মোফাজ্জল হোসেন
চিরায়ত বাংলার রূপ ও সৌন্দর্যের এবং এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও কৃষ্টিকে পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে কাজে লাগানোর জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ১৯৭২ সালে পর্যটন করপোরেশন গঠিত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল- পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন প্রসার, বিকাশ ও বিপণন। বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরা এবং অভ্যন্তরীণ পর্যটনের অবকাঠামো সৃষ্টি। মোফাজ্জল হোসেন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন পর্যটন বিভাগে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীকালে পর্যটন করপোরেশনের কর্মকর্তা হিসেবে অবসর নেন। পর্যটন শিল্পের সঙ্গে রয়েছে তার নিবিড় সম্পর্ক ও দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা।
মোফাজ্জল হোসেন পর্যটন শিল্পের একজন নিবেদিত কর্মী, গবেষক, ভ্রমণ লেখক এবং পর্যটন বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। তার লেখা ইতিহাস ঐতিহ্যবিষয়ক ভ্রমণ কাহিনি ‘ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া’ শ্রেষ্ঠ ভ্রমণ লেখক হিসেবে পর্যটন বিচিত্রা পুরস্কার লাভ করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনা এবং প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে তার গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘কিংবদন্তী কথা কয়’ সব মহলে সমাদৃত। বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে গবেষক মোফাজ্জল হোসেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লিখে থাকেন। ১৯৭৫ সালের প্রথম সপ্তাহে কাপ্তাই টুরিস্ট কমপ্লেক্সে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অন্তিম সান্নিধ্যের স্মৃতি নিয়ে লিখিত কিছু ঘটনা, কিছু স্মৃতি, কিছু উপলব্ধি পর্যটন বিচিত্রায় প্রকাশ করা হলো।
১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে বঙ্গবন্ধু বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন করার জন্য আসেন এবং কাপ্তাই পর্যটন মোটেলে রাতযাপন করেন। বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সমগ্র এলাকায় শত শত তোরণ নির্মিত হয়।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোশেনের তৎকালীন চেয়ারম্যান রফিকুল্লাহ চৌধুরীসহ উচ্চ পদস্থ সবাই ছুটে এলেন কাপ্তাই। আমি তখন কাপ্তাই প্রকল্পের প্রকল্প প্রধান। পাকিস্তান আমলে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে পাকিস্তান পর্যটন বিভাগ কাপ্তাই ও কক্সবাজারকে পর্যটন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে যাত্রা শুরু করে। তখন কাপ্তাই জলবিদ্যুতকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে কাপ্তাই পর্যটন কেন্দ্র। পার্বত্য চট্টগ্রামে কাপ্তাই ছাড়া অন্য কোনো পর্যটন কেন্দ্র ছিল না। রাঙামাটি-বান্দরবানে তখনো কোনো পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে পাকিস্তান পর্যটন বিভাগের সব সম্পদ ও জনবল পর্যটন করপোরেশনের ওপর ন্যস্ত হয়। সে সময় পর্যটন করপোরেশনের সর্ববৃহৎ প্রকল্প ছিল কাপ্তাই টুরিস্ট কমপ্লেক্স। ইতোপূর্বে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরিকে এখানেই সংবর্ধনা দেয়া হয়।
যাইহোক, বঙ্গবন্ধু বেতবুনিয়া উদ্বোধন করে কাপ্তাই মোটেলের হেলিপ্যাডে অবতরণ করেন। হেলিপ্যাডে সবাই বঙ্গবন্ধুকে সারিবদ্ধভাবে সংবর্ধনার জন্য প্রস্তুত। হেলিকপ্টার থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে আমি এগিয়ে গিয়ে করমর্দন করলাম। সঙ্গে সঙ্গে তিনি উচ্চস্বরে ডেকে বললেন- ‘রফিক তুই কোথায়?’ সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারম্যান রফিকুল্লাহ চৌধুরী কাছে এলে তিনি আমাকে দেখিয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠলেন- ‘তোকে তো ভালো লোক দিয়েছি, কিছু উন্নতি করেছিস পর্যটনের?’
আমার স্মৃতিপটে ভেসে এলো বঙ্গবন্ধুর আদর্শে লালিত ছাত্রজীবনের শুরুর কথা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় আমি তখন ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজের ছাত্র। সেই ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু ময়মনসিংহ বিপিন পার্কে বক্তৃতা করেন। সে সভায় বক্তৃতা করেন রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া, মামুনুল হক প্রমুখ। পরবর্তীকালে তারা দুজনই যথাক্রমে ময়মনসিংহের নান্দাইল ও ফুলপুর আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। সেদিন থেকে আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক।
১৯৫২ সালে ময়মনসিংহে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন গড়ে উঠে। সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন- আনন্দ মোহন কলেজের অধ্যাপক সৈয়দ বদরুদ্দিন হোসাইন (পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রেজিস্টার), অধ্যাপক সৈয়দ নজরুল ইসলাম (পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের সময় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন) প্রমুখ। ভাষা আন্দোলনে গ্রেফতার হন সৈয়দ বদরুদ্দিন হোসাইন, রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া, কাজী আবদুল বারীসহ অনেকে। আমার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। কাজী আবদুল বারী কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের কাজী আবদুল আওয়ালের পুত্র, আমার সহপাঠী। তিনি বামধারার রাজনীতি করতেন। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময় সামরিক আদালতে দ-িত হয়ে বেত্রাঘাতে তার শ্রবণশক্তি লোপ পায়; যার কথা বঙ্গবন্ধু অনেক সভা-সমাবেশে উল্লেখ করেছেন। তারপর ঢাকা কলেজ ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার অনেক বার আদর্শিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি। কিন্তু প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। পর পর অনেক সময় পেরিয়ে গেছে, আমি বিস্মিত হলাম বঙ্গবন্ধুর স্মরণশক্তি দেখে।
বঙ্গবন্ধুর জন্য চট্টগ্রাম শহর থেকে কই, শিং ও মাগুর মাছ আনা হয়। এসব পছন্দ করেন বলে খাবার টেবিলের নির্ধারিত স্থানে বঙ্গবন্ধুর জন্য রান্না করা বড় কই মাছ তুলে দিলে তিনি বলে উঠলেন- ‘সব আমাকে দিয়ে দিবি, তোদের জন্য কিছু রাখবি না!’ হেসে হেসে তিনি এ কথা বললেও তার কথায় ছিল আন্তরিকতার সুর। খাওয়া-দাওয়ার পালা শেষে হলো, বঙ্গবন্ধু বিশ্রামে গেলেন।
আমি মোটেলের বিভিন্ন স্থানে, কক্ষে অতিথিদের তদারক করছিলাম। দেখলাম মোটেলের একটি কক্ষে অবস্থান করছেন ও জেগে বসে আছেন আমার ছাত্রজীবনের অনুজ কবি, সাহিত্যিক মাহবুব তালুকদার, যিনি বঙ্গবন্ধুর এপিএস (পরবর্তীতে সচিব হয়েছিলেন)। আপনি একাকী কেন? মাহবুব তালুকদার সেদিন দুঃখ করে বলেছিলেন- ‘জানেন না মোফাজ্জল ভাই, বঙ্গবন্ধু আজ চাটুকার বেষ্টিত, তার আদর্শের সৈনিকরা আজ তার থেকে অনেক দূরে।’ আজ দীর্ঘদিন পর মনে পড়ছে মাহবুব তালুকদার সত্য কথাই বলেছিলেন। আজো সে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। বঙ্গবন্ধুকে সেদিন বিদায় দিয়েছিলাম কাপ্তাই পর্যটন কমপ্লেক্স থেকে। জানতাম না বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেটাই হবে আমার শেষ সাক্ষাৎ। আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে লালিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুকে ধারণ করা এক বাঙালি (অব.) সরকারি কর্মকর্তা, নিভতৃচারী এক লেখক ও গবেষক; যার খোঁজ কেউ রাখে না।
এ ঘটনার কয়েক দিন পরই বিভীষিকাময় ১৫ আগস্টের ঘটনা ঘটল। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অধিকাংশ সদস্য শহীদ হলেন। এমনকি শিশু রাসেল, অন্তঃসত্ত্বা নারীও বাদ যায়নি বর্বরদের হাত থেকে। বেতারে বার বার ঘোষিত হতে থাকে লোমহর্ষক ঘটনার কথা। স্তম্ভিত, হতবাক বাঙালি জাতি। আর এদিকে কাপ্তাই শহরে মাইকে ঘোষিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে। মাইকে ঘোষিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়ে রাখার। অথচ এই সংগঠনটি কয়েক দিন আগেও বঙ্গবন্ধুর সংবর্ধনায় তোরণ নির্মাণের জন্য পর্যটন কমপ্লেক্সের ঠিক সামনে অনুমিত চেয়েছিল।
আমি ও আমার স্ত্রী কান্নায় ভেঙে পড়লাম। অফিসে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়ে রাখার সময় আমার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছিল পানি। আমি আমার সহকর্মী শওকত হাসান (যিনি পরবর্তীকালে হোটেল সোনারগাঁওয়ের স্বত্বাধিকারী ও হোটেল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের সচিব হয়েছিলেন) ও সামসুদ্দিন আহমেদকে (সাবেক পর্যটন করপোরেশনের ডেপুটি ম্যানেজার) বললাম- ছবিটি আবার উঠাতে হবে, সেদিন বেশি দূরে নয়- অযথা সরকারি অর্থ খরচ থেকে বাঁচবে। আমার এ কথা শুনে তারা কী ভেবেছিলেন আমি জানি না। তবে আমি জানতাম- মেঘ সূর্যকে কিছুক্ষণের জন্য আড়াল করতে পারে। সত্য তেমনি সূর্যের মতো উদ্ভাসিত হয়।
১৫ আগস্ট এলেই বার বার মনে পড়ে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর কথা। পলাশীর যুদ্ধ ও নবাব সিরাজউদ্দৌলার করুণ মৃত্যুর সঙ্গে অদ্ভুত মিল রয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যার। বিশ^াসঘাতক বিদেশি চক্রের এ দেশি এজেন্টরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। আজ বঙ্গবন্ধু ঘুমিয়ে আছেন টুঙ্গিপাড়ায়। টুঙ্গিপাড়ার গাছ-গাছালির ছায়ায় তার সমাধি সৌধ। প্রতি নিশিতে নির্মল নীল আকাশ থেকে ঝরে পড়ে বিন্দু বিন্দু শিশির, যেন সারা রাত হাজারো তারার চোখের জলে ¯œাত হয় সমাধি। বঙ্গবন্ধু মানুষকে বিশ^াস করতেন। কোনো বাঙালি তাকে হত্যা করতে পারে- তা তিনি ভাবতেও পারেননি। তাই তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহল থেকে জানালেও তিনি কর্ণপাত করেননি, তিনি ছিলেন উদাসীন। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে মহাত্মা গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার পর জর্জ বানার্ড শ বলেছিলেন- ‘It is too bad to be too good’. বঙ্গবন্ধুর বেলায়ও তাই সত্য।
লেখক: সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন।