লেখকঃ এলিজা বিনতে এলাহি
ডিনার করার সময় গাইড ইয়াসিরের কড়া নির্দেশ এলো- ‘কাল আমরা উত্তরের দিকে বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক জায়গা ভ্রমণ করবো। সময় মতো রেডি থাকতে হবে’। কেন জানি, মনে মনে ভাবছিলাম, ওরা কি ইউরোপের পর্যটকদেরও এভাবে নির্দেশ দেয়, নাকি এ কেবল সাউথ এশিয়ার কিছু দেশের জন্য প্রযোজ্য! যাইহোক, আগামী দিন নতুন কিছু দেখবার আকুতি নিয়ে ঘুমাতে গেলাম।
রাত পোহালো। সকালে চট-জলদি নাস্তা সেরে হোটেল লবিতে অপেক্ষা করছি। একদম সকাল ৮টায় এসে ইয়াসির হাজির। মনে হচ্ছিল আগেই এসে হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর ঠিক ৮টায় হোটেল লবিতে ঢুকল। শুধু জর্ডান নয়, বিশ্বজুড়েই ট্যুর কোম্পানি ও গাইডরা এরকম করেই সময়ের সাথে চলে। জর্ডানে পর্যটনের দুয়ার খুব বেশি সময় হয়নি উন্মুক্ত হয়েছে। এরই মাঝে পর্যটন ব্যবসাকে কি দারুণ পেশাদারভাবে পরিচালনা করছে। আগেই বলেছি, আম্মান শহর থেকে আজকের গন্তব্য উত্তরমুখী।
মাইক্রোবাসে উঠলাম, ইয়াসির আবারো বললো- আজ জর্ডানের উত্তরের সব কিছু দেখাবো। যাবার পথটা দারুণ মায়াময়। উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ, পথের দুই পাশজুড়ে সবুজ। সবুজের কথা বিশেষ করে উল্লেখ করছি কারণ, গত দুদিনে সবুজ চোখে পড়েনি।
উত্তরের প্রথম গন্তব্য ছিল উম কাইস (Umm Qais)| । আমাদের মাইক্রোবাস এসে ভিড়লো একটি পার্কিং গাউন্ডে। ইয়াসিরের স্বভাব সুলভ হাঁক-ডাক- ’Please take your water bottle, sunglass and camera’। বুঝলাম বেশ কিছুক্ষণ লাগবে উম কাইস ঘুরে দেখতে। প্রাচীন প্রায় সব শহর, গ্রাম, জনবসতি সাধারণত ছোট টিলা বা পাহাড়কে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠত। প্রবেশ পথ থেকেই কালো পাথরের সিঁড়ি দেখতে পাচ্ছিলাম। ধীর পায়ে এগুলাম। জর্ডানের যেখানেই যাচ্ছি, সিঁড়ি বেয়ে পাহাড় চড়তে হচ্ছে তারপর মূল গন্তব্যে। চলতি পথে ছোট ছোট অলিভ গাছ। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছি, আমার আগেই ইয়াসির উঠে গিয়ে বললো- আমরা এখন মূল গ্রামে প্রবেশ করবো। মূল গ্রাম নয় আসলে, গ্রামের ধ্বংসাবশেষ। এটিকে শহর বা নগরী না বলে, গ্রাম কেন বলা হয় জানি না।
ইতিহাসে উম কাইস
গাদারা, উম কাইস নামেও পরিচিত, উত্তর-পশ্চিম জর্ডানে ইসরাইল ও সিরিয়ার সীমান্তের কাছাকাছি একটি মধ্যযুগীয় শহর। এটি একটি ঐতিহাসিক স্থান যা হেলেনিস্টিক এবং রোমান যুগের এবং অসংখ্য ঐতিহাসিক ঘটনার স্থান ।
সেলিউসিড সম্রাট তৃতীয় অ্যান্টিওকাস সমৃদ্ধি ও ধন-সম্পদের দেবতা গাদের সম্মানে শহরটিকে ‘গাদারা’ নাম দিয়েছিলেন। ৩৩৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের বাহিনীর দ্বারা এই অঞ্চলটি জয় করার পরপরই ঐতিহাসিক নথিতে গাদারা বা উম্মে কাইস প্রথম দেখা যায়। উম কাইস একটি গ্রাম, গ্রিকদের পরিত্যক্ত একটি গ্রাম। গ্রিকদের তৈরি পরিত্যক্ত শহর গাদারা (Gadara), বর্তমান নাম উম কাইস।
গ্রিকদের পর এই রাজত্ব চলে যায় রোমানদের হাতে। রোমান জেনারেল পম্পেই ৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিরিয়ার অঞ্চল জয় করেন। এর কিছুকাল পর, গাদারা তার নিজস্ব মুদ্রা তৈরি করে। গাদারায় স্থায়ী রোমান স্থাপত্যের বেশিরভাগই খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল। খ্রিস্টীয় প্রথম তিন শতাব্দীতে গাদারার মানুষের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে। তবে চতুর্থ শতাব্দীর শুরুর দিকে, খ্রিস্টধর্ম এই শহরে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়। সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাইজেন্টাইন বাহিনীর বিরুদ্ধে ইসলামিক সেনাবাহিনীর বিজয় উত্তর জর্ডানকে মুসলিম নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে ভ‚মিকম্পে এর অনেক স্থাপনা ধ্বংস হয়।
উম কাইসের শহরে বেশ কয়েকটি গির্জা এবং মঠ নির্মাণ করা হয়; যা পুরো খ্রিস্টীয় যুগে একটি উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় কেন্দ্র ছিল। অরিজেন, একজন সুপরিচিত ধর্মতত্ত¡বিদ ও দার্শনিক; যিনি খ্রিস্টীয় শিক্ষার বিকাশে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিলেন। তিনি এই শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
প্রত্নস্থলটি ১৯ শতকে পুনঃআবিষ্কৃত হয় এবং ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত জর্ডানের পুরাকীর্তি বিভাগ ১৯৩০ সালে সেখানে খনন শুরু করে। অন্যান্য বিদেশি গোষ্ঠীর সহযোগিতায় বড় খনন কাজ শুরু হয় ১৯৭৪ সালে।
যা দেখেছি উম কাইসে
প্রাচীন গাদারার ধ্বংসাবশেষ পূর্ব থেকে পশ্চিমে ১৬০০ একর এবং উত্তর থেকে দক্ষিণে ৪৫০ একর এলাকাজুড়ে রয়েছে। একদম ইতিহাসে ডুবে গিয়েছিলাম। মূল প্রবেশ পথে যাবার সময় ইয়াসির এসব ইতিহাস আওড়ালো। কিন্তু আমি বেশি মনোযোগী ছিলাম কালো পাথরের রাস্তাটির দিকে, কালো পাথুরে রাস্তা, দেয়াল ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিলাম।
কালো পাথুরে পথ শেষ হবার পর একটি খোলা প্রান্তরে এলাম। সেখান থেকে পথ কিছুটা নিচের দিকে নামছে। চারদিকে ছড়িয়ে আছে অগণিত কালো পাথর। সেখানকার একটি পাথরে বসে ছবি তুললাম। ধ্বংসাবশেষ যা টিকে রয়েছে সেগুলো বেশির ভাগই রোমান স্থাপনা আর অটোম্যানদের গ্রাম। উপরে চারদিকে কালো ও ধূসর পাথর, গ্রিক গ্রাম পাথুরে হবে, এটি বলার অপেক্ষাই রাখে না। কিন্তু এই পাথর বিশেষ ধরনের পাথর।
উম কাইস জর্ডানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্তিক স্থান হিসেবে বিবেচিত। আম্মান থেকে প্রায় ১১৫ কিলোমিটার দূরে। প্রাচীনকালে এটি ফিলিস্তিন ও সিরিয়ার মধ্যে বেশ কয়েকটি বাণিজ্য রুট এবং মধ্য ও পূর্বাঞ্চলীয় উচ্চভ‚মির সাথে সমুদ্রতীর সংযুক্ত করে।
আগেই বলেছি, গাদারা গ্রিক, রোমান, বাইজেন্টাইন এবং মুসলমানদের দ্বারা অধ্যুষিত ছিল। এর থিয়েটার, হিপোড্রোম, গেটস, নিম্ফিয়াম, দোকান, গির্জা, অটোমান গ্রাম এবং অন্যান্য অনেক প্রত্নতাত্তিক কাঠামো সেই সময়ের মধ্যে শহরের সম্পদ ও সমৃদ্ধির প্রমাণ দেয়।
উম কাইস গ্রামটি সর্বদা এত ছোট ছিল না এবং আজকের মতো তুলনামূলকভাবে অপরিচিত ছিল না। গাদারা যেমনটি একসময় পরিচিত ছিল, বাজার, গির্জা, ফোয়ারা, মোজাইক, আবাসন, উঠান এবং আরও অনেক কিছু নিয়ে গঠিত একটি বড় শহর। প্রতিটি সাম্রাজ্যের প্রভাব প্রাচীন শহরজুড়ে পাওয়া যায়। গ্রিকদের থিয়েটার এবং স্নানের জায়গা, রোমানদের জল ব্যবস্থা, বাইজেন্টাইনদের খ্রিস্টান অভিযোজন, অটোমানদের থেকে নাম; তুর্কি শব্দ Mkeis এর কারণে শহরটি উম কাইস নামে পরিচিত হয়, যা কর প্রদান বোঝায়।
হেঁটে কালো পাথরের একটি রোমান থিয়েটারের কাছে এলাম। গাদারাতে দুটি থিয়েটার ছিল। পশ্চিম দিকের নাট্যশালাটি বেশ সংরক্ষিত রয়েছে দেখলাম। নাট্যশালার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে শিশুদের মতো গোল গোল ঘুরছিলাম আর অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলাম। সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে একটি পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। ইয়াসির বললো, আমরা এখন এই শহরের মূল সড়কে যাচ্ছি; যার নাম কার্ডো। রোমান পরিকল্পনায় রাস্তার নামগুলি রোমান সামরিক ক্যাম্পের নাম থেকে উদ্ভূত হয়। পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলমান একটি রাস্তাকে ডেকুম্যানাস বলা হয়। ডেকুম্যানাস থেকে যে পথ বের হয় তার নাম ছিল কার্ডো। শহরে প্রবেশের মূল পথকে বলা হয় ‘ডেকুম্যানাস ম্যাক্সিমাস’। কার্ডোতে দাঁড়িয়ে এফোঁড় ওফোঁড় দেখে নিলাম এই শহরের প্রধান সড়ক।
উম কাইস জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থা, UNWTO দ্বারা ২০২২ সালে বিশ্বের ‘সেরা পর্যটন গ্রাম’ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। UNWTO সেরা পর্যটন গ্রাম ২০২৩ ঘোষণা করেছে, যেখানে বিশ্বের ১৮টি দেশ থেকে ৩২টি গ্রাম নির্বাচন করা হয়েছে।
বেস্ট ট্যুরিজম ভিলেজ প্রোজেক্টের লক্ষ্য হলো- গ্রামীণ গ্রামগুলিকে সুরক্ষিত রাখার ক্ষেত্রে তাদের ল্যান্ডস্কেপ, প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, জ্ঞান ব্যবস্থা, স্থানীয় মূল্যবোধ, ক্রিয়াকলাপ, গ্যাস্ট্রোনমিসহ পর্যটনের ভ‚মিকা প্রচার করা এবং উন্নত করা।
শহরে দাঁড়িয়ে দূর থেকে পাহাড় দেখছিলাম। পাহাড় বেয়ে পশ্চিমে নেমে গেলেই ইসরাইল। একটু পেছনে গেলেই প্যালেস্টাইন ভূখন্ড , ইসরাইল অধিকৃত পশ্চিম তীর। উম কাইস, জর্ডানের উত্তর পশ্চিমের শেষ সীমান্ত।
ওই দূরের উপত্যকা, গিরিশৃঙ্গ, সবুজের অবগাহন, পাহাড়ের আড়ালে অন্ধকারের নিমজ্জন, আর অস্পষ্ট কিন্তু দৃশ্যমান টাইবেরিয়াস হ্রদ। খৃষ্টের জন্মের প্রায় তিন শত বছর পূর্বে গ্রিকরা এমন একটা নিরাপদ জায়গা বেছে নিয়েছিল নগর পত্তনের জন্য। তিন দিকে খাড়া পাহাড়ের কিনারা। গ্রিকদের মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পরবর্তীতে রোমানদের তৈরি ভগ্নপ্রায় নগর, কিংবা আরও পরে অটোম্যানদের অধিগ্রহণ করা ভূখন্ড দেখতেই এখানে আসা। আর বলছিলাম বিশেষ এক পাথরের তৈরি গ্রামটি, সেই বিশেষ পাথর হলো এক জাতীয় কৃষ্ণ ধূসর আগ্নেয় শিলা বা Basalt stone.
একে শহর কিংবা গ্রাম যে নামেই ডাকি, আসলে এখন একটি খোলা জাদুঘর। প্রাগৈতিহাসিক যুগের অধিবাসী না হয়েও এই শহরকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা যায়। এ তো পরম পাওয়া। নিজের চিন্তায় ছেদ পড়লো ইয়াসিরের ডাকে, পরের গন্তব্যে যাবার জন্য।