‘আজি ঝরঝর মুখরো বাদর দিনে জানিনে জানিনে;
কিছুতে কেন যে মন লাগে না, লাগে না।‘
এমনি এক বর্ষণ মুখর দিন ছিল; মন কিছুতেই চাইছিল না ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে। শহরের বৃষ্টি মানেই কাঁদা জলে মাখামাখি আর দুর্গন্ধ, তাইতো মন যেতে চাইলো এমন এক খোলা প্রান্তে যেখানে আকাশ আর মেঘ আলিঙ্গনে মেতেছে, যেখানে সকাল থেকে ফেরিওয়ালার চিৎকার নেই, গাড়ির কালো ধোঁয়া নেই –হর্ণের তীব্রতা নেই, যেখানে মিশে আছে মাটি আর সবুজে অবিরাম সখ্যতা; এমন এক খোলা প্রান্তরে মন ছুটে যেতে চাচ্ছিল।
মৌলভীবাজার শহর থেকে খুব দূরে যাবার সময় আমার হাতে নেই, তাই সাংবাদিক বন্ধু মাহমুদ এইচ খানকে প্রস্তাব করলাম এই বাদলা দিনটিকে কাজে লাগাতে। তিনি সিলেটের মৌলভীবাজারের সন্তান, তাই এক মুহূর্তেই আমাকে জানিয়ে দিল রাঙাউটি রিসোর্টের কথা; যেখানে যেতে আমাদের সময় লেগেছে মাত্র বিশ মিনিট। শহরের পানসি রেঁস্তোরাতে সকালের নাস্তা শেষ করেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম, তখন মেঘ গুলো দল পাকাচ্ছে মাথার ওপর। সি এন জি আমাদের ছেড়ে দিল কুলাউড়া রোডে, তালতলা গ্রামে যা কীনা মনু ব্যারেজের কাছে। তখনো বুঝতে পারছিলাম না শহরের এতো কাছে কী করে অবকাশ যাপন করার জন্য রিসোর্ট থাকতে পারে ; যদিও আমার মাথায় কেবল ঘুরছে বৃষ্টিতে ভেজার নেশা।
মুল রাস্তা থেকে হাঁটা আরম্ভ করলাম, বৃষ্টি তখন জেঁকে বসেছে। আয়েশ করে এখানে ভিজে গেলে কোন মতেই উদ্ধার পাওয়া যাবেনা, সঙ্গে বাড়তি কাপড় আনিনি আর হাতেও আছে ডি এস এল আর। তাই তড়িঘড়ি পা চালালাম আর মুহূর্তেই পৌঁছে গেলাম রাঙাউটির দরজায়। কিন্তু শুধু দরজায় টোকা দিলেই তো আর ঢোকার অনুমতি মিলবে না, তাই আগ থেকে রাঙাউটি রিসোর্টের মহা ব্যবস্থাপক মোছাদ্দেক আহমেদ পাপ্পু ভাইকে বলেই রেখেছিলাম, এখানে ঘুরতে আসবো। তাই এন্ট্রি খাতায় আমাদের দু’জনার নাম লিখে তবেই ভেতরে যাবার অনুমতি মিললো।
রাঙাউটি রিসোর্টের আর্কিটেকচার প্ল্যান কিন্তু দারুণ ! মৌলভীবাজার সরকারি স্কুলের ৯১ এর ব্যাচের ৩১ জন উদ্যোমী বন্ধুর স্বপ্নের ফসল ৪৫ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই রাঙাউটি যার যাত্রা শুরু ২০০৯ সাল থেকে।
ভেতরে প্রবেশ করলে হাতের বাঁ পাশে ঘন করে সারি দেওয়া গাছের আড়ালে খানিক খোলা জায়গা পেরুলেই রিসেপশন, এরপর আছে খাবার ঘর। আর বড় তিন তলা কটেজ পেরিয়ে গেলে একটা একটা কুটির সারিবদ্ধ ভাবে সাজানো; কেউ যেন রঙ তুলি দিয়ে এঁকে দিয়েছে ঘরগুলোকে, একই রকম সব গুলোর কাঠামো।
বৃষ্টি তখন দামাল রূপ নিয়েছে, আমরা ভেতরে গিয়ে বসলাম, স্প্লিট এসি দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে, ভেজা চুল খানিক শুকিয়ে নিতেই আমার চোখ গিয়ে পড়লো হাতের ডান পাশটায়। চুল শুকানোর পাঁয়তারা নিমিষে থেমে গেল নদীর বাঁক দেখে, মনু নদের একটি ব্যাপক অংশ গিয়ে মিশে আছে রিসোর্টের গা ঘেষে; তার ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে নানান রকম বোট, ইচ্ছে করলেই আমরা ঘুরে আসতে পারি নদীর অনেকটা অংশ আবার ইচ্ছে করলে সাঁতার কাটা যাবে; মাছ ধরা যাবে। গোল করে সাজানো আছে বেশ কয়েকটা চেয়ার যেন আড্ডাবাজ বন্ধুদের জন্য রাঙাউটি আগ থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করে রেখেছে।
কফি হাউজের সেই আড্ডা আজ থাকুক বা নাই থাকুক, পুরনো বন্ধুদের নিয়ে ফেলে আসা দিন গুলোতে হারিয়ে যাবার জন্য এক অনবদ্য জায়গা এই রাঙাউটি রিসোর্ট। বৃষ্টি যখন তুমুল বেগে; আমাদের জন্য গরম গরম চা চলে এলো ভেতর থেকে। চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে পাপ্পু ভাইয়ের সাথে খানিক আলাপ সেরে নিলাম। রিসোর্টের ফেসবুক পেইজ এবং সেখানে বুকিং করবার যাবতীয় নিয়মাবলি জেনে নিলাম আমার পাঠকদের জন্য।
ঢাকা থেকে যারা এখানে আসতে চান তারা হট লাইনে ফোন দিয়ে শুধু একটা রুম বুকিং করে নিলেই পেয়ে যাবেন কৃত্রিম এবং প্রকৃতির মেল বন্ধনে গড়া অপরূপা রাঙাউটি’র আনন্দ।
ফেইসবুক পেইজ- RangautiResort .
ওয়েবসাইট ভিজিট করুন- www.rangautiresort.com
চলছে ফটোশ্যুট, চলছে বিষ্টিতে ভেজাভিজি, সেই সাথে সুইমিং পুলে পা ডুবিয়ে বসে থাকা, তার সাথে বাড়তি পাওনা দোলনায় দোলা। বয়স কী আর বেড়েছে নাকি; একটানেই ১৪ তে নেমে গেল তখন। আমরা মুহূর্তে হারিয়ে গেলাম আমাদের ফেলে আসা শৈশবে, দোলনার পাশাপাশি আছে স্লিপার, ভারি বর্ষায় বাচ্চারা নেই বলে সেই সুযোগ আমিই লুফে নিলাম। গান বেজে চলেছে, সেই সাথে বৃষ্টির সুর সমান তালে বাজছে।
ঠিক এই সময় যদি খিচুড়ি আর ডিম ভাজা হয় তবে বেশ হয়। দুপুর গড়িয়ে তখন দু’টো, না চাইতেই যেন আর এক পসলা বৃষ্টি।পাপ্পু ভাই ভাই আমাদের জন্য দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করেছেন। ডাইনিং টেবিলে পা রেখেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম –খিচুড়ি, ডিম ভাজা এবং ঘন ডাল। আহা ! এমন করে যাচ্ছে সময় যাক না …
কিন্তু চাইলেই তো আর সময়কে দু’হাতের মুঠোয় ধরে রাখা যাবে না। জীবনের প্রয়োজনে আমাদের যার যার কর্মস্থলে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু এই অপ্সরী জলাধারের মাঝে নিপুণ হাতে গড়ে তোলা নৈস্বর্গীয় কুটির আমাকে বার বার এখানে নিয়ে আসবে। একবার শীতে এসে ঘুমিয়ে নেব মেঘ পালকে ঢাকা চাদরে, সকাল হতেই হেসে উঠবো দেশী বিদেশি পাখিদের কোলাহলের মাঝে। মনু নদের ঠাণ্ডা জলে ডুব দিয়ে খুঁজে নেব ফেলে আসা শৈশব।
ঢাকা থেকে সরাসরি মৌলভীবাজারে যেতে হলে আপনাকে বাসে চড়তে হবে। তবে ট্রেনে চড়ে যেতে চাইলে শ্রীমঙ্গলে নেমে যেতে হবে আপনাকে। শ্রীমঙ্গল থেকে লোকাল বাস অথবা সিএনজি অটোরিকশায় চড়ে আপনি মৌলভীবাজারে যেতে পারবেন। আকাশপথে যেতে চাইলে আপনাকে ঢাকা থেকে সিলেটে যেতে হবে এবং সেখান থেকে সরাসরি বাসযোগে আপনি মৌলভীবাজারে পৌঁছাতে পারবেন। মৌলভীবাজার থেকে সি এন জি ভাড়া করে চলে যেতে পারেন এই ছিমছাম পরিবেশবান্ধব রিসোর্ট রাঙাউটিতে।
এখন শুধু অপেক্ষা বাতাস থেকে ভাইরাস যাবে কবে !! কবে আবার গা ভেজাবো মেঘের কান্না জলে …