এলিজা বিনতে এলাহী
‘দ্য ল্যান্ড অব কুইন’- নামটি শুনলেই মনে হয় বিদেশ-বিভূঁইয়ের আলাপ করছি। একদম তা নয়। বলছি- আমাদের নাটোর জেলার কথা। এটি নাটোরের জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের স্লোগান। ট্যাগ লাইনটি দারুন না! আমার কিন্তু ভীষণ ভালো লেগেছে। বাংলায় লেখা হয় ‘রাজসিক নাটোর’, এটিও সুন্দর। সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত থেকে জানা যায়, গঙ্গা ও করোতোয়া নদীর মাঝে অবস্থিত এলাকায়ই বরেন্দ্রভূমি। এই বরেন্দ্রভূমির উজ্জ্বল স্থান বর্তমান নাটোর জেলা। আর এই রাজসিক নাটোরের এক উজ্জ্বল রত্ন রানি ভবানী।
গোটা বাংলাদেশে নাটোরের দিঘাপাতিয়া রাজবংশের কথা যত সমাদৃত, রানি ভবানী কিংবা নাটোর রাজবংশের কথা ঠিক তত সমাদৃত নয়। কারণ, দিঘাপাতিয়া রাজবাড়িকে উত্তরা গণভবন হিসেবে ঘোষণা করার পর থেকে হয় তো এর জনপ্রিয়তা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। নাটোর, নাটোর রাজবংশ কিংবা রানি ভবানী- এই তিনটি শব্দ প্রায় সমার্থক। তাই নাটোরের কথা বলতে হলে রানি ভবানীর কথা এমনিতেই চলে আসে।
অর্ধ বঙ্গশ্বেরী…! হ্যাঁ, রানি ভবানীকে এই নামেই ডাকা হতো আঠারশ’ শতকে। প্রায় অর্ধেক বাংলা যিনি শাসন করেছেন দারুন দক্ষতার সঙ্গে। রাজ্য পরিচালনার দক্ষতা, জনহিতকর কাজ, দানশীলতা, ধর্মভীরুতা, প্রজাবাৎসল্যতার জন্য আজও তিনি অন্নপূর্ণা, অহল্যা, প্রজাদরদিনী ও দ্বীনপালিনী নামে পরিচিত। নাটোর রাজবংশের এক উজ্জ্বল তারা রানি ভবানী। নাটোরের রাজা রামকান্তের মৃত্যুর পর রানি ভবানী রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব পান ১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দে।
রানি ভবানীর বিস্তৃৃত সাম্রাজ্যের খুব অল্পই টিকে রয়েছে। বিশাল জমিদারির রাজধানী নাটোরে স্থাপনকে কেন্দ্র করে বিচিত্র জনশ্রুতি রয়েছে। সম্ভ¢বত ১৭০৬ থেকে ১৭১০ সালের মধ্যে নাটোর রাজবাড়ি নির্মিত হয়েছিল। প্রাচীন বরেন্দ্রভূমি নাটোর তখন রাজশাহী রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আজকাল রাজশাহী বলতে যত ছোটখাট জেলা বোঝায়, সেকালে সেরকমটি ছিল না। ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই জমিদারি বিস্তৃত ছিল রাজশাহী, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, যশোর, বীরভূম ও বর্ধমান পর্যন্ত।
মধ্যযুগীয় বাংলাদেশের অন্যান্য প্রাসাদের মতোই নাটোর রাজবাড়িতে প্রবেশের জন্য রয়েছে দীর্ঘ পথ, যার দুপাশে অত্যন্ত যত্নে গড়ে তোলা বোতল পাম গাছের সারি। নাটোর রাজপরিবারের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা রামজীবন নাটোরেই স্থাপন করেছিলেন তার প্রশাসনিক কেন্দ্র। সেই সঙ্গে নির্মাণ করেছিলেন রাজপ্রাসাদ, দীঘি, মন্দির, ফল ও ফুলের বাগান। ইতোপূর্বে নাটোর ছিল লস্করপুর পরগনার অন্তর্গত কানাইখালি তরফের একটি ছোট বসতি। প্রায় ৪০ একর জমির উপর নির্মিত বর্তমান প্রাসাদ কমপ্লেক্সটি দুটি প্রতিরক্ষা পরিখা দিয়ে বেষ্টিত। পরিখাটি ছই ভাঙার বিল নামে পরিচিত ছিল। ভগ্ন প্রাসাদের বিচ্ছিন্ন সাতটি ব্লককে বেষ্টনকারী কাদা ও আগাছা আচ্ছাদিত দীঘি সেই পরিখার চিহ্ন বহন করছে।
আগেই বলেছি, নাটোর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজ রামজীবন। মহারানি ভবানী তারই পুত্রবধূ। রানি ভবানীর দত্তকপুত্র মহারাজা রামকৃষ্ণ রায় পরে জমিদারি লাভ করেন। রাজা রামকৃষ্ণের সময় বিশাল নাটোর রাজ্য পরিণত হয় ক্ষুদ্র জমিদারিতে। রাজা রামকৃষ্ণের দুই পুত্র বিশ্বনাথ ও শিবনাথ। এই সময় থেকেই জমিদারি দুই তরফে ভাগ হয়। বড় তরফের জমিদার বিশ্বনাথ রায় ও ছোট তরফের জমিদার শিবনাথ।
আপনি এখন নাটোর ভ্রমণে গেলে দুই তরফের মূল প্রাসাদ, কাছারি, গেস্টরুম, রঙমহল, গার্ডদের ভবন, মালামাল রাখার ঘর এবং নানা ধরনের মন্দির দেখতে পাবেন। ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে এই বিশাল সাম্রাজ্যের অনেক ক্ষতি হয়েছে। পুরো রাজ্য তখন ধংস্তুপে পরিণত হয়েছিল। টিকে থাকা ক্ষুদ্র রাজ্য দেখতে আমার দেড় দিন লেগেছে। এমনটি নয় যে, আমি প্রথম বার সেখানে গিয়েছি। ২০১৮ সালে যা দেখেছি এখন দেখতে গিয়ে নতুন লাগছিল আর অনেক অদেখা বিষয় চোখে পড়েছে। তবে খুব যত্নে নেই রানি ভবানীর সাম্রাজ্য।
লেখক: শিক্ষক, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া।