লেখকঃ মহিউদ্দিন হেলাল, সম্পাদক, পর্যটন বিচিত্রা।
বাংলাদেশ- নদীমাতৃক দেশ। বাংলাদেশের এই পরিচিতি বা ব্রান্ডিং কবে, কিভাবে, কার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল, তার কোন ইতিহাস বা তথ্য জানা যায়নি। হয়ত কোন আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই ‘নদীমাতৃক বাংলাদেশ’ সার্বজনীন ভাবে সমাদৃত হয়ে পরিচিতি লাভ করেছে। আমাদের নদী পর্যটনের ইতিহাস অতি প্রাচীন। প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চলের মানুষের সভ্যতা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য উপভোগ করতে এসেছেন প্রাচীন ও মধ্যযুগের বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা, নিকোলাস পিজেন্টো ও লুইস, কাইশ্যার ফ্রেডরিক, মাহুয়ান, হিউয়েন সাং, ফা হিয়েন প্রমূখ এর মতো বিশ্ব বিখ্যাত পর্যটকরা। তারা এদেশে এসেছিলেন মানুষকে জানতে,মানুষের বিস্ময়কর প্রতিভা ও সৃস্টিশীলতাকে দেখতে। তারা নদীবক্ষে ভেসে-ভেসে এ দেশের সভ্যতা কৃষ্টি-সংস্কৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত হয়েছেন। সে সকল পরিব্রাজকদের ভ্রমণকাহিনী শুধু পর্যটন শিল্পের জন্য নয়, আমাদের এই বঙ্গের গৌরবময় ইতিহাস বিনির্মাণের সমৃদ্ধ ভান্ডার।
ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমলের অন্তিম কাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ বন্দর ছিল অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন এর প্রধান ঘাট। তৎকালীন বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াতের জন্য নদীপথই ছিল প্রধান। সে সময়ের উল্লেখযোগ্য নৌপথ গুলোর মধ্য ছিল- নারায়ণগঞ্জ থেকে চাঁদপুর হয়ে পদ্মা নদী পথে জগন্নাথগঞ্জ বাহাদুরাবাদ ঘাট; গোয়ালন্দ থেকে আরিচার কাছে কাঞ্চনপুর হরিরামপুরের জালালী ঘাট; নারায়ণগঞ্জ থেকে চাঁদপুর বরিশাল হুলারহাট মোড়লগঞ্চ হয়ে খুলনা; আর সবচেয়ে দীর্ঘতম নদী পথ ছিল নারায়ণগঞ্জ থেকে চাঁদপুর গোয়ালন্দ জগন্নাথগঞ্জ সিরাজগঞ্জ বাহাদুরাবাদ তিস্তামুখ ঘাট ফুলছড়ি হয়ে আসামের ধূবলি পর্যন্ত। সে সময় এই নৌ পথে চলাচল করত ৪০ থেকে ৫০টি কয়লাচালিত প্যাডেল স্টিমার।
তখনকার দিনে উচ্চশ্রেণীর যাত্রীদের জন্য এসব প্যাডেল স্টিমার ছিল অত্যন্ত আভিজাত্যপূর্ণ নৌ ভ্রমণ। নেটিভ হিসাবে বাঙালি ভ্রমণকারীর জন্য, প্রথম শ্রেণীর কেবিনে যাত্রী হওয়ার সুযোগ ছিল অত্যন্ত সীমিত। কেবলমাত্র সরকারি উচ্চ পদে চাকরি অথবা অত্যান্ত অভিজাত শ্রেণী হিসেবে ব্রিটিশদের কাছে স্বীকৃতি পেয়েছে, এমন কিছু বাঙালির জন্য প্যাডেল স্টিমারের প্রথম শ্রেণীতে যাতায়াতের সুযোগ মিলত। প্রথম শ্রেনীর সাজানো সেলুনে পাতা থাকতো পাহাড়ি বেতের তৈরি গার্ডেন চেয়ার, যেখানে বসে প্রাকৃতিক দৃশ্য, নদীর প্রবাহ,বাহারি সুস্বাদু খাবার উপভোগ ছিল এক রাজকীয় আয়োজন।
পাকিস্তান আমলে রকেট স্টিমার প্রথম শ্রেণীর চাকচিক্য আভিজাত্যে ব্রিটিশ আমলের মতো অতটা ভালো না হলেও সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে সাবেক আমলের ধারাবাহিকতা বহাল রেখেছিল। বিদেশি রাষ্ট্রীয় মেহমান পাকিস্তান সফরে এলে ঢাকা থেকে খুলনা পর্যন্ত সরাসরি রকেট স্টিমারে এসে, খুলনার বিখ্যাত জুটমিল, নিউজপ্রিন্ট মিল এবং শিপিয়ার্ড পরিদর্শনের পর সুন্দরবন ভ্রমণ ছিল অবধারিত। শত বছরের ঐতিহ্যবাহী যে কয়টি প্যেডেল স্টিমার তার অবয়ব নিয়ে আজও বাংলাদেশে টিকে আছে তার মধ্যে টার্ন, মাছুদ, অট্রিচ, লেপচা উল্লেখযোগ্য। পালটে গেছে কয়লা চালিত বাস্প ইঞ্জিন, সেবার মান, শ্রীহীন হয়ে প্রায় ধংশের মুখোমুখি এসব ঐতিহ্যবাহী জাহাজ। আজও দু-একটি প্যেডেল স্টিমার চলছে ঢাকা বরিশাল, হুলারহাট, মোরলগঞ্চ বা খুলনার পথে অথচ পর্যটন দপ্তরের জোড়াল উদ্যোগ থাকলে নদী পর্যটনের একটি বিলাসী পণ্য হিসাবে এই হেরিটেজ ক্রুজ বিশ্বে সমাদৃত হতে পারত।
অতীতে এ অঞ্চলে সহস্রাধিক নদ-নদী থাকলেও বর্তমানে বিভিন্ন গবেষকের মতে নদীর সংখ্যা ২৪৬ বা ২৮০, আবার কারো মতে নদী, উপনদী, শাখানদী সব মিলিয়ে ৭১০ টি হলেও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২০১১ সালের গবেষণায় ৪০৫ টি নদীর উল্লেখ রয়েছে। সমগ্র বাংলাদেশ এই ছোট বড় নদী সংযোগে সংযুক্ত। আর এটিই নদীমাতৃক বাংলাদেশের মূল শক্তি।
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই এই সমতল অঞ্চলের নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো নদী কেন্দ্রীক। এই অঞ্চলে প্রাচীন নগর সভ্যতার কেন্দ্র গুলো যেমন- নওগাঁর পাহাড়পুর, বগুড়ার মহাস্থানগড, কুমিল্লার লালমাই ময়নামতি ইত্যাদি অন্তত আড়াই হাজার বছর আগে নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল। প্রায় পাঁচ শত বছরের পুরানো মেঘনা ও শীতলক্ষ্যার সঙ্গমস্থলের পাশে গড়ে উঠেছিল নরসিংদীর উয়ারী বটেশ্বরের নগর সভ্যতা।
বর্তমান সময়ও বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য পর্যটন গন্তব্যগুলো নদী, সাগর ও হাওর কেন্দ্রীক যেমন- সুন্দরবন, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, মহেশখালী, নিঝুম দ্বীপ, ভাসমান বাজার, রাতারগুল, বিছানাকান্দি, টাংগুয়ার হাওড় ইত্যাদি। সে বিবেচনায় নদী পর্যটনের তেমন কোন অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি, সরকারি কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান নয় এবং ভবিষ্যৎ কোন পরিকল্পনাও জানা নেই। সম্ভাবনাময় নৌ-পর্যটন উন্নয়নে আজ অবধি তেমন কোন গুরুত্ব পায়নি।
এখনো নদীতে ভেসে ভেসে আপনি উপভোগ করতে পারেন, নদীর জীববৈচিত্র, শুশুকের নিত্য, ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরা, এছাড়া নদীতে যেতে যেতে দেখাতে পাবেন মাছ ধরার নানা কৌশল। কেউ বাশের খাচা বানিয়ে মাছ ধরছে, কেউ বড়শি ফেলে মাছ ধরছে, কেউবা জাল ফেলে। জালের আবার নানা ধরন রয়েছে যেমন- ধর্ম জাল, ঝাকি জাল, ইলিশের জাল, কইয়া জাল ইত্যাদি। বিভিন্ন অঞ্চল ভেদে এর নাম আবার ভিন্ন ভিন্ন। মাছ ধরার কৌশল ভেদে আবার নৌকার ধরন ভিন্ন ভিন্ন। মানুষের দৈনন্দিন জীবন-যাত্রায় নানা ধরনের নৌকার ব্যবহার রয়েছে যেমন- ডিঙ্গি, ডোংগা, কোষ, বজরা, ময়ূর পঙ্খী ইত্যাদি। বিভিন্ন বৈচিত্রময় এই নদী। নদীর পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষদের কর্মকান্ড, অর্থনীতি, জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা নদীকেন্দ্রিক। নদীর প্রবাহের একই সূত্রে গাঁথা তাদের জীবন প্রবাহ। নদীর পারেই গড়ে উঠেছে অনেক হাট-বাজার,উৎসব ও মেলা। নদীকেন্দ্রিক অনেক উৎসব যেমন- নৌকা বাইচ, দূর্গাপূজার প্রতিমা বিসর্যন, গংগা স্নান, দুবলার চরে রাস মেলা ইত্যাদি পর্যটকদের আকর্ষণীয় ইভেন্টে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ ঋতু বৈচিত্রের দেশ। ঋতু বৈচিত্রের সাথে সাথে নদীর প্রবাহমানতায় ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারন করে। বর্ষার নদী, শীতের নদী, গ্রীষ্মের নদী যেন একই অঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন রূপ। আবার সকালের সূর্যাস্তের নদী, দূপুরে প্রখর রোদে নদী, সন্ধ্যার সূর্যাস্থের আবহে নদীর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন রূপ। ভরা পূর্ণীমার জ্যোৎস্না রাতের নদী যেন অবর্ণ্নীয় নৈসর্গীক আবহ। বৈচিত্রময় আমাদের নদীর সৌন্দর্য। পর্যটকদের জন্য নৌ ভ্রমণে এমন আকর্ষণ একটি বিরল অভিজ্ঞতা। আমি মনে করি যথাযথ অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে, বিশ্বপর্যটন বাজারে এর যথার্থ বিপণন করতে পারলে বাংলাদেশের নদী পর্যটন অনন্য উচ্চতা স্পর্শ করবে এবং পর্যটন শিল্পে নতুন সম্ভাবনার ক্ষেত্র উন্মচিত হবে।
নৌ পর্যটনের উন্নয়ন সম্ভব হলে নদীর অর্থনৈতিক ব্যবহার বেড়ে যাবে, নদী কেন্দ্রীক উৎসব ও স্থানীয় শিল্প-সংস্কৃতি সংরক্ষিত হবে। পর্যটন, নদী সম্পদ ও সংস্কৃতি বিষয়ক ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে এবং তিরবর্তী গ্রাম গুলোর জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটবে। নৌ পর্যটন যথাযথ ভাবে উন্নয়ন সম্ভব হলে নদীমাতৃক বাংলাদেশের অর্থনীতি বিনির্মাণে পর্যটন শিল্প বিশেষ ভূমিকা রাখবে।