লেখক: মো. জিয়াউল হক হাওলাদার (মহাব্যবস্থাপক -পরিকল্পনা, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন)
সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে স্থানীয় জনমানুষের মধ্যে পর্যটন পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও পর্যটন এবং সেবা শিল্পের প্রচারে বেশ সহায়তা করতে পারে। বিশ্বব্যাপী টেকসই পর্যটন উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সুবিধাদি নিশ্চিত করা। সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে স্থানীয় জনগোষ্ঠী সহজেই সামাজিক পর্যটন উন্নয়নের বিভিন্ন কর্মকান্ডে যুক্ত হতে পারে এবং আয় করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে যেমন- হস্তশিল্প উৎপাদন ও প্রচার, স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতিতে স্থানীয় খাবার প্রস্তুত এবং পর্যটকদের সম্মুখে পরিবেশন, ফল ও ফুলের চাষ এবং বিপণন করা ইত্যাদি।
দেশি-বিদেশি পর্যটকরা স্থানীয় হস্তশিল্প কিনতে চায়। স্যুভেনির এবং খাঁটি স্থানীয় খাবারের স্বাদ নিতে চায়। সামগ্রিক পর্যটন কার্যক্রমে সামাজিক ব্যবসার যোগসূত্র বাংলাদেশের জাতীয় পর্যটনকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। এই ধারণাটি বাস্তবায়নের ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন আয়-উপার্জন বৃদ্ধিসহ সকল ধরনের উপকারিতা তাদের কাছে সহজে পৌঁছানো যাবে।
যেহেতু বাংলাদেশে পর্যটন খাতে এখনও উল্লেখযোগ্য বড় কোনো বিদেশি বা বেসরকারি বিনিয়োগ আসেনি, তাই এখানে সামাজিক ব্যবসা পারে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা তৈরি করতে, স্থানীয়দের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি এবং স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রার উন্নতিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে। যদি আমরা সামাজিক ব্যবসার ধারণাটিকে কমিউনিটি পর্যটন উন্নয়ন কার্যক্রমের সাথে সঠিকভাবে যুক্ত করতে পারি, তাহলে এর জন্য কম বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে বা কিছু ক্ষেত্রে কোনো বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে না, কারণ যা কিছু দক্ষতা এবং সম্পদ স্থানীয়ভাবে পাওয়া যাবে সেটাই উদ্যোক্তা তৈরির জন্য প্রধান বিনিয়োগ হবে। এটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের জাতীয় পর্যটন বিকাশে সহাযয়তা করবে।
হস্তশিল্প উৎপাদন, স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী খাবারের প্রচার এবং স্থানীয় বেকার যুবকদের যেমন ট্যুর গাইড, খাবার প্রস্তুতি ও পরিবেশন, স্যুভেনির বিক্রেতা, আবাসন সেবা (হোম স্টে) ইত্যাদি প্রশিক্ষণের জন্য স্থানীয় জনগণকে স্বল্প পরিসরে হলেও ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করা যেতে পারে। এ কার্যক্রম অবশ্যই স্বল্প সময়ে মধ্যে ভালো ফলাফল দিতে পারে। সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন গ্রামীণ নারীদেরও আত্মনির্ভরশীল হতে সহায়ক হবে। গ্রামীণ ব্যাংক কিংবা পিকেএসএফ এই ধারণাটি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে পারে। পিকেএসএফ, পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন কিংবা গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম বাস্তবায়নে স্থানীয় এনজিওগুলিকে সহজেই নিয়োজিত করতে পারে।
বাংলাদেশের কিছু ঐতিহ্যবাহী স্থান- পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, কান্তজিউ মন্দির এবং ষাট গম্বুজ মসজিদসহ বিভিন্ন এলাকায় অনেক বার পরিদর্শন করার পর আমার বেশ কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায় এ সকল এলাকায় সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে কমিউনিটি ট্যুরিজম বিকাশের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলসমূহ সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে কমিউনিটি ট্যুরিজম উন্নয়নের জন্য উর্বর ক্ষেত্র। এখানে দেখা যায় অনেক স্থানীয় নারী নিজেরাই নিজেদের উৎপাদিত খাবার এবং স্যুভেনির বিক্রি করছেন। এমনকি এ এলাকার নারীরা খাবার প্রস্তুতে সাহায্য করার জন্য পিকনিক পার্টিদের সাথে মজুরি নিয়ে দর কষাকষি করে। স্থানীয় অনেক নারী এই ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোতে চায়ের স্টল পরিচালনা করছেন। পর্যটকদের পাশাপাশি স্থানীয় লোকজনও এসব চা-স্টল থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনেন।
বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশের কৃষি এবং গ্রামীণ অর্থনীতি এখনও গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রতিটি গ্রামকে সামাজিক ব্যবসার ধারণা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদেরকে পরিণত করতে হবে একেকটি পর্যটন গন্তব্য বা ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন হিসেবে। এ সকল গন্তব্যে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা বেড়াতে যাবে। ফলে গ্রাম এলাকায় আর্থিক কর্মকান্ডসহ কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।
বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি, গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গাকরণসহ গ্রামে শহরের সেবা পৌঁছানের জন্য গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়ন একান্ত প্রয়োজন। গ্রামাঞ্চলে কমিউনিটি ট্যুরিজমের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। আমাদের গ্রামের যুবসমাজকে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এখানে প্রয়োজন পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ- গাইডিং, কুকিং, ইন্টারপ্রিটেশনসহ নানা প্রশিক্ষণ। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন পর্যটন আকর্ষণীয় এলাকার যুব ও যুব নারীদের কুকিং, গাইডিং এবং হাইজিনসহ বিভিন্ন শর্ট কোর্সে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত রাখবে। গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়নের মাধ্যমে সকল সম্প্রদায়ের আর্থিক স্বচ্ছলতাসহ এদের স্থায়ী উপার্জনের পথ সুগম হয়। এজন্য ছোট ছোট পর্যটন উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে এনজিওরা ঋণ প্রদান করতে পারে।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন দেশের পর্যটন উন্নয়নে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ সংস্থা দেশের পল্লী এলাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পর্যটন আকর্ষণীয় স্থানে পর্যটন অবকাঠামো তৈরি করছে। বাংলাদেশে পর্যটন করপোরেশনের পর্যটন স্থাপনাগুলোর আশেপাশে গ্রাম এলাকায় প্রত্যেক্ষ এবং পরোক্ষ কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে এখানে বেশ কিছু উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। এছাড়া গ্রামীণ জনসাধারণ তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে এবং এগুলো সুরক্ষার জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। রাজধানী ঢাকার আশপাশে এবং অন্যান্য জেলায় বিশেষ করে নেত্রকোনা, সিলেট এবং পার্বত্য অঞ্চলসমূহের পর্যটনের মাধ্যমে গ্রামীণ জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরো হবে। গ্রামীণ উন্নয়নে বেশ উদ্যোগী ভূমিকা পালন করছে।
অনেক পর্যটন বিশেষজ্ঞ সুপারিশ করে থাকেন, যে কোনো প্রকল্প প্রণয়নে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করা এবং কমিউনিটি ট্যুরিজম উন্নয়নের জন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সবচেয়ে জরুরি। এটা আসলে সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে করা যায়। কখনও কখনও কমিউনিটি ট্যুরিজম প্রকল্প প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে স্থানীয় সম্প্রদায়কে জড়িত করা কঠিন, কারণ এই সেক্টরে স্থানীয় জনগণের সচেতনতার স্তর এখনও নীচে এবং তারা নিজেদের ভবিষ্যতের সুবিধা সম্পর্কে খুব বেশি সচেতন নয়। এখানে সামাজিক ব্যবসা একটি কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে স্থানীয় জনগণকে কমিউনিটি ট্যুরিজম উন্নয়নে সম্পৃক্ত করার জন্য, কারণ সামাজিক ব্যবসা তাদের বোঝানো সহজ। কমিউনিটি ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট এবং সামাজিক ব্যবসার মিথস্ক্রিয়তার বিষয়ে জাতীয় পর্যটন নীতিমালা ও পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এভাবেই বাংলাদেশ এই সেক্টরে বিশ্বের রোল মডেল হতে পারবে।