বিশ্ব পর্যটন খাতে দিন দিন বাড়ছে মুসলিম ভ্রমণকারীদের সংখ্যা। এই ভ্রমণকারীদের চাহিদার প্রতি বাড়তি মনোযোগ ও সচেতনতার ফলে বদলে যাচ্ছে বিশ্ব পর্যটনের নকশা। তবে বিশ্বের মুসলিম পর্যটকদের জন্য উপযুক্ত এবং সুবিধাজনক গন্তব্য বাছাই করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। হালাল খাবার, নামাজের সুব্যবস্থা, ইসলামিক সংস্কৃতি ও নিরাপদ পরিবেশ—এসব বিষয় মাথায় রেখেই অনেকে ভ্রমণ পরিকল্পনা করেন।
এমন প্রেক্ষাপটে মুসলিমবান্ধব পর্যটন গন্তব্যের তালিকায় ধারাবাহিকভাবে শীর্ষস্থান দখল করে আছে মালয়েশিয়া। আধুনিকতা ও ইসলামী ঐতিহ্যের মিশেলে মালয়েশিয়া হয়ে উঠেছে মুসলিম ভ্রমণপিপাসুদের স্বপ্নের ঠিকানা।
মাস্টারকার্ড-ক্রিসেন্ট রেটিং গ্লোবাল মুসলিম ট্রাভেল ইনডেক্স ২০২৫-এ বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের ‘টপ মুসলিম-ফ্রেন্ডলি ডেস্টিনেশন অব দ্য ইয়ার’ খেতাব পেয়ে মালয়েশিয়া টানা ১০ বছর শীর্ষ স্থান ধরে রেখেছে। ২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে মুসলিম পর্যটকের সংখ্যা ১৭৬ মিলিয়নে পৌঁছেছে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা ২৪৫ মিলিয়নে পৌঁছাবে। তখন মুসলিম পর্যটকদের ভ্রমণ ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ২৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
কেন মালয়েশিয়া মুসলিমবান্ধব?
হালাল খাদ্যের সহজলভ্যতা: মালয়েশিয়ার প্রতিটি শহরেই রয়েছে হালাল খাবারের সুব্যবস্থা। রেস্তোরাঁ, ফুডকোর্ট, হোটেল এমনকি রাস্তার খাবারেও রয়েছে হালাল সনদ। মালয়েশিয়া সরকার হালাল সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়, যা পর্যটকদের বাড়তি নিরাপত্তা দেয়।
নামাজের সুব্যবস্থা: শপিং মল, বিমানবন্দর, রেলস্টেশন, পার্ক ও পর্যটন স্পটগুলোতে নির্ধারিত নামাজের ঘর (Prayer Room বা Surau) পাওয়া যায়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সুসজ্জিত এসব নামাজ ঘর মুসলিমদের জন্য বড় সুবিধা।
ইসলামিক সংস্কৃতি ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ: মালয়েশিয়ায় ইসলামী সংস্কৃতির ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে। আজান শোনা যায়, ইসলামী পোশাক পরিধান করা খুবই সাধারণ এবং মুসলিম পর্যটকদের প্রতি রয়েছে স্থানীয় জনগণের আন্তরিকতা ও সম্মান।
শরীয়াহ সম্মত হোটেল ও রিসোর্ট: মালয়েশিয়ায় রয়েছে শরীয়া-সম্মত হোটেল ও রিসোর্ট, যেখানে অ্যালকোহল নিষিদ্ধ, আলাদা সুইমিং পুল ও স্পা সুবিধা থাকে নারীদের জন্য। অনেক হোটেলেই নামাজের জায়নামাজ, কিবলার দিক নির্দেশনা এবং কুরআন শরীফ থাকে।
মালয়েশিয়ার জনপ্রিয় মুসলিমবান্ধব পর্যটন গন্তব্য
কুয়ালালামপুর: মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের মিশ্রণ। এখানে রয়েছে:
পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার: বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু জোড়া ভবন।
ইসলামিক আর্ট মিউজিয়াম: ইসলামী শিল্পকলার অনন্য সংগ্রহশালা।
মসজিদ নেগারা: বিশাল ও দৃষ্টিনন্দন জাতীয় মসজিদ।
পেনাং: সংস্কৃতি ও খাদ্যের স্বর্গ পেনাং। জর্জটাউন শহর ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট। এখানকার মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রাচীন মসজিদ, ইসলামিক সেন্টার এবং হালাল ফুড মার্কেট পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
ল্যাংকাউই: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোড়ানো দ্বীপ ল্যাংকাউই। হালাল রিসোর্ট, নারীদের জন্য আলাদা স্পা ও সুইমিং পুলসহ নানা সুবিধা রয়েছে। সমুদ্রস্নান, কেব্ল কার ও আইল্যান্ড হপিং এখানকার বড় আকর্ষণ।
মালাক্কা: ঐতিহাসিক শহর মালাক্কা ইসলামী ঐতিহ্যের সাক্ষী। প্রাচীন মসজিদ, ইসলামিক জাদুঘর এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের শতাব্দী পুরোনো বসতি এখানকার দর্শনীয় স্থান।
বোর্নিও দ্বীপ: প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য বোর্নিও দ্বীপের সাবাহ ও সারাওয়াক আদর্শ। পাহাড়, রেইন ফরেস্ট ও বিচে মুসলিমবান্ধব ট্যুর প্যাকেজ রয়েছে।
মুসলিম পর্যটকদের জন্য বিশেষ সুবিধা
- বিমানবন্দর ও রেলস্টেশনে নির্ধারিত নামাজের স্থান।
- অধিকাংশ পাবলিক টয়লেটে ওযুর সুব্যবস্থা।
- হালাল ট্যুর অপারেটর ও গাইড।
- ইসলামিক ইভেন্ট ও উৎসবে অংশগ্রহণের সুযোগ।
- নারীদের জন্য আলাদা স্পা, সুইমিং পুল এবং ফ্যাশন মার্কেট।
নিরাপত্তা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ
মালয়েশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে নিরাপদ দেশগুলোর একটি। পর্যটকদের প্রতি স্থানীয় জনগণের ব্যবহার বন্ধুত্বপূর্ণ। ইসলামিক মূল্যবোধ এখানে শুধু আনুষ্ঠানিক নয়, বরং সামাজিক জীবনের অংশ।
মালয়েশিয়া শুধু মুসলিমবান্ধব পর্যটন গন্তব্যই নয়, বরং একটি অনন্য সাংস্কৃতিক, প্রাকৃতিক ও ঐতিহ্যিক অভিজ্ঞতার দেশ। ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, নিরাপদ ও সুবিধাজনক হওয়ায় এটি মুসলিম ভ্রমণকারীদের প্রথম পছন্দের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। ‘মুসলিমবান্ধব পর্যটন গন্তব্যের শীর্ষে মালয়েশিয়া’—এই কথা নিছক প্রচারণা নয়, বরং বাস্তবতার অকাট্য প্রমাণ।