আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল:
রক্তে-রক্তে ভ’রে আছে মানুষের মন
রোম নষ্ট হয়ে গেছে… গেছে বেবিলন
পৃথিবীর সব গল্প কীটের মতন। (জীবনানন্দ দাশ)
গ্রিস থেকে এগিয়ে চললাম ইতালির উদ্দেশে। গ্রিসের পাত্রাস থেকে জাহাজ ছাড়ল ইতালির আনকোনার উদ্দেশে। পৌঁছতে সময় লাগল ২০ ঘণ্টা। ভাড়া নিল ১৫,৮০০ ড্রাকমা। গ্রিসের মুদ্রার নাম ড্রাকমা। ১ ইউএস ডলার সমান ২৬৮ ড্রাকমা। জাহাজের নাম সুপারফার্স্ট-১। জাহাজের নিচে সাইকেল রেখেছিলাম। সাইকেল এলো বিনাভাড়ায়। মোটরবাইক, গাড়িও এলো অনেক, কিন্তু অতিরিক্ত পয়সা গুণতে হলো এগুলোর স্বত্বাধিকারীদের। জাহাজটি খুবই বিশাল আকৃতির; প্রায় ১৪০০ যাত্রীর ধারণক্ষমতা। জাহাজের ভেতর ক্যাসিনো, বার, ডিসকো, রেস্টুরেন্ট, ডিউটি ফ্রি শপ, সুইমিং পুল ইত্যাদি রয়েছে। যাত্রীসেবার জন্য জাহাজটিতে ১০৬ জন কর্মচারী নিয়োজিত। জাহাজে পরিচয় হলো তিন সদস্যের একটি অস্ট্রেলিয়ান ট্যুরিস্ট গ্রুপের, এক জার্মান দম্পতি ও আরও অনেকের সাথে। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল জাহাজের ক্যাপ্টেনের সাথে দেখা করি। ইঞ্জিন রুম দেখার পর পরিচয় দিতেই তার ব্যবস্থা হলো।
বিকালে আনকোনা এসে পৌঁছলাম এবং ইমিগ্রেশনের খপ্পড়ে পড়ে আমাকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হলো। ইমিগ্রেশন কীভাবে ফেস করতে হয়, কিছুটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। তাই গ্রিসের সংবাদপত্রে আমার নিউজটি দেখালাম এবং সেই সাথে ইতালির গ্রেটিস ভিসাও। আর তাতেই কাজ হলো। তাদের কাছ থেকে কিছু তথ্য নিয়ে সাইকেলে পা রাখলাম। সাইকেল চালাচ্ছি আর সমুদ্রকে দেখছি। পথে অনেক হিপ্পি দেখলাম, সেই সাথে কিছু বারবনিতার আনাগোনা লক্ষ্য করলাম। বন্দরে বারবনিতাদের সমাগম সর্বত্রই। একটি ফাস্টফুডের দোকান থেকে কিছু খেয়ে নিলাম এবং আবারও প্যাডেলে পা চাপলামÑ গন্তব্য রোম। রোমের টারমিনি স্টেশনে পৌঁছলাম। টারমিনি হচ্ছে ইউরোপের সবচেয়ে বড় ও ব্যস্ততম রেলওয়ে স্টেশন। এই এলাকায়ই নাকি প্রচুর বাংলাদেশি থাকেন। কিন্তু রাত ১১টার সময় কোথায় তাদের দেখা পাই! হঠাৎ দেখা হয়ে গেল এক বাংলাদেশির সাথে। আমি তাকে একটি ঠিকানা দেখালাম, যেখানে আমার যাওয়ার ব্যবস্থা গ্রিস থেকেই হয়েছিল। তিনি জানালেন- এই জায়গাটা একটু দূরে। বললেন- ‘আমি তো অনেক দূরে থাকি, তাই আপনাকে নিতে পারছি না সাথে করে’। আমার কাছে ইতালির যে সব লোকের নাম, ঠিকানা টেলিফোন নম্বর ছিল, তা দেখালাম। তিনি বললেন- ‘সামনেই পিয়াচ্ছা ভিক্টোরিয়া বলে একটা জায়গা আছে, সেখানে প্রচুর বাঙালি থাকেন’। তিনি আমাকে কিছু খুচরা পয়সা দিলেন টেলিফোন করার জন্য। সাইকেল নিয়ে সব এলাকা চষে বেড়ালাম। কিন্তু এত রাতে কারও দেখা পেলাম না।
এদিকে প্রচণ্ড পরিশ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত। প্রস্রাবের বেগ অসম্ভব বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এই রোমে কোথায় হালকা হই? চারদিকে কোনো জায়গা দেখলাম না, যে জায়গায় চুপিচুপি হলেও কাজটা সারা যায়। টেলিফোন বুথে গেলাম, কিন্তু সেটাতে পয়সা দিয়ে কাজ হয় না। সেটা ছিল কার্ডফোন সিস্টেম। ক্ষুধা লেগেছে, আবার প্রস্রাবেরও চাপ। অসহ্য বিরক্তিকর। রাগ করে টেলিফোন বুথের সাথে সাইকেলে ব্যাগ রেখেই খুঁজতে লাগলাম। হঠাৎ কিছু গাছ দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেলাম এবং হুম শান্তি…।
সাইকেল নিয়ে বিভিন্ন বাসার সামনে বেজারে নাম দেখতে থাকলাম। যদি কোনো বাঙালির সন্ধান পাই। এভাবে অনেকক্ষণ পর ব্যর্থ হয়ে ভাবলাম, স্লিপিং ব্যাগ তো সাথে আছেই, কোনো সমস্যা নেই। সাবওয়ের কাছে এসে টেলিফোন বুথের সামনে দাঁড়ালাম। দেখলাম, সেই বুথটিও কার্ডফোন সিস্টেম। হঠাৎ এক বাঙালিকে এগিয়ে আসতে দেখে বললাম- আমার কাছে কিছু কয়েন আছে, তবে টেলিফোন বুথটি শুধু ফোনকার্ডে চলে। তাই অনুরোধ করলাম তার কাছে যদি ফোনকার্ড থাকে, তাহলে আমাকে যেন একটি কল করার সুযোগ দেন। টেলিফোন নম্বর নিয়ে ডায়াল করে আমাকে দিলেন। অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো, আপনার আসার খবর এথেন্স থেকেই পাঠানো হয়েছে। কিন্তু ইতালিতে আমিও নতুন, রাস্তাঘাট চিনি না। আপনি ঠিকানা লিখে নিন তারপর চলে আসুন। কার্ড শেষ হয়ে গেছে, কি বিড়ম্বনা!
সঙ্গের লোকটির নাম রাসু। আমার পরিচয় জেনে বললেন- ‘আমিও দূরে থাকি এবং বাড়িওয়ালা ভালো না বলে আপনাকে নিতে পারছি না। তবে এই এলাকায় প্রচুর বাংলাদেশি থাকেন। দেখি এক রাতের জন্য কোথাও আপনার ব্যবস্থা করতে পারি কিনা’। এমন সময় একজন বাঙালির কাছ থেকে তিনি টেলিফোন কার্ড চেয়ে নিলেন এবং টেলিফোন করতে লাগলেন। আমি বললাম- এখানে আমার বন্ধু ও এলাকার কিছু লোকজন থাকেন। তাদের চেনেন কিনা। বললেন- চেনেন, তবে তার কাছে ঠিকানা নেই। পরে আরেকটি ছেলে এলো এবং সে ছিল রাসু ভাইয়ের পরিচিত। রাসু ভাই ছেলেটিকে বলল সে যেন আমাকে লিটু ভাইয়ের কাছে নিয়ে যান। আমাকে আশ্বস্ত করলেন, আপনার আর কোনো অসুবিধা হবে না।
লিটু খুব ভালো ছেলে। এই রাসু ভাইয়ের কাছে প্রায়ই যেতাম। তিনি রোমে একমাত্র বাঙালি নাপিত। রাসু ভাই জানালেন- তার প্রবাস জীবনের প্রথম দিনগুলো ছিল অনেক কষ্টের। তিনি যখন রোমানিয়ায় ছিলেন তখন তার কাছে কোনো ঠিকানা ছিল না। কোথায় যাবেন? তো যখন পৌঁছলেন, তখন ছিল রাত এবং প্রচ- শীত। বরফ পড়ছিল। এক বাসায় আশ্রয় চাইলে তারা কিছু পয়সা দিয়েছিল খাবারের জন্য। কিন্তু নতুন আগন্তুককে আশ্রয় দিতে সাহস পাননি। সেই স্মৃতি মনে করে বললেন- ‘ভাই আজও ভুলতে পারিনি জীবনের সেই সব দুর্বিষহ কথা। প্রবাস মানেই যে কী কষ্ট, কী যে মনের টানাপোড়েন বুঝতে পারবেন কোথাও থাকলে এ যেন এক নির্বাসিত জীবন। বন্দি ভাগ্যের কারাগারে। সুন্দর জীবন, মধুর স্বপ্ন সবই নিষ্পেষিত বাস্তবের যাঁতাকলে’।
লিটু ভাইয়ের বাসায় গেলাম। সাইকেলটাকে ওপরে নিয়ে আসতে হলো। রোমে সাইকেল চোরের উপদ্রব আছে। একটা অ্যাপার্টমেন্টে ১৮ জন বাঙালি একত্রে থাকেন। আমাকে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বললেন। রোমের প্রথম ভাত লিটু ভাইয়ের ওখানে খেলাম। সবাই ঘিরে ধরল। সাইকেলে বিশ্বভ্রমণ! অবাক হলেন, সাহসিকতার প্রশংসা করলেন। সবার নাম মনে নেই। কিন্তু মনের পর্দায় তাদের সে মুখ কখনো ভুলবার নয়। রিপন ও লিটু দুজনে টেলিফোনের ব্যবসা করতেন। তারা সবাই ছিলেন শরীয়তপুরের। ইতালিতে প্রচুর শরীয়তপুর, ফরিদপুরের লোক। লিটু ভাইয়ের মাধ্যমে অনেক বাঙালির সাথে পরিচিত হলাম। এবং আমার অনেক পরিচিত মানুষ পেয়ে গেলাম। যাদের সান্নিধ্যে রোমের দিনগুলো হেসে-খেলে, আনন্দ-ফূর্তিতে কেটে গিয়েছিল।
সবাই বিশেষ করে রাজু ভাই তো আমাকে থেকে যেতে বলতেন প্রতিদিনই। রাজু, মিজান এরা আগে প্যারিসে ঢাকা ক্লাবের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। প্যারিসে কাজ না হওয়ায় তারা অনেকে ইতালিতে চলে এসেছেন। আমাকে নিয়ে রাজু ভাইয়ের ব্যস্ততার অন্ত ছিল না। তারা আমাকে নিয়ে একেক দিন একেক বাসায় পার্টি দিতেন। বিরাট আড্ডা হতো। সত্যিই বড় সুখে দিন কাটাচ্ছিলাম ওদের সঙ্গ পেয়ে। লিটু ভাই আমাকে প্যান্ট, জ্যাকেট উপহার দিলেন। বন্ধু সবুজের সাথে হঠাৎ করে দীর্ঘ ৪/৫ বছর পরে দেখা হলো রোমের রাস্তায়। বন্ধুকে দেখেই জড়িয়ে ধরে সৌহার্দ্য বিনিময় হলো এবং দীর্ঘ সময় যোগাযোগ না করার জন্য গালমন্দ করলাম। সবুজ জোড় করেই তার বাসায় নিয়ে গেল। চারজন একটি বাসায় থাকে। অ-নে-ক দিন পর পুরোনো বন্ধুকে পেয়ে স্মৃতিচারণ করতে লাগলাম। ভোর ৫টার সময় সবুজ কাজে চলে গেল এবং বাসায় ফিরবে সন্ধ্যা ৬টায়। সপ্তাহে ৬ দিন একটি দোকানে সে কাজ করছে। কী ভীষণ ব্যস্ত। তাকে নিয়ে কোথাও একদিন ঘুরতে পারলাম না। অথচ কী কষ্ট করছে সে এখানে, দেখে অবাক হলাম। কারণ সে দেশে থাকতে খুবই সৌখিন ও আরামপ্রিয় ছিল। টাকা পয়সার কোনো অভাব ছিল না তার। সেই সবুজ এখানে কী পরিশ্রম করছে, ভাবতেই কেমন লাগে! এটাই জীবন এবং এটাই বাস্তবতা।
জুলিয়াস সিজার, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, হিটলারের মিত্র মুসোলিনি, সোফিয়া লরেন, গ্যারিবল্ডি, দারিও ফোর দেশ ইতালি। রাজধানী রোম। কিন্তু ইতালিয়ানরা বলে রোমা। রোম ইতালির প্রায় মধ্য অঞ্চলে অবস্থিত। রোম ইতালির ল্যাৎসিও অঞ্চলের একটি প্রদেশ। আয়তন ৫৩৫২ বর্গ কিলোমিটার। পানি ও স্থলপথে রোম ইতালির কেন্দ্রবিন্দু। ইতালি একটি পেনিনসুলা, যার বাংলা অর্থ উপদ্বীপ। ইতালি বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতার দেশ। সুদূর অতীত থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত সাহিত্য, ভাস্কর্য, শিল্পকলা, চিত্রকলা, রাজনীতি, ধর্ম ও সংস্কৃতির ভুবনকে ইতালি অনেক কিছু দিয়েছে। দান্তে, পেত্রার্কে, মাইকেল এঞ্জেলো, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, রাফায়েল, বেনিতো মুসোলিনি, গ্যারিবল্ডি কতই না বিখ্যাত ব্যক্তির দেশ এই ইতালি।
ইউরোপের সবচেয়ে বড় মসজিদ এই রোমেই অবস্থিত এবং এই মসজিদ তৈরিতে বাংলাদেশ সরকারও অর্থ দিয়েছে। একদিন নামাজ পড়তে গেলাম। সত্যিই প্রকা- বড় এবং সুন্দর এই মসজিদ। মসজিদের সামনে চলন্ত খাবারের দোকান থেকে কিছু খেলাম। তারপর ঘুরতে বের হলাম। রোমে বেড়ানোয় খুব মজা আছে। চারদিকে অজস্র ট্যুরিস্টের সমাগম। সেজন্যই বোধহয় রাস্তায় ব্যবস্থা রয়েছে। কিছু-কিছু রাস্তা-ঘাট মার্বেল পাথরের তৈরি। সাইকেল চালাতে কিছুটা কষ্ট হলেও বেশ আনন্দ পেতাম। রাস্তায় লোকজনের চলাফেরাও ছিল বেশ মজাদার। প্রায়ই ছেলেদের দেখতাম তারা খুব সুন্দর শিস বাজাচ্ছে। এবং মেয়েরা তো অসম্ভব ‘বিপদজনক’ সুন্দরী, প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করে।
টারমিনি ইউরোপের সবচেয়ে ব্যস্ততম রেলওয়ে স্টেশন। এখান থেকে ইউরোপের সব দেশেই যাওয়া যায়। ‘সিটিএস’ নামে একটি সংগঠন আছে যাদের রয়েছে ব্যাপক পরিচিতি এবং এটিই সবচেয়ে বড় ট্রাভেল অরগানাইজেশন। সেখানকার ছাত্রদের তারা ডিস্কাউন্ট দিয়ে থাকে যে কোনো জায়গায় যাওয়ার ব্যাপারে। রোমের কিছু ইয়ুথ অরগানাইজেশনের সাথে যোগাযোগ হলো এবং বেশ আপ্যায়িত হলাম। ভ্যাটিকানে পৌঁছে দেখলাম সেখানে অসম্ভব ভিড়। পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট দেশ হিসেবে এর পরিচয় রয়েছে। আয়তন মাত্র শুন্য দশমিক ৪৪ বর্গ কিলোমিটার। ১৯২৯ সালে পোপের প্রতিনিধি ও বেনিতো মুসোলিনির মধ্যে এক চুক্তির মাধ্যমে ভ্যাটিকান সিটি সার্বভৌমত্ব লাভ করে। যদিও ভ্যাটিকান রোমের মধ্যে অবস্থিত। মাহামান্য পোপ এই রাজ্যের রাজা। ভ্যাটিকানের নিরাপত্তারক্ষীরা ইতালিয় নয়, সুইস সৈনিক। সুইজারল্যান্ড নিরেপক্ষ দেশ বলে এই ব্যবস্থা। ছবি তুললাম এবং দাঁড়িয়ে গাইডের পরিবর্তনের মনোরম দৃশ্য দেখলাম। সাইকেলে তালা ঝুলিয়ে হাঁটতে থাকলাম।
শহরটির পূর্বে সেন্ট পিটার। পশ্চিম ও দক্ষিণে প্রাচীর, তার উত্তরে খানিকটাজুড়ে প্রাচীর ও বাকি অংশ পোপের অফিস। পোপকে দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু পোপ সব সময় জনসাধারণের সামনে আসেন না। একটি নির্দিষ্ট সময় তিনি আসেন। এই প্রথম একটি দেশে গেলাম, যেখানে কোনো ইমিগ্রেশন, কাস্টমস নেই। পাসপোর্টে সিল মারার কাজ নেই। রোম থেকে সবাই ভ্যাটিকানে যেতে পারেন। ভ্যাটিকানের জন্য আলাদা কোনো ভিসার প্রয়োজন নেই। ইতালির ভিসা বা সেনজেনের ভিসা থাকলেই হয়।
প্রখ্যাত শিল্পী ও স্থপতিদের বার্লিনে তৈরি স্কোয়ারটি দেখলাম। এরা বলেন কলোনেড। খুবই সুন্দর ও বিশাল অঙ্গন। স্কোয়ারটির তিনটি অংশ। তোরণ পেরিয়ে গেলেই বেশ বড় একফালি আয়তক্ষেত্রের প্রাঙ্গণ, তারপর সুবিশাল গোলাকার অঙ্গন। অবশেষে আবার একফালি আয়তক্ষেত্রাকার আঙ্গিনা, একেবারে সেন্ট পিটারের সোপান পর্যন্ত প্রসারিত। পুরো স্কোয়ারটি পাথর বাঁধানো। মগ ও উজ্জ্বল পাথর, ঝকঝকে তকতকে। রোমের মতো এমন পাথর বসানো রাস্তা পৃথিবীর অন্যত্র তেমন নেই।
৬২৬ বছর ধরে ভ্যাটিকান সিটি পোপের বাসস্থান। ১৩৭৭ সাল থেকে প্রায় ২৬০ জন পোপ সেন্ট পিটারের সিংহাসনে বসেছেন। ভ্যাটিকানের ইতিহাস প্রেম ও ক্ষমার ইতিহাস। বিশ্বভ্রাতৃত্বের ইতিহাস। তাই আজও ভ্যাটিকান অক্ষয় ও অব্যয়, মানব ইতিহাসের পূণ্যভূমি।
রোমের আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে যাই এবং পরিচিত হই Madam Anne Marie Roquetti এর সাথে। গ্রিসের আঁলিয়সের Max Dupouy আমাকে একটি চিঠি দিয়ে দিয়েছিলেন। আলিয়ঁসের চিঠি দেখে তিনি আমাকে ওখানকার কিছু লোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং জানতে চাইলেন আমার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে কিনা? বাঙালি ভাইদের আতিথেয়তা গ্রহণ করেছি বলে জানালাম। তারা আমার জন্য অলিম্পিক কমিটি, কিছু স্কুল, ফরাসি দূতাবাসে আমার ভিসার জন্য যোগাযোগ করল। ভদ্র মহিলা জানতে চাইলেন- আমার কোনো টাকা-পয়সা লাগবে কিনা। যদি লাগে, তবে তারা প্যারিস থেকে আনানোর ব্যবস্থা করবেন। ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, টাকা-পয়সার দরকার নেই; আমার কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে।
তবে আপনার এই সহযোগিতা আমাকে অনেক এগিয়ে দেবে। মাদমোয়াজেল আমাকে একটি গাড়ি দিয়েছিলেন রোম ঘোরার জন্য। আমি বললাম, আমার তো সাইকেল আছে। তবুও এক প্রকার জোর করে একদিনের জন্য নিয়ে ঘুরতে বেরুলেন। অগত্যা সাইকেলটি গাড়ির পেছনে নিয়ে গাড়িতেই ঘুরলাম। কিছু ফরাসি স্কুলে গেলাম, পরিচিত হলাম ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে এবং আমার ভ্রমণের উদ্দেশ্য তুলে ধরলাম তাদের কাছে। ফরাসি দূতাবাসে গেলাম ভিসার জন্য। তারা আমার কাছে ভিসা ফি চাইল। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ আমাকে স্পন্সর করেছে, আর তোমরাই ভিসা ফি চাইছ, এটা তো ঠিক নয়। আমি তোমাদের কাছে ভিসা ফি দিয়ে ভিসা নিতে রাজি নই। এটা আমার কাছে ভালো লাগেনি। তাই চলে এলাম। বেরুতেই দেখি লিংকনকে। লিংকন, বাংলাদেশ যুব পর্যটক ক্লাবের সদস্য এবং ১৯৯৬ সনে বিশ্ব ভ্রমণের উদ্দেশে বের হয় একাকি।
ফরাসি দূতাবাসের সামনে সুন্দর একটি ফোয়ারা ছিল। সেখানেই ছবি তুললাম। সেও ফ্রান্সে ভিসার জন্য এসেছে। সে আমাকে জানাল, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আহমেদ আকতারুজ্জামান, যিনি আমাদের সাইকেলে বিশ্ব ভ্রমণের জন্য ঢাকা থেকে শুভেচ্ছা বাণী দিয়েছিলেন, বর্তমানে রোমে বাংলাদেশ দূতাবাসে আছেন। লিংকন বলল- ইতালিতে এলে আমি যেন তার সাথে দেখা করি। এমনিতেই বাংলাদেশ দূতাবাসে যেতে মন চায় না। নানা কারণে সময় নষ্ট করে দূতাবাসের লোকেরা। তবে রেফারেন্স থাকলে বেশ কাজ হয়। আকতারুজ্জামান সাহেবের কাছে যাই। তিনি আমাকে বললেন- কতদিন হলো এসেছ। চার/পাঁচ দিন। তিনি বললেন- এতদিন হলো আর তুমি বাংলাদেশে দূতাবাসে এলে না। তাকে বুঝিয়ে বললাম, দূতাবাসে আসতে তো মন চায় কিন্তু নানা কারণে (তুরস্কের আংকারায় দূতাবাসের অভিজ্ঞতার কথা বললাম) আসতে ইচ্ছে করে না। আমার কথা তিনি বুঝলেন। দেখো, সবাই যে এক রকম হবে, তার কী নিশ্চয়তা। ভালো-মন্দ মিলিয়েই মানুষ। তুমি এসেছ, আমি খুব খুশি হয়েছি। বলো, তোমার জন্য কী করতে পারি? আমি কিছু দেশের ভিসার জন্য নোট ভারবেল চাইলাম।
তিনি জানতে চাইলেন, কোন কোন দেশ? তারপর তিনি আমাকে নেদারল্যান্ড, সুইডেন, ফিনল্যান্ডের ভিসার জন্য চিঠি দিলেন। নেদারল্যান্ড পাঁচ মিনিটেই ‘Gratis’ ভিসা দিল। তারপর সুইডেনেরও ভিসা দিয়ে দিল। শুধু ফিনল্যান্ড বলল দুই সপ্তাহ সময় লাগবে। আমি অনুরোধ করলাম। তারা আলিয়ঁসের কাগজপত্র দেখে আমার সামনেই ফিনল্যান্ডে ফোন করে অবহিত হয়ে বললেন, একদিন পরে এসে পাসপোর্ট নিয়ে যান।
বাংলাদেশ দূতাবাস, আলিয়স ফ্রঁসেজের চিঠি, বিদেশি পত্রিকায় আমার ভ্রমণ ফিচার ইত্যাদি দেখে কোনো দেশেরই ভিসা পেতে তেমন ঝামেলা পোহাতে হয়নি। ইউরোপিয়ানরা সব কিছুতেই প্রমাণ চায়। প্রমাণ দেখাতে পারলেই কাজ হয়।
একদিন বশির টেলিফোন করল আমাকে। আমি তো অবাক। সে আমার নম্বর জোগাড় করল কীভাবে? সে জানাল, আমার আসার খবর ইতোমধ্যে বহুজন জেনেছেন। এটা তেমন অবাক হওয়ার মতো ঘটনা নয়। যাইহোক, বশিরের সাথে কথা বলে ভালো লাগল। অনেক আগে সাইকেলে করে ইতালি এসে এখানেই থেকে গিয়েছে। আরও একজন বাঙালি মেয়ে-সাইক্লিস্টের খবর পেলাম। তার নাম জেসমিন। জেসমিন পপসম্রাট আজম খানের আত্মীয়। তারা ৪ জন (তিন জন ছেলে ও সে) মিলে সুইজারল্যান্ডে হয়ে ইতালি এসেছে এবং এখানেই বর্তমানে বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। সে একটি বাঙালির দোকানে কাজ করে শুনে দেখা করতে গেলাম। কিন্তু সেই লোককে পাওয়া গেল না দোকানে। পিয়াচ্ছা ভিক্টোরিয়াতে প্রচুর বাংলাদেশির দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে। ইংল্যান্ডের পর ইউরোপের ইতালিতেই সবচেয়ে বেশি বাঙালি বসবাস করেন। নাসিম নামে এক ক্রীড়া সাংবাদিকের সাথে দেখা। তার মাধ্যমে রনি ভাই ও আরও অনেক বাংলাদেশি লোকজন, সংগঠনের সাথে পরিচিত হই।
এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ। সাইকেলে ভারতবর্ষ থেকে ১৪৪ জন পৃথিবী ভ্রমণে বেরিয়েছেন, এদের মধ্যে ১৪ জন নারী। ৩৭ জন সফল হয়েছেন। ৬ জন বিদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন ভ্রমণপথে। গিনেস বুক অব রেকর্ডসের ১৯৯৭ সনের সংস্করণ অনুযায়ী, সাইকেলে চড়ে সর্বপ্রথম বিশ্বরেকর্ড করেন ইসরাইলের টল বাট, ৭৭ দিন ১৪ ঘণ্টায় ১৯৯২ সালের ১৭ আগস্ট তার ভ্রমণ সম্পন্ন হয়। আমেরিকার ওহাইও রাজ্যের স্টিভেন নিউম্যান ১৯৮৩ সালের ১ অক্টোবর তারিখ থেকে হাঁটতে শুরু করেছিলেন এবং ৪ বছরে ৩৬ হাজার ২০০ কিলোমিটার হেঁটে স্বদেশ ফেরেন। তবে গিনেস বুক অব রেকর্ডসের তথ্য অনুযায়ী, পদব্রজে সর্বপ্রথম বিশ্বরেকর্ড করেন আমেরিকার ডেভিড কাস্ট। তিনি ৪ বছরে ২৩ হাজার ২৫০ কিলোমিটার হেঁটে যাত্রার সমাপ্তি ঘটান ১৯৭৪ সালের ৫ অক্টোবর।
রোম নগরীর আদি ইতিহাস নানা রূপকথা দিয়ে ভরা। সেই সব কাল্পনিক কাহিনির ভেতর থেকে প্রকৃত ইতিহাস খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। রোম পৃথিবীর প্রথম প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। জ্ঞানী ও বীরদের নিয়ে গঠিত সেনেট রাজ্যশাসন করত। সেই সময় মেসিডোনিয়া, গ্রিস, স্পেন, মিশর প্রভৃতি রোম সাম্রাজের অন্তর্ভুক্ত হয়। ভ্যাটিকানে যাওয়ার পথে দেখলাম ভিক্টর ইমানুয়েলের প্রাসাদ। অপূর্ব এক ইন্দ্রালয়। অর্ধ বৃত্তাকারে অবস্থিত। সব কিছু শ্বেতপাথরে নির্মিত। মন্দিরটি ছয়তলা বাড়ির সমান উঁচু। একেবারে ওপরে দুদিকে দুখানি রথ। চারটি করে ঘোড়ায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে। রথে একজন করে দণ্ডায়মান মানুষ। তার নিচে অর্ধ বৃত্তাকারে এক সারি গোল গম্বুজ। অশ্বারোহী ‘রোমান নাইট’-এর সুবিশাল ব্রোঞ্জ মূর্তি চোখ এড়ায় না। রোমের স্বাধীনতার স্মৃতিসৌধ এই মন্দির। বিখ্যাত স্থপতি কাউন্ট গিউসেপ্পি স্যাকচোনি ১৮৮৫ সালে কাজ শুরু করে ১৯১১ সালে শেষ করেন। এটি ‘নিও-ক্লাসিক’ শিল্পশৈলীতে নির্মিত। ভেনিসের বিখ্যাত ভাস্কর সিয়ারদিয়া ২০ বছর ধরে ওই অশ্বারোহী মূর্তিটি নির্মাণ করেন। এ রকম সুন্দর জায়গায় ছবি না তুলে পারি! মনুমেন্টের সামনে সাইকেলসহ বেশ কিছু ছবি তুললাম। এক সুন্দরী মেয়ে সহযোগিতা করল ছবি তুলতে। জীবন্ত মনুমেন্টকেও বাদ দিইনি আমার সাথে ছবিতে। ইতালিয়রা এত সুন্দর কেন? আমার দৃষ্টিতে ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দরী হচ্ছে ইতালিয়ানরা এবং তারপরই গ্রিস ও তুরস্কের মেয়েরা।
রোমে এলে নাকি রোমান হতে হয়। রোমান হতে পেরেছি কিনা জানি না, তবে সর্বত্রই প্রচুর ঘুরে বেড়িয়েছি। সাইকেল চালিয়ে বেশ মজা পেয়েছি। সর্বত্রই প্রচুর ট্যুরিস্টের সমাগম। এত পর্যটক অন্য কোনো দেশে দেখিনি। রাস্তায় প্রচুর পানির ফোয়ারা রয়েছে। রোম সুপ্রাচীন ও সুবিশাল নগরী। রোমের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায় তার স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা, সংগীত ও সাহিত্যে।
তাইবার নদীর নিম্ন উপত্যকাই রোম নগরী। নদীটি নগরের উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত। নদীর বাঁ তীরে সাতটি পাহাড় নিয়ে এই নগরী প্রথম গড়ে উঠেছিল। সেই পাহাড়গুলো হচ্ছে- ক্যাপিতোলিনে, কুউরিনাল, ভিমিনাল, এসকুইলিনে, সিলিয়ান, এভেনতাইনে ও পালাতিনে। জানা যায়, মহানগরীর প্রথম জনবসতি গড়ে উঠেছিল পালাতিন পাহাড়ে। পিয়াৎসা ভিক্টোরিয়া থেকে সাইকেলে চেপে ভ্যাটিকান সিটিতে যাই।
প্রায় ঘণ্টাখানেকের মতো সময় লাগল। ভ্যাটিকান সিটি তাইবার নদীর ডান তীরে অর্থাৎ সাত পাহাড়ের বিপরীত দিকে। ভ্যাটিকানের দিকে দুটি পাহাড় আছে। নাম ম্যারিও এবং গিয়ানিকোলো। নদীর তীর ধরে সাইকেল চালাচ্ছি, একটুও ক্লান্তি লাগছে না। নতুন দেশ, নতুন জায়গা দেখার আনন্দই আলাদা। লিটু ভাইয়ের কাছে থাকতে পেরে মাথা গোঁজার ঠাঁই ও পেটের চিন্তা করতে হচ্ছে না। মনের আনন্দে তাই ঘুরতে পারছি। ফোয়ারা থাকাতে খাবার পানির কোনো সমস্যা হলো না। রোম ও কানাডার মতো সুমিষ্ট পানি পৃথিবীর কোথাও পাইনি। প্রাণ জুড়িয়ে যায়। ঠিক যেমন বাংলাদেশের চাপকলের পানি। কলোসিয়ামের ছবি অনেক আগেই দেখেছি।
এটি রোমের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। কলোসিয়াম ছিল রোমানদের জীবনের প্রতীক। ধর্মযাজক বেদে বলেছিলেন- While stands the colosseum, Rome shall stand, when falls the colosseum, Rome shall fall; and when Rome falls, with it shall fall the world. তার এই উক্তির ২০০ বছরের মধ্যেই কলোসিয়ামের পতন ঘটে। ১০৮৪ খ্রিস্টাব্দে জার্মানরা রোমনগরী লুণ্ঠনের সময় কলোসিয়াম ভেঙে ফেলে। আর তখন থেকেই রোম সাম্রাজ্যের প্রকৃত পতন শুরু হয়। কলোসিয়াম ছিল বধ্যভূমি।
সেকালের রোমানদের জনপ্রিয় প্রদর্শনী Ludi circenses’ এর জন্যই কলোসিয়াম সুপরিচিত হয়ে উঠেছিল। রোমানরা যেন নিষ্ঠুর এবং যুদ্ধপ্রিয় হয়ে ওঠেন, সেই উদ্দেশ্য খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতক থেকেই ওই নিষ্ঠুর প্রদর্শনীর প্রচলন হয়েছিল। দর্শক পরিপূর্ণ কলোসিয়ামের রঙ্গভূমিতে মানুষে-মানুষে কিংবা মানুষে পশুতে যুদ্ধ হত, মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত সে লড়াই বন্ধ হত না। অনেক সময় দুপক্ষেরই মৃত্যু ঘটত। এই প্রদর্শনীর জন্য সেকালে রোমে শত শত ‘Gladiator’ বা পেশাদার যোদ্ধা ছিল। তারা প্রতিদিন মরণপণ করে লড়াই করতেন। একবার এক জয়ন্তী উৎসবে এই কলোসিয়ামে ১০০ দিনে ৯০০০ পশু হত্যা করা হয়েছিল। পাঠকের জন্য বলছি- আপনারা রাসেল ত্রু অভিনীত ‘গ্লাডিয়েটর’ নামে অস্কার পাওয়া ছবিটি দেখলে কলোসিয়াম সম্পর্কে, তাদের যুদ্ধ সম্পর্কে কিছু ধারণা পাবেন।
খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে তেলিমাসুশ (Telemachus) নামে জনৈক প্রাচ্যদেশীয় সাধু একদিন যুদ্ধ প্রদর্শনীর সময় হঠাৎ করেই বধ্যভূমিতে প্রবেশ করে যুদ্ধরত দুই যোদ্ধার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়েন। যুদ্ধ থেমে গেল। তখন তিনি দর্শকের দিকে ফিরে করজোড়ে এই নিষ্ঠুর, অমানবিক খেলা বন্ধের আহ্বান জানান। কিন্তু দর্শকরা সেই প্রেমময়, মহৎ সন্ন্যাসীর আবেদনে সাড়া না দিয়ে একযোগে তার ওপর পাথর ছুঁড়তে শুরু করল। তিনি মারা গেলেন। কিন্তু তার এই আত্মত্যাগ বিফলে যায়নি। তিনিই কলোসিয়ামের শেষ শিকার। সেদিন থেকেই সেই নিষ্ঠুর প্রদর্শনী বন্ধ হয়ে যায়। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। এই সুন্দর পৃথিবীর জন্য কত মানুষের কত ত্যাগ, বলিদান, পরিশ্রম রয়েছে তার খোঁজ আমরা ক’জনাই রাখি!
এই যে আকাশ ক্ষুধিত পৃথিবী অবারিত সীমাহীন, এর মাঝে চলে হক-বাতিলের সংগ্রাম চিরদিন; কতো যে রক্ত ঝরেছে সেখানে কতো যে জমেছে পাপসেই শোকে ওগো বন্ধু, হৃদয় কাঁদলো কি কোনো দিন?
১৯০০ বছর আগে গড়া কলোসিয়ামের অধিকাংশই এখন ভাঙা। একাংশ শুধু দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটাজুড়ে ধনুকাকৃতি দরজা আর দরজা, খুবই সুন্দর দেখতে। বাইরের দিকটা গোলাকার হলেও ভেতরটা ডিম্বাকৃতি। এটাই স্টেডিয়ামের বিজ্ঞানসম্মত গড়ন।
ঢাকার বন্ধু রবি, সোহেল, বাবু, পরাগ, আরিফও তাদের এলাকার বড়ভাই সেলিম ভাইয়ের কথা জানতাম, যিনি দীর্ঘদিন যাবৎ ইতালিতে ছিলেন। সেলিম ভাইয়ের বাসায় গেলাম লিটু ভাইকে সাথে নিয়ে। সেলিম ভাই এক বিশাল রাজবাড়িতে থাকেন। এক ইতালিয় ভদ্রলোক তাকে স্নেহ করে বাড়িটি দিয়েছেন। সেলিম ভাই নিজহাতে রান্না করে আমাদের খাওয়ালেন এবং রাতে সবাই ফুটবল খেলা দেখতে বসলাম। ফুটবল বলতে ইতালিয়রা এবং সেই সাথে বাঙালিরাও পাগল। যে ক’দিন ইতালিতে ছিলাম, দেখেছি সবাই ফুটবল পাগল। ফুটবল বলতে অজ্ঞান। তারা তাদের সব কাজকর্ম ছেড়ে বসে থাকেন খেলা দেখার আশায়। সেলিম ভাইদের সাথে খেলা দেখে মনে হলো ঢাকার স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখছি, তাদের মতো আমিও পাওলো রসি, ব্যাজিও-র ভক্ত।
ইতালিয় ভাষাও বেশ শ্রুতিমধুর। অন্তত আমার তাই মনে হয়েছে। আর ইতালিয় শব্দ ‘চাও’ (অর্থাৎ খোদা হাফেজ) বিশ্বভাষায় পরিণত হয়েছে। পাস্টা, পিৎসা ও স্প্যাগাটির তো তুলনাই নাই। আঙুরের দেশ বলে সেখানে মদ খুব সস্তা। পকেটমার ও যাযাবরদের বেশ উৎপাত। সব সময়ই সাবধান থাকতাম, যেন কোনো ঠগের পাল্লায় না পড়ি। ইতালিয়রা রসিকতা করে বলেন, তাদের রাজধানী তিনটি। রাজনৈতিক রাজধানী রোম, শিল্প রাজধানী তুরিন ও অর্থনৈতিক রাজধানী মিলান। আবার যারা অতিরসিক তারা বলেন- পর্যটনের রাজধানী ভেনিস, সমুদ্রযাত্রার রাজধানী জেনোয়া আর ফ্লোরেন্স তো ইতালির অবিসংবাদিত সাংস্কৃতিক রাজধানী। ইতালির সব শহরই শিল্প-ইতিহাসে সমৃদ্ধ।
লেখক: প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স অ্যাসোশিয়েশন