পর্যটন বিচিত্রা প্রতিবেদন
ভবনটির সামনে দৃষ্টিনন্দন সুদৃশ্য বিশাল সিংহ দুয়ার। এর উপরে অতিকায় এক ঘড়ি-যা ঘন্টাধ্বনী বাজিয়ে আজও সঠিক সময় জানান দিয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে সুউচ্চ প্রাচীর ও পরিখার বেষ্টনী, দেশী-বিদেশী দুস্প্রাপ্য বৃক্ষরাজি, ইটালিয়ান গার্ডেনে শ্বেতপাথরের ভাস্কর্য শোভিত দৃষ্টিনন্দন বিশাল এ রাজপ্রাসাদ।
দৃষ্টি নন্দন প্রবেশদ্বার ছাড়াও এখানে রয়েছে মোট ১২টি ভবন। এগুলোর মধ্যে প্রধান রাজপ্রাসাদ, কুমার প্যালেস, প্রধান কাচারী ভবন, রাণীমহল, রান্নাঘর, মটরগ্যারেজ, ড্রাইভার কোয়ার্টার, ট্রেজারি বিল্ডিং ও সেন্ট্রি বক্স উল্লেখযোগ্য।
রাজ প্রাসাদের দক্ষিণে রয়েছে ফুলের বাগান। এ বাগানটি ইটালিয়ান গার্ডেন নামে পরিচিত। দেশী-বিদেশী নানাজাতের ফুলে পরিপূর্ণ এ বাগান। বাগানের ভিতর শ্বেতপাথরের আকর্ষণীয় ৪টি নারীর ভাস্কর্য সবাইকে মুগ্ধ করে।
রয়েছে একটি ইতালিয়ান ঐতিহ্যের ফোয়ারা এবং লৌহ ও কাঠ দ্বারা নির্মিত বেঞ্চ আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, একটি ডিম্বাকার সাইজের মার্বেল পাথরের নির্মিত আসনসহ মঞ্চ। সমগ্র বাগানে অসংখ্য ফুলের সমাহার। আছে পারিজাত, নাগালিঙ্গম, কর্পুর, এগপ্লান্ট, হৈমন্তীর মত দুষ্প্রাপ্য সব বৃক্ষরাজি আর কৃত্রিম ঝর্ণা।
দিঘাপতিয়া রাজ বাড়ির মূলপ্রাসাদটি একতলা। এর মাঝে রয়েছে প্রশস্ত একটি হল রুম। বেশ উঁচু হলরুমের শীর্ষে রয়েছে বিশাল এক গম্বুজ। এ গম্বুজের নিচ দিয়ে হলরুমে সূর্যের আলো প্রবেশ করে। হলরুমের মাঝে রাজার আমলে তৈরি বেশ কিছু সোফা রয়েছে।
এছাড়াও হলরুমে একটি ব্যতিক্রমী কারুকার্য খচিত সোফা রয়েছে যাতে একসঙ্গে চারজন চারমুখী হয়ে বসা যায়। হলরুমের আসবাবপত্র এখনো রয়েছে। উপরে রয়েছে সেই আমলের ঝাঁড়বাতি। হলরুমের পাশে রয়েছে আরেকটি বড় ঘর। পাশের রান্নঘর হতে এ ঘরে সরাসরি আসা যায়। নিরাপত্তার জন্য রান্নাঘরের করিডোরের দু’পাশে রাজ আমলের তার দিয়ে এখনো ঘেরা রয়েছে। এর পাশে একটি ঘরে রয়েছে সিংহাসন। এর পাশের ঘরটি রাজার শয়ন ঘর। এ ঘরে এখনো রাজার খাট শোভা পাচ্ছে ।
কুমার প্যালেসের পেছনের ভবন রাজার কোষাগার আর অস্ত্রাগার। দক্ষিণে রাণীমহল। আজ আর সেটা নেই। রাণীমহলের সামনে একটি ফোয়ারা এখনো সেই স্মৃতি বহন করে চলেছে। রাজার একটি চিড়িয়াখানাও ছিল। নাটোরের জেলা প্রশাসন আবার নতুন করে সেই চিড়িয়াখানা চালু করেছে, রাজার ট্রেজারী ভবনে গড়ে তোলা হয়েছে সংগ্রহশালা।
রাজা-রানীর ব্যবহৃত নানা সামগ্রী সংগ্রহ করে দর্শনার্থীদের দেখার জন্যে এ সংগ্রহশালায় রাখা হয়েছে। মূলভবন রাজ প্রাসাদের সামনে রয়েছে রাজা প্রসন্ননাথ রায়ের আবক্ষমূর্তি। এর দু’পাশে রয়েছে দুটি কামান। রাজ প্রাসাদের সামনে পূর্বে রয়েছে রাজার দোলমঞ্চ। পাশেই রয়েছে কুমার প্যালেস। এর সামনে বসানো চারচাকা বিশিষ্ট একটি কালো কামান আজো শোভা পাচ্ছে ।
রাজ প্রাসাদের প্রবেশ পথে সিঁড়ির দু’পাশে ছিল দুটি কালো কৃষ্ণ মূর্তি-যা এখন শোভাবর্ধন করছে সংগ্রহশালার। সংগ্রহশালার প্রবেশ করিডরে রয়েছে ধাতববর্ম। এটা পরেই নাকি রাজা যুদ্ধে যেতেন। এ কারনে পিতলের তৈরি এ বর্মটি দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে। রাজপ্রাসাদের উত্তর পাশে ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। সেখান থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতে অস্টাদশ শতকের রাজবাড়ি আলোতে ঝলমল করতো। পুরো রাজ প্রাসাদে ছিল রাজার বিভিন্ন চিত্র কর্ম, ছবি আর বিদেশী ঘড়ি-আজ সে সব আর নেই।
প্রাসাদের শ্বেতপাথরের মেঝে মোড়ানো থাকতো পার্সিয়ান গালিচায়। রাজা প্রমদানাথ রায়ের প্রচন্ড রকম ঘড়ি প্রীতি ছিল। আর এ জন্য তিনি দেশ বিদেশ থেকে অর্ডার দিয়ে ঘড়ি তৈরি করে আনতেন। এসব ঘড়ি রাজপ্রাসাদ ছাড়াও বিভিন্ন ভবনে স্থাপন করেছিলেন। এমন একটি ঘড়ি ছিল যাতে ১৫ মিনিট পরপর জলতরঙ্গ বাজতো। এছাড়া রাজবাড়ির মূলফটকে রয়েছে একটি ঘড়ি। এর দু’পাশে দুটি ডায়াল। ঘড়িটি এখনো সঠিকভাবেই সময় দিয়ে যাচ্ছে । ঘড়িটি ইটালির ফ্লোরেন্স থেকে আনা হয়েছিল। আগে এর ঘন্টাধ্বনী অনেক দূর থেকে শোনা যেত এখন এ ঘন্টাধ্বনী শোনা যায় প্রায় এক মাইল দূর থেকে। শোনা যায় স্বাধীনতা যুদ্ধেও সময় দিঘাপতিয়া রাজবাড়িতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প হওয়ায় কিছু ঘড়িসহ অন্যান্য মূলবান সম্পদ লুট হয়।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর দিঘাপতিয়া রাজা দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান। স্বাধীনতার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি এটাকে গভর্নর হাউজ থেকে উত্তরা গণভবন হিসেবে ঘোষণা করেন। ২০০৮ সালে দর্শনাথীদের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে এর বেশিরভাগ অংশ। তবে রাজপ্রাসাদ আর ইটালিয়ান গার্ডেনে প্রবেশ করতে জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিতে হয়। মূলফটক দিয়ে প্রবেশের পর রাজ প্রাসাদে যেতে হাতের বাম দিকে রাণীঘাট ছাড়িয়ে চোখে পড়ে চিড়িয়াখানা। সেখানে রয়েছে অসংখ্য হরিণ, বানর, ময়ুর, টিয়া পাখি। রাজবাড়ীর প্রবেশ পথের ডান পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলে চোখে পড়ে শত বছরের শতাধিক আম গাছ-যেখানে স্থাপন করা হয়েছে পাখি অভয়াশ্রম।
সংরক্ষিত রাজ প্রাসাদ ও ইটালিয়ান গার্ডেন ছাড়া উত্তরা গণভবন প্রতিদিন দর্শনার্থীদের জন্যে খোলা থাকে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। মূল ফটকে প্রবেশ মূল্য সিনিয়র সিটিজেন ১০ টাকা, শিক্ষার্থী এবং দলগত জনপ্রতি ২০ টাকা, সাধারণ ৩০ টাকা, বিদেশী নাগরিক ৬০০ টাকা আর সংগ্রহশালায় প্রবেশমূল্য ৩০ টাকা।