিত্তিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংগঠন বা আরএমওর তৌহিদ ভাই হাজীবাজার থেকে আমাদের সঙ্গী হলেন। আরএমও অফিস থেকে মাত্র পাঁচ টাকা প্রবেশ মূল্যের বিনিময়ে বিলে প্রবেশ করা যায়। প্রবেশ তোরণ থেকে পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে রওনা হয়েছি পাখি দেখতে। দর্শনার্থীদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার সুবিধার্থে বিলের কাছে নির্মাণ করা হয়েছে একটি দ্বিতল অবজারভেশন টাওয়ার। ওয়াচ টাওয়ার থেকে ঘন সবুজ বন ও পুরো বিলের নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
সময়টা ছিল বসন্তকাল। অফিসের পেছনে কয়েকটি শিমুল গাছের গাঢ় লাল রঙের ফুল সবুজ ঘাসে পড়ে আছে। অসাধারণ দৃশ্য। হিজল আর করচ গাছের মাঝখান দিয়ে সরু রাস্তা পেরিয়ে কিছুটা দূরে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। দর্শনার্থীদের পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে উঠার জন্য গুনতে হয় ২০ টাকা আর নৌকা ভ্রমণ করতে চাইলে ঘণ্টায় দিতে হয় ৬০ টাকা। টাওয়ারে দূরবীক্ষণ যন্ত্রে কিছুটা দূরে জলাশয়ে পাখি দেখা যায়। দূরে থাকা বিভিন্ন আকারের ছোট বড় পাখিগুলোর রঙ এমনকি কয়েক রঙা পালকের রঙও দূরবীক্ষণ যন্ত্রের কল্যাণে স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যায়। সবুজ রঙের শাপলা ফুলের পাতায় পাখি বসে আছে, কোনোটি বা উড়ে কিছুটা দূরে গিয়ে লাল শাপলার পাশে বসছে। দূরবীক্ষণ যন্ত্রে বিভিন্ন রঙের পাখির ঝুঁটির নড়াচড়া স্পষ্ট দেখতে সে কি আশ্চর্য আনন্দ!
শীত আর গ্রীষ্ম- এই দুই মৌসুমে এই বিলের প্রকৃতির রূপ সৌন্দর্য দুই ধরনের। নৈসর্গিক প্রকৃতির দৃষ্টিজুড়ে সবুজের হাতছানি। তাই সারা বছর ধরে বিলের নৈসর্গিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন প্রকৃত পর্যটকরা। প্রকৃতির এমন রূপ মাধুর্যে সহজেই আকৃষ্ট করে তাদের। বর্ষায় দুই চোখজুড়ে থৈ থৈ পানি। বিশাল জলরাশির মাঝখানে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে জেগে থাকে সবুজ পত্রপল্লবের হিজল, করচ আরও নাম না জানা নয়নকাড়া সবুজ জলজ বনের রাজ্য। শীত মৌসুমে একেবারে বিপরীত দৃশ্য। থৈ থৈ করা দিগন্তজোড়া পানি শুকিয়ে জেগে উঠে শুধু সবুজ ঘাসের মাঠ। হিজল-করচের গাছের মাঝখান দিয়ে রাস্তা চলে গেছে দূরে গালিচার মতো সবুজ মাঠে। তখন পুরো হাওড়জুড়ে গরু-মহিষের বাতান। আর হাওড়ের বিলে খাদ্যের সন্ধানে অবাধ বিচরণ নানা জাতের দেশি ও অতিথি পাখির।
বিলের পাড়ে সবুজ ঘন বন, নানা জাতের গাছ আর জলজ উদ্ভিদের জন্যও এই বিল উদ্ভিদ জীব-বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। বিলের পাড় ও কূলঘেঁষে হিজল, করচ, নলখাগড়া, ঢোল কলমি আর ফুল ও লতাগুল্ম। কুচুরিপানা, শাপলা ও পদ্ম, ওকল, মাখনা আর সিংড়ার বিশাল সাম্রাজ্য বাইক্কা বিল। স্থায়ী নিবাস গড়া পাখি আর পোকা-মাকড়ের ডাক ও ঝিঁ-ঝিঁ শব্দে বিস্তীর্ণ বিলের নিস্তব্ধতা ভেঙে সৃষ্টি করে অতিপ্রাকৃত ভিন্ন আমেজ। প্রকৃতি যেন এখানে একে অপরের সাথে মিলেমিশে মিথষ্ক্রিয়ায় তৈরি করেছে সমৃদ্ধ একটি ইকো সিস্টেম বা বাস্তুসংস্থান।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি মৌলভীবাজার জেলার চা-সমৃদ্ধ শ্রীমঙ্গল উপজেলায় বাইক্কা বিলের অবস্থান। শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওড়ের পূর্বদিকের প্রায় ১০০ হেক্টর আয়তনের একটি জলাভূমি এই বাইক্কা বিল। নয়নাভিরাম প্রকৃতির এই বিলের আয়তন ৪২৫ দশমিক ১৫ বর্গকিলোমিটার। বিলটি অসংখ্য অতিথি পাখির কলতান আর বিল্রপ্তিপ্রায় দেশি মাছ ও পাখির অনন্য একটি দর্শনীয় স্থান। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয় বাইক্কা বিলকে মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত অতিথি পাখি আর দেশি নানা জাতের ছোট বড় মাছ ও পাখির নিরাপদ আবাসস্থল এটি। বাইক্কা বিলে পর্যটকদের মূল আকর্ষণ নানা জাতের পাখি।
শীতের মৌসুমে এই বিলে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে আসা অতিথি পাখিদের অবাধ বিচরণ আর কলকাকলি নজর কাড়ে পর্যটকদের। শীত মৌসুমে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সকাল-সন্ধ্যায় পাখি দেখতে বাইক্কা বিলে সমাগম ঘটে পাখিপ্রেমীদের। এই সময়ে বিলে পর্যটকদের মূল আকর্ষণ নানা জাতের ও বর্ণের পাখি দেখা। বিলের সর্বত্র পানকৌড়ি, কানিবক, ধলাবক আর গোবক পাখির সরব উপস্থিতি মুগ্ধ করে সবাইকে। গেওয়ালা বাটান, মেটেমাথা টিটি আর কালাপাখ ঠেঙ্গীর দেখা মিলবে অহরহ। এই বিলের নিয়মিত অতিথি পাখির নাম পান ভোলানি। বিপন্ন তালিকায় থাকা পালাশী কুড়া ঈগল পাওয়া যাবে এই বিলে। এশীয় অঞ্চল থেকে আসা গুটি ঈগলকেও নিশ্চিন্ত মনে উড়তে দেখা যাবে বিলে। বিলের অন্যান্য পাখির মধ্যে, দাগি রাজহাঁস, খয়রা চখাচখি, উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস, পাকড়া কোকিল, নীল-লেজ সুইচোরা, পাতি আবাবিল, দাগি ঘাসপাখি, বাংলা শকুন, পাতিচ্যাগা উল্লেখযোগ্য।
মাঝে মধ্যে দেখা মেলে ধুপনি বক ও রাঙা বকের। বিলের প্রবেশপথে ও দক্ষিণ পার্শ্বে দেখা যাবে লম্বা পায়ের পাখি দলপিপি আর নেউপিপি। বিলের পশ্চিমে দেখা যাবে পান মুরগি ও বেগুনি কালেম। কোথাও দেখা যাবে কালামাথা কাস্তেচরা কাদামাটি ঘাটছে।
মাছ ও পাখি ছাড়াও বাইক্কা বিলে পর্যটকদের বিমোহিত করবে জলজ প্রকৃতির সাহচর্যে জন্মানো নয়নাভিরাম সব ফুল ও লতাগুল্ম। বিলের কূলঘেঁষে দেখা মিলবে হাজারো পানা, শাপলা ও পদ্ম। পরিসংখ্যানে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, বাইক্কা বিল প্রায় ৯০ প্রজাতির মাছ ও ১৬০ প্রজাতির পাখির অভয়াশ্রম। আইড়, মেনি, কই, ফলি, পাবদা, বোয়াল, রুই, গজারসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আছে এখানে। শুধু মাছই নয়, নানারকম দেশি আর পরিযায়ী পাখিরও অভয়াশ্রম এই বিল। এছাড়া সন্ধ্যায় বিলে দেখা যাবে বিচিত্র আকৃতির ড্রাগন ফ্লাই বা ফড়িং। জীবনের অধিকাংশ সময় পানির নিচে কাটানো এই প্রাণী পরিণত বয়সে পানির ওপর উঠে পতঙ্গ আকৃতি ধারণ করে।
বাইক্কা বিলের ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত থাকা সমাজভিত্তিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংগঠন বড়গাঙ্গিনা সদস্যদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ইকো সিস্টেম সমুন্নত রাখতে প্রচেষ্টা প্রতিনিয়ত অব্যাহত রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা ও সচেতনতার প্রয়োজন। হাওড়ে মাছ বৃদ্ধির জন্য বেশি করে গভীর অভয়াশ্রম ও পাখির নিরাপদ নিবাসের জন্য বনায়নের গুরুত্ব রয়েছে। স্থানীয় গ্রামবাসীর প্রচেষ্টা এবং প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধতায় পাখিদের নিরাপদ বসবাস অনেকটাই নিশ্চিত হচ্ছে। সমাজভিত্তিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংগঠনের সদস্যরা পালাক্রমে পাহারার মাধ্যমে পরিবেশ সচেতনতামূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন। উচ্চস্বরে কোলাহল অথবা মাইক, বিদ্যুতের জন্য জেনারেটর এসব কিছুর ব্যবহার নিরুৎসাহিত করে যাতে পাখিদের নিরাপদ আবাস বিঘিœত না হয়।
অতিথি পাখির মৌসুমে সংগঠনের সদস্যদের পাহারা সত্ত্বেও স্থানীয় একটি চক্র সুযোগ পেলেই পাখি শিকারে তৎপর হয়ে উঠে। এসব কারণে প্রতিবছরই অতিথি পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। অতিথি পাখি ছাড়াও বছরজুড়ে অনেক মাছ শিকারি দেশি পাখির দেখা মেলে। পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে, বিল এলাকার জলাভূমিতে মাছ ধরা এবং বোরো ধান চাষের মৌসুমে মানুষের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় অতিথি পাখিদের আবাসস্থলের নিরাপত্তা বিঘিœত হয়। ফলে পরবর্তী বছরে ওই জায়গায় তারা আর আসতে চায় না। এ কারণেই পাখির আনাগোনা কমতে থাকে। অনিরাপদ আবাসস্থল আর খাদ্য সংকট মূলত এ দুইটি বিষয় পাখি কমবেশি হওয়ার অন্যতম কারণ। এসব কারণে বিলের জীব-বৈচিত্র্য ও প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে। বিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধরে রাখতে সবার প্রচেষ্টা ও সচেতনতার প্রয়োজন। পরিকল্পিতভাবে সরকার এবং স্থানীয় জনগণের প্রচেষ্টায় কেবল এই প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ করা সম্ভব।
প্রতিবেশ পর্যটনের লক্ষ্যে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা বা পর্যটন সুবিধা উন্নয়ন প্রয়োজন। বাইক্কা বিলের সমৃদ্ধ জীব-বৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে নিসর্গবিদ, প্রকৃতিপ্রেমী, পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানকর্মী, শিল্পী, সাহিত্যিক, পাখি বিশেষজ্ঞ ও মিডিয়াকর্মী, শিক্ষাবিদ ও শিক্ষার্থীরা শিক্ষাসফর ও বিভিন্ন রকমের অ্যাডভেঞ্চার ভ্রমণ করে থাকেন।
ঢাকায় ফেরার পথে ঘণ্টা দুয়েক থাকার পরিকল্পনা নিয়ে রওনা হয়েছিলাম শ্রীমঙ্গল থেকে বাইক্কা বিলে। পাখির কলকাকলি আর লাল শাপলার রঙে কখন যে সময় পেরিয়ে যায়! নৌকায় ঘুরে আরও কিছুক্ষণ কাটিয়ে রওনা করি অবশেষে ঘড়ির কাঁটা যখন বারোটা পেরিয়ে একটার ঘরে পৌঁছে যায়। কিন্তু মনে হয় চোখের পলকে পেরিয়ে যায় আমাদের রঙিন সময়। অনেকবার দেখার পর যেন আবারো দেখার তৃষ্ণা জেগে থাকে মনে; মনে মনে বলি আবারো দেখা হবে ফুল আর পাখির সাথে, আরেক ফাল্গুনে।
ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
বর্ষাকাল হাওড়াঞ্চল ভ্রমণের সবচেয়ে আদর্শ সময়। তবে যদি নানা পজাতির পাখির কলকাকলিতে মুখর হতে চান তাহলে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে ভ্রমণ করতে পারেন।
যাওয়ার উপায়
শ্রীমঙ্গল-মৌলভীবাজার সড়কে অবস্থিত কালাপুর বাজার হয়ে বরুনা-হাজিপুর পাকা রাস্তা ধরে হাজিপুর বাজারে যেতে হবে। স্থানীয়দের কাছে এই বাজারটি ঘাটেরবাজার নামে পরিচিত। ঘাটেরবাজার থেকে যেকোন স্থানীয় যানবাহন কিংবা পায়ে হেঁটে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হাইল হাওড়ে যেতে পারবেন।
কোথায় থাকবেন
হাইল হাওড়ের কাছেই শ্রীমঙ্গলের অবস্থান। আর শ্রীমঙ্গলে বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে।