লেখক: শিমুল খালেদ (ব্যাংক কর্মকর্তা)
দূর পাহাড়ের জুমে ফলানো আনারস এক জায়গায় স্তুপ করে রাখা; গায়ের চাদর একপাশে রেখে মিঠেমিঠে রোদ গায়ে মাখতে মাখতে মধ্যবয়সী বিক্রেতা লোকটি বেতের মোড়া পেতে বসেছেন। ধাতব শব্দ তোলে দোকানের সাটার একটা দুটা করে ওঠতে শুরু করেছে। দীর্ঘ ভ্রমণের পর আড়ষ্ট হয়ে থাকা শরীর এক-আধটু কসরতের জন্য মুখিয়ে ছিল। তবে সে আশায় গুড়েবালি ঢেলে গিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক তাড়া দিল, তড়িঘড়ি ওঠে পড়তে। তিন চাকায় চড়িয়ে নিয়ে যাবে আমাদের গন্তব্যস্থল কাপ্তাইয়ে, কর্ণফুলী নদীর তীরসংলগ্ন ক্যাম্পসাইটে। সারারাত এক্সপ্রেস ট্রেনের পর ভোরবেলায় বাস, অতঃপর অটোরিকশার মাধ্যমে প্রায় ১৬ ঘণ্টার দীর্ঘযাত্রা শেষ হচ্ছে শেষতক। রাঙামাটিতে এটা আমার প্রথম এবং এই আসাটাও হুটহাট করেই।
সপ্তাহের মাঝামাঝি এক সকালবেলার কথা। সেদিন সকাল সকাল অচেনা নাম্বার থেকে ফোনে একটা এসএমএস আসে।আমেরিকা প্রবাসী বন্ধু রাফাত আনসারী সেটি পাঠিয়েছে। মেসেজের সারমর্ম হলো, সে দুদিন আগে দেশে ছুটিতে এসেছে এবং সপ্তাহের শেষ দিকে কয়েকজন মিলে রাঙামাটি বেড়াতে যাচ্ছে। আমাকেও সেই দলের সদস্য ধরে নিয়ে ইতোমধ্যে ট্রেনের টিকিটও কেটে ফেলেছে। আমি যেন অমত না করি!
পাহাড়ের গা পেঁচিয়ে ফিতার মতো চলে যাওয়া পিচঢালা পথ ধরে ছোট বাহন জোড়া চলতে থাকল। মাঝে মাঝে একটা দুটা সিঁড়ি পথ চোখে পড়ল, মূল পথ থেকে ওপরের দিকে ওঠে গেছে, পাহাড়ের চূড়ায় বাংলো আকৃতির একটা দুটা কুটির। যেতে যেতে পথের দুপাশ আর ঘন সবুজ হয়ে ওঠে। বনবনানীর চেহারাও পাল্টায়। পাহাড়জুড়ে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা পাহাড়ি বনের ঠাসবুনোট, বনতলে লতাগুল্ম কন্দজাতীয় উদ্ভিদের আচ্ছাদন। আন্দাজ করি কাপ্তাইয়ের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সীমায় চলে এসেছি। পথের ধারে সাটানো সাইনবোর্ড দেখে নিশ্চিত হলাম কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান হয়েই যাচ্ছি। অরণ্যের বুনো স্পর্শ মেখে চোখে মুখে আছড়ে পড়া পৌষের হিমেল বাতাস তা যেন আরও বাড়িয়ে দেয়। গন্তব্যস্থল কাপ্তাই প্রশান্তি পার্কের ফটকের সামনে ইতোমধ্যে এসে পড়েছি। ঘড়ির কাঁটায় সবেমাত্র দুপুরের ঘণ্টা ছুঁইছুঁই করছে। আমরা এসেছি ক্যাম্পিং ট্যুরে। তাই আপাতত বিছানায় গা এলিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। তবে সবার ব্যাগ-ব্যাগেজ রাখার জন্য একটা রুম পাওয়া গেল বৈকি। সেখানে ব্যাগপত্র রেখে বিশ্রাম ছাউনিতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে চলে গেলাম নদীর একদম তীরে। খরস্রোতে
কর্ণফুলীর কলকল স্রোত বয়ে চলেছে জীবনের উচ্ছাসে। পানির স্রোতের একদম পাশ ঘেঁষে পার্ক কর্তৃপক্ষের বানানো একটা মাচাঘর। উপরে শন ও বেত, মেঝে ছাওয়া হয়েছে মুলিবাঁশ দিয়ে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে সাতপাঁচ না ভেবেই মাচার মেঝেতে শুয়ে পড়ি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দল ভারি করতে যোগ দেয় রাফাত ও রুবেল। শীত ঋতুর শান্ত সৌম্য কর্ণফুলী। দ্বিপ্রহরের উজ্জ্বল সূর্যালোকে ঝলমল করছে তার ছোট ছোট ঢেউ কিংবা অল্পসল্প নড়াচড়া। যেন রোদ গায়ে পড়তে উজ্জ্বল প্রভা ঠিকরে পড়তে পড়তে ঝলমল করছে অজস্র সোনার নোলক। নদী পেরিয়ে ওই পাশে শিলাপাথরের পাহাড়, তার গায়ে ঘন পাহাড়ি বন। যেন নদীর স্রোত ফুঁড়ে ওঠে ওপরে চলে গেছে কত কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই পাহাড়শেণি। দীর্ঘ ভ্রমণের পর গা এলানোর সুযোগ পেয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে, শীত দুপুরের ফুরফুরে শীতল হাওয়া গায়ে মেখে কতক্ষণ শুয়ে ছিলাম ঠিক জানি না। বছর ষোল’র ছিপছিপে গড়নের এক কিশোরের গলার আওয়াজে সম্বিৎ ফিরল। ঘাটে কায়াক বোট প্রস্তুত; আমাদের কায়াকিংয়ের সময় হয়ে গেছে। মরা ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শুকনো একটি গাছের নিচে অপেক্ষমাণ রং-বেরঙয়ের কয়েকটি কায়াক বোট। চারটি বোটের প্রতিটিতে দুজন করে ভাগ হয়ে আমরা আটজন কায়াকে চেপে কর্ণফুলরী টলমলে স্রোতে নেমে পড়ি। একদম প্রথম বোটের সামনের সিটে আমি, পেছনের সিটে আমার সঙ্গী সুমন। বোটগুলোর প্রতিটির জন্য একটা করেই বৈঠা বরাদ্দ। দুপাশে পাখা লাগানো বৈঠা ঠেলতে ঠেলতে অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছিল। এ এক আজব জলতরী, যেটার পেটের ভেতর ঢুকলে অর্ধেক শরীর ঢুকে যায় আন্ডারওয়াটার বা পানির তলায়! বেশ রোমাঞ্চ লাগছিল। পানিতে বৈঠার চাপে কায়াক ছুটতে থাকে। স্রোতের ভাটি ধরে যেতে যেতে আমরা দেখতে থাকি নদী তীরের দিন যাপন। পানিতে হাপুস হুপুস করছিল ছেলেপুলেদের একটা দল। আরেকটু সামনে যেতে দেখলাম ছোট মাছের জাল নদী থেকে তোলে তা থেকে মাছ ধরে খলুইতে রাখছে এক জেলে
দম্পতি। বৈঠা বাইতে বাইতে খেয়াল করলাম নদীর ঠিক মাঝামাঝি চলে এসেছি। আর সেখান থেকে চোখের সম্মুখে দৃশ্যমান হয় মনোমুগ্ধকর এক দৃশ্যপট। নদীর মাঝ বরাবর পানির পৃষ্ঠদেশের দেড় দুই ফুট ওপর থেকে সামনে তাকালে, ভাটির পানে বয়ে যাওয়া জলস্রোত পেরিয়ে দুই পাড়জুড়ে ঘন অরণ্য ঢাকা পাহাড়শ্রেণি। নদীর গা-ঘেঁষা সেই পাহাড় পেরিয়ে পেছনে উঁকি দিচ্ছে আরও উঁচু পাহাড়। তারপর আরও উঁচু পাহাড় স্তর। অপূর্ব সে দৃশ্য! সীতাপাহাড় আর রামপাহাড় নামের এই
পাহাড়শ্রেণির ভেতর দিয়েই খর¯্রােতা কর্ণফুলী প্রবাহিত হয়েছে। কর্ণফুলীর উচ্ছল স্রোতধারা আর চারপাশের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যপট জন্ম দিয়েছে না জানি কতশত ছন্দ আর কবিতার! প্রেমের কবি নজরুল তাই তো কর্ণফুলীকে ভালোবেসে লিখেছিলেন- ‘তোমার সলিলে পড়েছিল কবে কার কানফুল খুলি, তোমার স্রোতের উজান ঠেলিয়া কোন তরুণী কে জানে, সাম্পান নায়ে ফিরেছিল তার-দয়িতের সন্ধানে, আনমনে তার খুলে গেল খোঁপা, কানফুল গেল খুলি, সে ফুল যতনে পরিয়া কর্ণে হ’লে কি কণফুলী?’
কর্ণফুলী নদীর নামের উৎপত্তি সর্ম্পকে নানা কাহিনি শোনা যায়। তবে সবচে’ প্রচলিত গল্পটি হচ্ছে- আরাকানের এক রাজকন্যা চট্টগ্রামের এক আদিবাসী রাজপুত্রের প্রেমে পড়েন। এক জ্যোৎস্না রাতে তারা দুইজন এই নদীতে নৌভ্রমণ উপভোগ করছিলেন। নদীর পানিতে চাঁদের প্রতিফলন দেখার সময় রাজকন্যার কানে গোঁজা একটি ফুল পানিতে পড়ে যায়। ফুলটি হারিয়ে কাতর রাজকন্যা সেটি উদ্ধারের জন্য পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু প্রবল স্রোতে রাজকন্যা ভেসে যান, তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। রাজপুত্র রাজকন্যাকে বাঁচাতে পানিতে ঝাঁপ দেন, কিন্তু সফল হননি। প্রিয়তমার শোকে রাজপুত্র পানিতে ডুবে আত্মহুতি দেন। করুণ এই কাহিনি থেকেই নদীটির নাম হয় কর্ণফুলী। মারমা জনগোষ্ঠীর কাছে এর নাম কিনসা খিয়ং। উজানে সীমান্তের ওপারে মিজোরামে কর্ণফুলীকে ডাকা হয় খাওৎলাং তুইপুই নামে।
বৈঠা থামিয়ে মাঝ নদীতে থেমে ভর দুপুরের মৌনতা কিছুক্ষণ উপভোগ করে তারপর কায়াকের মাথা নদীর ওপর পাশ অভিমুখে ঘুরালাম। সেখানে কয়েকজন জেলে পাথুরে পাহাড়ের দেয়াল ঘেঁষে নৌকা নিয়ে একদম স্থির বসে ছিল। চোখে শ্যেন দৃষ্টি; নিবদ্ধ নদীর পানির দিকে। যেন ¯্রােতের ভেতর কোনো বিশেষ নড়াচড়ার অপেক্ষায়। পাহাড়ের পাথুরে শিলা উপরিভাগে যতটা দৃশ্যমান হয়; তার চেয়েও নদীর তলদেশে লুকিয়ে থাকা অংশ খুব একটা কম নয়। জেলেদের সাথে
আলাপে জানলাম নদীর এই অংশে গভীরতা ৩৫-৪০ ফুটের মতো। একটা বিষয় খেয়াল করলাম, নদীর অপরাপর দিকে পানি বাতাসে মৃদু ঢেউ খেলানো থাকলেও এখানে একদম স্থির। উজান থেকে নেমে আসা স্রোত পাথুরে দেয়ালে বাধা পেয়ে ঘূর্ণিপাক খাচ্ছিল। লাইফজ্যাকেট পরা থাকলেও সঙ্গী সুমন সাঁতার জানেন না। তাই সেখান থেকে তড়িঘড়ি করে এইপাশে ঘাটের দিকে চলে আসি। কায়াক পর্ব শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর লাঞ্চের ডাক পড়ে। পরের গন্তব্য কাপ্তাই হ্রদ। পার্কের ফটক থেকে কাপ্তাই সদর অভিমুখে চলে যাওয়া পথের পুরোটাই ক্রমশ ওপরের দিকে ওঠে গেছে। এক পাশে সংরক্ষিত পাহাড়ি বনভূমি, অপর পাশে বেশ নিচে কর্ণফুলীর খরস্রোত। কাপ্তাই সদরে বাহন থেকে মাটিতে পা ফেলার আগেই চোখে পড়ল কাপ্তাই হ্রদের অবারিত জলরাশি। নৌকা ঘাট সামনেই। ডানের রাস্তাটি চলে গেছে জলবিদুৎ বাঁধের দিকে। বাহন থেকে নেমে প্রথমেই কানে আসল মধ্যবয়সী এক নারী কণ্ঠ- ‘মামা, লেকে ঘুরবেন, সাম্পান দিয়া? ঘাটে গিয়ে দরদাম শেষে আটজনের দলের জন্য একটা জুতসই লঞ্চ নেয়া হল। লঞ্চের চালকই গাইড। কাপ্তাই হ্রদের জলরাশিতে আলোড়ন তুলে ছুটে চলল জলযান। দূরে এক দুটা সাম্পান নৌকা ভাসতে দেখলাম। নায়ের দুপাশে একজোড়া বৈঠা। বৈঠা দুটো গলুইয়ের দুপাশ থেকে ওঠে গিয়ে তার হাতল একসাথে বাঁধা হয়েছে কোমর সমান উঁচুতে। মাঝিকে তাই দাঁড়িয়ে ঠেলতে হচ্ছিল বৈঠা যুগল। ছোট নৌকা, তাই দুজন করেই যাত্রী দেখলাম। লঞ্চ আস্তে আস্তে হ্রদের গভীরের দিকে যাচ্ছে। আর আমরা যেন ক্রমশ ঢুকে যাচ্ছি নীলাভ কোনো রাজ্যপাটে! হ্রদের নীলজল যেন সুনয়নার নীলচক্ষু! জলরাশির মাঝে সবুজ দ্বীপের মতো জেগে আছে এক একটা টিলা। টিলাগুলোর বেশির ভাগেই জনবসতি নেই। নীল আর সবুজ যেন মিলেমিলে দৃষ্টিতে মুগ্ধতার পরশ বুলিয়ে দিতে থাকল। ভাসতে ভাসতে অন্য নৌকায় যাত্রী হওয়া পাহাড়ের স্থানীয় নৃগোষ্ঠীর মানুষজনের সাথে চোখাচুখি হয়। দূরে, বহুদূরে আবছা অবয়বে কয়েক স্তরের পাহাড়শ্রেণি। মাঝি বললেন, পাহাড়ের ওই গহীনে মিজোরাম সীমান্ত। আরও কিছুক্ষণ হ্রদে ভাসার পর একটি টিলার পাশে লঞ্চ নোঙর করা হলো। একটা বয়সী পাকুড় গাছ দাঁড়িয়ে আছে পাকা সিঁড়ি বাঁধানো ঘাটে। টিলার ওপর একটা বাজার। নেমে পা বাড়াই সেদিকে। বাজারটির ক্রেতা বিক্রেতা সবাই চাকমা জনগোষ্ঠীর। ছোট ছোট দোকান। বয়সী কয়েকজন পৌঢ় এক জায়গায় জটলা বেধে গল্প জুড়ে দিয়েছে। কথা চলছিল তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায়। টিলার ওপর বাজারের শেষ মাথায় অল্পনা চাকমা দিদির ছোট্ট খাবার দোকান। কড়াইয়ের গরম তেলে পিঠা ভাজা হচ্ছিল। নারকেলের টুকরো আর গুড়ের সাথে ময়দার মিশ্রণে বানানো লালচে রঙের সেই পিঠার স্বাদ ছিল মুখে লেগের থাকার মতো! রাঙামাটির মগবান ইউনিয়নে পড়েছে এই বাজার। নাম নতুন বাজার। টিলার অন্য পাশে চাকমাদের পাড়াটার নাম দোখাইয়া পাড়া। দোকানগুলোর টিনের দেয়ালে সাটানো নির্বাচনী পোস্টার। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চলছিল তখন। হ্রদে নৌকায় করে মাইকে চলছিল প্রার্থীদের প্রচারণা। এরকম এক মাইক থেকে কানে আসে- ‘পাহাড়ি বাঙালি ভাই ভাই, আনারস মার্কায় ভোট চাই’। নৌকায় ফিরে আরও কিছুক্ষণ নৌযাত্রার পর আমরা প্রবেশ করলাম জীবনতলি ইউনিয়নে। বিকেল গড়াচ্ছে, রোদও মিঠেমিঠে হচ্ছে। মাঝি এবার নোঙর করল এক বৌদ্ধ বিহারের টিলার পাদদেশে। টিলার চূড়ায় সোনালী রংয়ের বৌদ্ধমূর্তি। বেশ দূর থেকেও স্পষ্ট চোখে পড়ে। টিলার সিঁড়ি বেয়ে আমরা ওপরে ওঠে এলাম। বিহারে পূণ্যার্থীরা এসেছে আরাধনায়। সোনালী রংয়ের জাদির গায়ে কাঁচ ঘেরা কোটরে বৌদ্ধ ধর্মের নানা দেবতার নাম সংরক্ষণ করে রাখা। পাশেই বিহারের প্রার্থনা কক্ষের ভেতর মৃদু আলোয় যেন অন্য রকম আবহ! ফুরফুরে বাতাস ওঠে আসছে হ্রদ থেকে। ধনপাতা বনবিহার থেকে নৌকায় ফিরে এলাম আমরা; মাঝিও আবার নোঙর তুলল। কাপ্তাই হ্রদ এবার সেজেছে অন্য রকম চেহারায়। সূর্য পাটে যাচ্ছে। গোধূলীর সোনা রংয়ে নৈসর্গিক মুগ্ধতায় সেজেছে পুরো হ্রদ। চারপাশ জুড়ে অপূর্ব এক নিরবতা। অনুভব করতে জানলে মৌনতারও প্রগাঢ় কোনো ভাষা থাকে! ফুরোমন পাহাড়ের রাজ্যপাটে পৌষের শীতলতা ভর করতে শুরু করেছে। সন্ধ্যার ছাই রঙ আস্তে আস্তে চারপাশের সোনালী জলরাশির ওপর আঁধারের চাদর ফেলে ঢেকে দিচ্ছে। কাপ্তাই নৌকা ঘাটে ফেরার আগেই গ্রাস করল ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঘাটে নেমে সেখানের এক টং দোকানে চা পর্ব সেরে ফিরে এলাম আস্তানায়। ক্যাম্পসাইটে তাবু বসানো হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। রাতের খাবারের ডাক পড়ল একটু আগেভাগেই। উদরপূর্তির পর তাবুতে ফিরে টের পেলাম হাড়কাঁপানো ঠান্ডা চেপে ধরছে। শীতে কাঁপতে কাঁপতে নদীর পাড়ে বসে কিছুক্ষণ চলল আড্ডা-গল্প। কিছু ফানুস আমরা সাথে করে নিয়েছিলাম। সেগুলো উড়াতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হলো। নদী থেকে আসা বাতাসের দাপটে দিয়াশলাইয়ের কাঠিতে আগুন জ্বালানো যাচ্ছিল না। কয়েক বারের চেষ্টার পর উড়ানো গেল শেষতক। রঙিন
কাপড়ের ভেতর আলোর প্রদীপ জ্বলতে জ্বলতে ওপরে ওঠে যেতে থাকে। ঘাড় পেছনে বাঁকিয়ে একটানা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় তারাদের ভিড়ে কোনটা ফানুস সেটা আর ঠাহর করতে পারলাম না। রাত বাড়ছে, ক্যাম্পিংয়ে আসা প্রায় সবাই ইতোমধ্যে ঢুকে পড়েছে যার যার তাবুতে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে গেছে নদীর অন্য পাশের ঘন বন। বন্যপ্রাণী বিষয়ক একজন লেখকের বয়ানে জেনেছিলাম, কাপ্তাইয়ের ওই পাহাড়ি বনভূমিতে বসবাস করে বিড়াল গোত্রের সুন্দরতম এক সদস্য- মেঘলা চিতা। স্থানীয়রা যাকে ডাকে লতাবাঘ বা গেছোবাঘ নামে। সারাদিন কোনো গাছের ডালে অলস শুয়ে থেকে নিশ্চয় তার সময় হয়েছে শিকার সন্ধানে বের হওয়ার! নদী পাড়ের পাথরের চাতালে থাবার শক্ত নখে ভারসাম্য রক্ষা করে সামনে ঝুকে তৃষ্ণা মেটাতে মেটাতে দেখছে কি অন্যপাড়ের মনুষ্য ক্রিয়াকলাপ? তাবুতে ঢুকে পড়ার পর শীত যেন আরও জেঁকে ধরল। নদী থেকে ধেয়ে আসা বাতাসের সাথে হাড়কাঁপানো শীত; দাঁতে দাঁতে বাড়ি লাগছিল যেন। বেড হিসেবে প্রতিটি তাবুর মেঝেতে দেয়া হয়েছে দুই ফালি ককশিট। নিচ থেকে ওঠা ঠান্ডা আটকানোর জন্য তা যথেষ্ট না হওয়ায় রাফাত তাবু থেকে বের হয়ে কোত্থেকে জানি আরও দুই ফালি ককশিট নিয়ে এলো। এবার বেডটা মোটামুটি আরামদায়ক হয়ে উঠল। ঝিম ধরে থাকা শীতের রাতে নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে কানে আসছিল ফোটা ফোটা কুয়াশা দলা বেঁধে তাবুর গায়ে আছড়ে পড়ার শব্দ। দূর থেকে থেমে থেমে কানে আসছিল এক পাল শেয়ালের হুক্কাহুয়া। ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে রাত কাটানোর পর ঘুম ভাঙল বেশ ভোরে। তাবুর চেইন খোলে বাইরে বেরিয়ে দেখি ইতোমধ্যে দলের অনেকেই ওঠে পড়েছে। ভোরের কর্ণফুলী সবেমাত্র আড়মোড়া ভাঙছে। কুয়াশার দঙ্গল সারারাত নদীর ওপর ঘাপটি মেরে বসে থাকার পর আলো ফোটার সাথে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে। নদীর শান্ত স্রোত ছুঁয়ে ছুঁয়ে কুয়াশার অস্থির ছুটে চলার সাথে যোগ দেয় একটা দুটা পানকৌড়ি। নদীর ওপর পাশের বনের চেহারাও হয়ে গেছে কুয়াশাময়। জেলেরা তাদের নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে সেই ভোরেই।
কোনোটা ছৈ-ওয়ালা, আবার কোনোটা খোলা ছোট নৌকা। হাড়কাঁপানো এমন শীতও যেন তাদের থোড়াই কেয়ার! আগের দিন কায়াকিংয়ের সময় জেলেদের কাছে জেনেছিলাম, নদীর ওপর পাশের পাথুরে পাহাড়ের খাড়ির অংশ বেশি গভীর। ক্যাটফিশ গোত্রীয় মাছের আবাসস্থল সেই পাথুরে তলদেশে। আর পুরো নদীতেই চলাফেরা করে কার্প জাতীয় মাছ। এসব নিয়ে যখন ভাবছিলাম, হঠাৎই একটা বড়সড় মাছের ঘাই নদীর মাঝ বরাবর আলোড়ন তুলল! শান্ত পানিতে তৈরি হওয়া ঢেউয়ের গোলাকার বলয় চারপাশে প্রসারিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল মিলিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। ক্যাম্পসাইট থেকে ফিরে নাস্তার জন্য রেস্তোরাঁয় ডাক পড়ল। ডিম ভুনার সাথে গরম গরম খিচুড়িতে পেটপুরে নাস্তা সেরে ঝটপট গোছগাছ সেরে বেরিয়ে পড়তে হলো। আমাদের পরের গন্তব্য রাঙামাটি শহর। কাপ্তাই হ্রদের পাশজুড়ে শৈল্পিক রেখা টেনে চলে গেছে যে পাহাড়শ্রেণি, তার ওপর দিয়ে চলে যাওয়া চড়াই উতরাই পথ ধরে আমরা যাব। বাহনে চেপে বসার আগে ঘাড় ফিরিয়ে আরেকবার কর্ণফুলীর দিকে চোখ রেখে অস্ফুটে বললাম, ভালো থেকো কাপ্তাই; আবার দেখা হবে নিশ্চয়!