পর্যটন বিচিত্রা প্রতিবেদন
ঢাকা গেট মীর জুমলা গেট, ময়মনসিংহ গেট বা রমনা গেট নামেও পরিচিত ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দোয়েল চত্বর থেকে বাংলা একাডেমির রাস্তায় জাতীয় তিন নেতার মাজারের সাথেই অবস্থান ঢাকা গেটের।
এর মূলত তিনটি অংশের একটি রাস্তার মাঝে ও বাকি দুটি অংশ রাস্তার দুই পাশে। প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো এই স্থাপত্য নিদর্শন দীর্ঘদিন অযত্ন আর অবহেলায় জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে ছিল। এই এলাকায় মেট্রোরেলের কাজ শুরু হলে আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে ঢাকা গেট। অবশেষে ভগ্নপ্রায় এ নিদর্শন সংস্কারের উদ্যোগ নেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
ঢাকা গেট ঠিক কবে, কারা, কী উদ্দেশ্যে নির্মাণ করেছিল এ নিয়ে ইতিহাসবিদ ও প্রতœতত্ত¡বিদদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে বেশিরভাগেরই মত এটা মুঘল আমলে নির্মিত হয় মীর জুমলার হাত ধরে এবং তখন এটিই ছিল ঢাকার প্রবেশ পথ।
যে প্রেক্ষাপটে নির্মিত হয়েছিল
বর্তমানের আধুনিক ঢাকায় তাকালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঢাকা গেটের অবস্থানে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে, শহরের মাঝখানে এই গেটটি কেন?
মুঘলদের সময়ে মীর জুমলার শাসনামলে ঢাকা শুরু হয় এই গেট থেকে, বুড়িগঙ্গার তীর নয়। লুটপাটের ভয়ে একটু ভেতর থেকেই শুরু হয় শহর। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ে বাংলার গভর্নর হয়ে আসেন মীর জুমলা। সে সময় বাংলার রাজধানী ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীকে কেন্দ্র করে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়।
বাংলাপিডিয়া বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষে ঢাকার ইতিহাস অধ্যায়ে ঢাকা গেট সম্পর্কে বলা হয়েছে, এখানে বেশ কয়েকটি নির্মাণ কাজের সঙ্গে মীর জুমলার নাম জড়িয়ে আছে। প্রথমে মীর জুমলার গেট পরবর্তী সময়ে যা ‘রমনা গেট’ নামে পরিচিত হয়।
এর অবস্থান সম্পর্কে বলা হয় কার্জন হল এর কাছাকাছি ও পুরাতন হাইকোর্ট ভবনের পশ্চিমে ময়মনসিংহ রোডে গেটটি অবস্থিত। সেকারণেই এটি ময়মনসিংহ রোড নামেও পরিচিতি পায়।
বাংলাপিডিয়া বলছে, উত্তরদিক থেকে শহরটিকে রক্ষার জন্যই সম্ভবত এ গেট নির্মাণ করা হয়েছিল। মীর জুমলা মগ দস্যুদের আক্রমণ থেকে শহর ও শহরতলিকে রক্ষার জন্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। ঠিক কত সালে ঢাকা গেট নির্মিত হয় সে বিষয়টি এখানে উল্লেখ করা হয়নি।
তবে এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ঢাকা কোষ-এ বলা হয়েছে, মীর জুমলা ১৬৬০ থেকে ১৬৬৩ সালের মধ্যে এটি নির্মাণ করেছিলেন। সেখানেও বলা হয় সীমানা চিহ্নিত করতে এবং স্থলপথে শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে এটি নির্মাণ করা হয়। মুঘল আমলে এই ফটকের নিরাপত্তা ব্যুহ পেরিয়ে ঢুকতে হতো রাজধানী ঢাকায়। যা সতের শতেক থেকে শুরু করে উনিশ শতক পর্যন্ত চালু ছিল। এর মূল কাঠামোয় ছিল একটি পিলার ও তার দুদিকে ঢালু দেয়াল। দেয়ালগুলোকে দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করেছে দুপাশে আরো দুটি করে পিলার।
ঢাকা গেটের সংস্কার
মুঘলদের পতনের পর একসময় ব্রিটিশদের আগমন ঘটে বাংলায়। ততদিনে ঢাকার চেহারাও বদলে যায় অনেকখানি। ঢাকা গেটও আর আগের মতো প্রধান প্রবেশদ্বার থাকে না। ফলে এটি খানিকটা আড়ালে পড়ে যায়। তবে ১৮২৫ সালে ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডাউস প্রথমবার এটির সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সেসময় এটি রমনার প্রধান প্রবেশ পথ হয়ে পড়ে। সে কারণেই তখন এর পরিচিতি হয় রমনা গেট নামে।
আর এর নির্মাণ নিয়ে ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্তিকদের মধ্যে মতভেদও দেখা দেয় এর পর থেকে। কারণ ব্রিটিশদের দ্বারা নতুন করে সংস্কারের ফলে অনেকটা ইউরোপিয়ান আদল দেখা যায় এর মধ্যে। এরপর পাকিস্তান আমলেও আরেক দফা সংস্কার হয় রমনা বা ঢাকা গেট। তারপর দীর্ঘসময় অযত্ন, অবহেলায় থেকে প্রায় ধ্বংসের পথে ছিল প্রাচীন এই স্থাপত্য নিদর্শন। মেট্রোরেলের কাজ শুরুর পর আরও আড়ালে চলে যায় প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো ঢাকার ঐতিহ্যের এই অংশটি। শেষ পর্যন্ত ২০২২ সালে ঢাকা গেট সংস্কারের উদ্যোগ নেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। এর সংস্কার কাজ শুরু হয় গত বছরের মে মাসের দিকে।
৮২ লাখ ৪০ হাজার টাকা ব্যয়ে মীর জুমলার ফটককে পুরোনো অবয়বে ফিরিয়ে আনা হয়। অরিজিনাল ফর্ম বা আগের রূপে ফেরত নেয়ার জন্য সংস্কার কাজে ব্যবহার করা হয় চুন, সুপারির কস, খয়ের, চিটাগুড় ও ইটের গুড়া। এগুলোর মিশেলে দেয়াল ও পিলারের সংস্কার করা হয়। আর মেঝেতে ব্যবহার করা হয় বিশেষ ধরনের ‘মধ্যপাড়ার গ্রানাইট পাথরকুচি’।
সংস্কার শেষে ঢাকা গেটের উদ্বোধন করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনি বলেন, আমরা দুটি বিষয়কে পুনরুজ্জীবিত করেছি। একটি হলো ঢাকা ফটক, আরেকটি হলো আসাম অভিযানের শেষ নিদর্শন বিবি মরিয়ম কামান।
ঢাকা গেটের সাথেই বসানো হয়েছে মুঘল আমলের একটি কামান। যা বিবি মরিয়ম নামে পরিচিত। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, দস্যু ও শত্রুদের মোকাবিলায় এটি তৈরি করেন বাংলার সেনাপতি মীর জুমলা। এটি নিয়ে আসাম অভিযানে যান তিনি এবং আসাম জয় করে ফেরার পর এর জায়গা হয় বড় কাটরায়। ১১ ফুট দৈর্ঘ্যের বিশাল এই কামানটি নানা জায়গা ঘুরে ১৯৮৩ সাল থেকে ওসমানি উদ্যানে রাখা ছিল। ঢাকা গেট সংস্কারের অংশ হিসেবে কামানটিকে এবার মীর জুমলার স্মৃতির পাশে একসাথে রাখা হলো।