লেখক : শিমুল খালেদ – ব্যাংকার
চকরিয়া থেকে ছেড়ে আসা আমাদের বাহন মাতামুহুরী নদী, হারবাং ছড়া ছেড়ে আসার পর পথের দুই পাশের ছবি বদলাতে লাগল। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ। বিশাল সব গর্জন গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে টিলায় টিলায়। কোথাও বা সেগুন গাছের বন। পথজুড়ে দুপাশের দারুণ সেই দৃশ্যপট দেখতে দেখতে ভাবছিলাম গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ‘এই পথ যদি না শেষ হতো’লেখার আগে নিশ্চয় এ রকম কোনো পথ দিয়ে গিয়েছিলেন! হাতি চলাচলের পথের নির্দেশনা ফলক দেখে বুঝলাম চুনতি অভয়ারণ্যের কাছাকাছি চলে এসেছি। তবে চুনতি বাজারে নামার পর খোঁজ নিয়ে জানলাম অভয়ারণ্য কিছুটা পেছনে ফেলে এসেছি। পথ যেহেতু কম, তাই ভেবে হেঁটেই উল্টো পথে চললাম।
কিছু দূর গিয়ে চোখে পড়ে বনবিট অফিসের রাস্তা। মহাসড়ক থেকে ডানে বনের ভেতর দিয়ে চলে গেছে পথ। ভেতরে ঢুকেই পথের ধারে কয়েকটি মাটির ঘর। আরেকটু সামনে গিয়ে বনবিট অফিস। সেখানে কাঠ আর মুলিবাঁশের বেড়ায় তৈরি কুটির। তবে এই পথ থেমে গেছে বনবিট অফিস পর্যন্তই। তাই মহাসড়কে ফিরে এসে আবার হাঁটতে থাকলাম। রোদের মধ্যে চলতে গিয়ে বেশ তেষ্টা পেয়েছে। ফোর সিজনস রেস্তোরাঁর কাছে এসে গলা একটু ভিজিয়ে নিলাম। তারপর আরেকটু এগিয়ে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যের দেখা পেয়ে যাই। মহাসড়কের পাশে সাইনবোর্ডে লেখা- চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য প্রকৃতি ব্যাখা কেন্দ্র। বাঁধানো দেয়ালের একপাশে প্রবেশ গেট। আছে প্রহরার কাউন্টার। তবে গেটও খোলা, আবার কাউন্টারেও কারো দেখা নেই। বুঝলাম দর্শনার্থীরা সম্ভবত খুব একটা এদিকে পা মাড়ান না বলে প্রহরা কিংবা টিকিট, কোনোটারই বালাই নেই।
টিলার বনপথে ওঠতে ওঠতে দুপাশের অরণ্যের ঠাসবুনোট আর ঘন হয়ে গেছে। ওপরে ওঠতে গিয়ে পথের পাশে লতাপাতার আচ্ছাদনের নিচে দেখি অনেকটা মানুষের মুখের মতো অবয়ব! আসলে তা একজাতের পিঁপড়ের কান্ডকারখানা। পিঁপড়ের নিপূণ কায়িক পরিশ্রমে গড়ে তোলা এমন বাসা আসলেই চমকে দেয়ার মতো। পথের আরেক জায়গায় বেশ কিছু ছত্রাক জন্মেছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখি পচে ফসিল হয়ে যাওয়া একটি গাছের কান্ডের ওপর জন্মেছে ছত্রাকগুলো। বনের ভেতরে বিশাল সব গর্জন গাছ ওপরে ওঠে গেছে যেন আকাশ ফুঁড়ে। সুউচ্চ এসব গর্জন গাছের সবুজ ছুঁয়ে দিতে সাদা মেঘেদের সাথে নিয়ে যেন নেমে এসেছে আকাশের অবারিত নীল। এক জায়গায় বড়সড় কিছু গর্জন গাছ পড়ে থাকতে দেখলাম।
চুনতির বনকে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তোলা হয় ১৯৮৬ সালে। আয়তনে প্রায় আট হাজার হেক্টরের বনটি দেশের প্রথম বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। প্রায় ৪৬৮ প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও পাখি এবং ৬৯১ প্রজাতির উদ্ভিদ চুনতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এশীয় হাতি এই বনের অন্যতম অলংকার। হাতির চলার পথে সাবধানে হাঁটার নির্দেশনা বনপথে চোখে পড়ল। চুনতির বন হয়ে হাতির বিচরণক্ষেত্র মিয়ানমার পর্যন্ত বিস্তৃত। যদিও সম্প্রতি চালু হওয়া চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনের কারণে এই বিচরণ পথ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বনে আরও আছে ভালুক, গেছোবাঘসহ নানা প্রাণীর বিচরণ। গর্জন ছাড়াও নানাজাতের পাহাড়ি গাছপালা, তরুলতা বন সমৃদ্ধ করে রেখেছে।
অভয়ারণ্যের ভেতর আছে তিনটে পায়ে হাঁটা পথ বা ট্রেইল। বনপথে আমাদের সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছিল নানা জাতের পাখির কলকাকলি। দুপাশে বনের ছাদোয়া দেয়া পথে হেঁটে হেঁটে বড় একটি টিলা পার হওয়ার পর ঢালু খাদ। তারপর আবার পাহাড়ের ওপরের দিকে পথ চলে গেছে। পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে বনের মাঝে দেখি সুন্দর একটি দালান। বেশ আধুনিক নকশায় বানানো হয়েছে। যেন ঝকঝকে আধুনিক এক জঙ্গলবাড়ি! তবে সেখানে কাউকে পেলাম না। পাকা দালানটি সম্ভবত বনবিদ্যার কোনো প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হবে।
বনের ভেতর ট্রেইল ধরে হাঁটতে থাকি। ছবি তোলার ফাঁকে সোহেল কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ সজোরে তাড়া দিল- দেখে যান ভাইয়া, গাছের ভেতর ঝরনা! ওর কথায় তাজ্জব হয়ে গেলেও আসল ঘটনা দেখে না হেসে পারলাম না। বিশাল আকৃতির এক গর্জন গাছের বাকল ফেটে ভেতর থেকে আঠালো কষ গড়িয়ে পড়ছে। লাল-কালো রংয়ের যেন এক লিলিপুট ঝরনা! সেখান থেকে চোখ ফেরানোর আগেই হঠাৎ বন কাঁপিয়ে উঁচু এক গর্জন গাছের মগডালে আলোড়ন ওঠে। মাথার ওপর খাড়া আকাশপানে আর সূর্যালোকের কারণে সেখানটায় কিছু ঠাহর করা যাচ্ছিল না। গর্জনের মগডাল আর উচ্চতার কারণে প্রথমে ভেবেছিলাম ধনেশ পাখি কিনা! গাছটি থেকে একজোড়া বানর জাতীয় প্রাণী লাফিয়ে বনের অন্যদিকে চলে যেতে দেখে সেই সংশয় কাটলো। তবে প্রাণী দুটো উল্লুক নাকি বানর ছিল, সেই সংশয় রয়ে গেল। দুপাশের ঘন বন রাস্তার ওপর ছাদের মতো ঢেকে দিয়েছে। যেন সবুজের এক সুড়ঙ্গ। হঠাৎ করে বনের ভেতর থেকে কিছু একটার সড় সড় ছড়াৎ ছড়াৎ শব্দ শুনতে পাই। হাঁটা থামিয়ে কান খাড়া করে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে পড়ি। বনের গভীরতার কারণে শব্দের উৎস ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছিল না। সম্ভবত কোনো বন্যপ্রাণী বনতলে বিচরণ করছে। আমরা ছাড়া আশেপাশে কোনো মানুষজন নেই। কিছুটা ক্লান্তি ও ভর করেছে। ফিরে আসার জন্য দুজন এবার ঘুরপথে পা চালাই।
কীভাবে যাবেন
চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে যেতে চাইলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে ফোর সিজনস রেস্তোরাঁর থেকে একটু এগিয়ে প্রকৃতি ব্যাখা কেন্দ্রের গেটে নামতে পারেন। যেহেতু বন, তাই খাবার-দাবারের ভালো ব্যবস্থা নেই বলে শুকনো খাবার সাথে নেয়া উত্তম।