লেখকঃ মো. জিয়াউল হক হাওলাদার
বাংলাদেশের আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানসমূহের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক পর্যটন আকর্ষণ বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে বিশেষ করে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগে বিদ্যমান। রংপুর বিভাগ বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুরের আটটি জেলা নিয়ে গঠিত। এই আটটি জেলায় দুই শতাধিক পর্যটন আকর্ষণ রয়েছে। পুরাকীর্তির অনেক নিদর্শন এখানকার অতীত সভ্যতার সাক্ষ্য বহন করে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়- এই অঞ্চলের জনপদ অতীত থেকেই সমৃদ্ধ এবং এখানে অনেক রাজা, মহারাজা ও জমিদারদের বসবাস ছিল। এই অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় অনেক স্থাপনা রয়েছে, যার অনেকগুলোই আমাদের অজানা। অন্যদিকে রাজশাহী বিভাগে রাজশাহীসহ মোট আটটি জেলায় মোট ২০৫টি প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় স্থান রয়েছে।
যমুনা, তিস্তাসহ অন্যান্য নদী এবং এর শাখাপ্রশাখা বিধৌত পুরো রংপুর অঞ্চল এক সময় অনেক নদীবন্দর সমৃদ্ধ ছিল, যেখান থেকে পণ্যবাহী নৌকা দূরদূরান্তে চলাচল করত। কালের আবর্তে যার অধিকাংশই হারিয়ে গেছে বা গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। দিনাজপুর জেলার মাইলের পর মাইল বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত এলাকার ধান চাষের প্রাচুর্যকে ইঙ্গিত করে। দিনাজপুর এখনো চাল উৎপাদনে উদ্বৃত্ত এলাকা। এখানকার উৎপাদিত চাল স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে দেশের অন্যান্য অংশের প্রয়োজন মেটায়। দিনাজপুর জমিদারি বাংলার প্রাচীন জমিদারসমূহের অন্যতম। জনপ্রবাদ অনুসারে, জনৈক দিনরাজ বা দিনরাজা এই জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তার নামানুসারে এই জেলার নামকরণ হয় দিনাজপুর।
তবে অন্য মতে, পঞ্চদশ শতকে বিখ্যাত রাজা গণেশ এই জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা। সপ্তদশ শতাব্দীতে শ্রীমন্ত দত্ত চৌধুরী এই জমিদার বংশের খ্যাতিমান জমিদার ছিলেন। এরপর মহারাজা প্রাণনাথ (সুখদেবের পুত্র) ও তার দত্তকপুত্র রামনাথ জমিদারি পরিচালনায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন এবং তারাই ছিলেন বিখ্যাত কান্তজির নবরতœ মন্দিরের নির্মাতা। রাজা গিরিজানাথ (তারকানাথের দত্তক পুত্র) ছিলেন এই জমিদার বংশের একজন সুশিক্ষিত ও স্বনামধন্য জমিদার। ১৯১৯ সালে রাজা গিরিজানাথ মৃত্যুবরণ করার পর তার দত্তক পুত্র জগদীশনাথ ছিলেন এই বংশের সর্বশেষ জমিদার। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে দিনাজপুর রাজপ্রাসাদ ও কান্তজির মন্দির মারাত্মকভাবে ক্ষতিগস্ত হলে রাজা গিরিজানাথ পুনঃনির্মাণ করেন।
রংপুর বিভাগের উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্থানসমুহের মধ্যে রয়েছে- বৃহত্তর রংপুরের তাজহাট জমিদার বাড়ি, কেরামতিয়া মসজিদ ও মাজার, লালদীঘি নয় গম্বুজ মসজিদ, ৬৯ হিজরির প্রাচীন মসজিদ, চিনি মসজিদ, রকস মিউজিয়াম এবং বৃহত্তর দিনাজপুরের কান্তজির মন্দির, রামসাগর, সীতাকোট বিহার, সুরা মসজিদসহ আরও অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান। এই বিভাগের শতরঞ্জি এখন পর্যন্ত বিশ্ববিখ্যাত।
রংপুর শহরের উপকণ্ঠে সেনানিবাসের পশ্চিমে ঘাঘট নদীর তীরে নিসবেতগঞ্জ নামক স্থানে অবস্থিত রংপুরের বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী শতরঞ্জি শিল্পকারখানা। বর্তমান বিশ্বে বুনন শিল্পের মধ্যে ‘শতরঞ্জি বুনন’ সবচেয়ে প্রাচীনতম। এই পণ্য উৎপাদনে কোনো প্রকার যান্ত্রিক ব্যবহার নেই। কেবলমাত্র বাঁশ ও রশি দিয়ে মাটির ওপর সুতা দিয়ে টানা প্রস্তুত করে প্রতিটি সুতা হাত দিয়ে নকশা করে শতরঞ্জি তৈরি করা হয়। কোনো জোড়া ছাড়া যে কোনো মাপের শতরঞ্জি তৈরি করা যায়। এর সৌন্দর্য ও টেকসই উল্লেখ করার মতো।
ইতিহাস থেকে যতদূর জানা যায়, ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে এই এলাকায় শতরঞ্জির প্রচলন ছিল। জানা যায়, মোগল সম্রাট আকবরের দরবারে শতরঞ্জি ব্যবহার করা হতো। এক সময় ভারত, সিংহল, বার্মা, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে এখান থেকে প্রচুর শতরঞ্জি রপ্তানি হতো। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন এখানে শতরঞ্জি বুননের জন্য শতরঞ্জি প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করে। শতরঞ্জি বুনন দেখার জন্য সারাবছর অনেক দেশি-বিদেশি দর্শনার্থী এখানে আসেন। রংপুরের কারুশিল্পের মধ্যে শতরঞ্জি ছাড়াও পাটশিল্প, রেশম, তাঁত, মৃতশিল্প, নকশিকাঁথা, বাঁশ শিল্প, কাঠ শিল্প, কাঁসা, পিতল, লোহা শিল্প ও ঢেঁকি শিল্প ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
ভাওয়াইয়া রংপুরের লোকসংগীত ধারার সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ শাখা। লোকসাহিত্য ও লোক সংস্কৃতিতে রংপুরের অবদান অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আর এসব কর্মকা- সম্পাদিত হয়েছে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায়। আঞ্চলিকতার দিক দিয়ে ভাওয়াইয়া হচ্ছে ভাটিয়ালির বিপরীত ধারার লোকসংগীত।
ভাওয়াইয়া সম্রাট আববাসউদ্দীন ১৯৫৪ সালে ভাওয়াইয়াকে বিশ্বদরবারে উপস্থাপিত করেন। ভাওয়াইয়া লোকসংগীতের ধারায় এই অঞ্চলের গ্রামীণ জনপদের বিভিন্ন পেশার মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম-ভালোবাসা, বিরহ-বেদনাকে কেন্দ্র করে লোকের মুখে মুখে রচিত এবং আবেদনময় সুরে বাঁশি ও দোতরা বাদ্যযন্ত্রযোগে গীত হয়ে আসছে। ‘ভাব’, ‘ভাওয়া’, ‘বাওয়া’, ‘বাউদিয়া’ প্রভৃতি শব্দ থেকে ভাওয়াইয়া শব্দের উৎপত্তি বলে গবেষকরা মতামত ব্যক্ত করেছেন।
জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া গানগুলোর মধ্যে-ওকি গাড়িয়াল ভাই, ওকি ও কাজল ভোমরা, তোরসা নদীর ধারে, নাইওর ছাড়িয়া যেও মোর বন্ধু, নদী না যাই ওরে বৈদ, ফাঁন্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে উল্লেখযোগ্য। রংপুরের বিভাগের লোকসংস্কৃতি ও সংগীতের ধারায় মেয়েলি গীত বা বিয়ের গীত একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান। রংপুরের মেয়েলি গীত মেয়েলি আচার-অনুষ্ঠানের অনেক বিষয় নিয়ে রচিত। যেমন- বিয়ে, সাধভক্ষণ, অন্নপ্রাসন, নবজাতকের ক্ষৌর কাজসহ বিয়ের বিভিন্ন পর্বকে ঘিরে এই গীতগুলো রচিত এবং নৃত্যযোগে আনন্দমুখরতার মধ্য দিয়ে গীত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। রংপুরের লোকসংগীতের ধারায় আরও আছে হুদমার গান, জগের গান, যোগীর গান, গোয়ালীর গান, ক্ষ্যাপা গান, জারি গান, মালশা গান, পালাগান বা কাহিনি গান। এই ধারায় রয়েছে অসংখ্য পালাগান। যেমন- নসিমন সুন্দরীর পালা, গুনাইবিবি, অমমূলা কন্যা, নেকোবিবি, কলিরাজা, চিনুবিনু ইত্যাদি। রংপুরের লোকসংগীতের ধারায় আছে- রংপুরের ভাষায় ছড়া, প্রবাদ-প্রবচন, ধাঁধা (ছিলকা)।
বাংলাদেশের যে কয়টি জেলায় জাতিতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায় দিনাজপুর তার মধ্যে অন্যতম। এই জেলায় সাঁওতাল, উড়াও, মাহালী, মুন্ডালী, কোলকামার, মুশহর, তুড়ি, রাজবংশী, কড়া, ভুইয়া, মুচি, মালো, মাহাতো, রবিদাস, পাহাড়ি, কামার, কর্মকারসহ ১৮টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ১৩ লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করে।
দিনাজপুর জেলা লিচুর জন্য বিখ্যাত। এই জেলায় বাংলাদেশের সেরা লিচু উৎপন্ন হয়। বিভিন্ন জাতের লিচুর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মাদ্রাজি, বোম্বাই, বেদানা, মোজাফফরি ও চায়না-৩। বেদানা লিচুর বিচি ছোট এবং মাংসল ও সুমিষ্ট হয়। বেদানা লিচু ও মোজাফফরি লিচুর দাম সবচেয়ে বেশি। স্থানীয়ভাবে এগুলো প্রতিশ’ ৬০০-৭০০ টাকা দামে বিক্রি হয়। এই জেলায় লিচু চাষে ব্যবহৃত ৩৭০৫ একর জমির অধিকাংশই বিরল ও দিনাজপুর সদর উপজেলায়। দেশে-বিদেশে এখানকার লিচু বিশেষভাবে সমাদৃত। রাজশাহী-রংপুর অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী আমসমূহের পাশাপাশি বাংলাদেশের মাটিতে বিপুল সম্ভাবনাময় আরেকটি আমের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে এবং ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশে সুখ্যাতি অর্জন করেছে যার নাম ‘হাঁড়িভাঙা’। আঁশবিহীন সুমিষ্ট এই আমের কদর ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানেও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। পর্যটকগণ আমের মৌসুমে এখানে এলে এই আমের স্বাদ পরখ করে দেখতে পারেন।
রংপুর জেলা তামাক চাষের জন্য বহু আগে থেকেই বিখ্যাত। বিশেষত দেশ স্বাধীনের পর সত্তর দশকের শুরু থেকে এ এলাকায় তামাক চাষ বিস্তৃতি লাভ করে। অনুকূল মাটি ও জলবায়ু এবং উৎপাদন লাভজনক হওয়ার কারণে রংপুর অঞ্চলে তামাক চাষ ব্যাপকতা পায়। এখনো রংপুর সদর, হারাগাছ, তারাগঞ্জ ও গঙ্গাচড়া উপজেলায় ব্যাপক হারে তামাক আবাদ হয়। রংপুর জেলার প্রায় আড়াই হাজার একর জমিতে তামাকের চাষ হয়ে থাকে। তবে স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে ইদানিং চাষিদের মাঝে তামাক চাষের প্রবণতা কমতে শুরু করেছে।
রাজশাহী বিভাগ সুদূর অতীত থেকেই সমৃদ্ধ এবং তুলনামূলকভাবে প্রাচীন। বগুড়ার মহাস্থানগড় আনুমানিক ৪০০ খ্রিষ্টপূর্ব সময়ের সমৃদ্ধ জনপদ পুন্ড্রবর্ধন নগরীর প্রচুর নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। অষ্টম শতাব্দিতে নির্মিত নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার এবং অনান্য বৌদ্ধমন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাল রাজবংশের কয়েক শতাব্দির সগৌরব শাসনকালের পরিচয় বহন করে। তাছাড়া সমগ্র রাজশাহী অঞ্চলে অসংখ্য প্রাচীন মাজার ও মসজিদের বিস্তার থেকে এটি পমাণিত যে, বিশেষত পাল শাসনামল এবং তৎপরবর্তী সুলতানি আমলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে অনেক আউলিয়া, দরবেশ ও সুফি সাধক ইসলামের শান্তির বাণী প্রচারের জন্য এই ভূখন্ডে এসেছিলেন। ব্রিটিশ শাসনামল এবং তৎপূর্ববর্তী সময়ের রাজবাড়ি ও প্রাসাদের ব্যাপক উপস্থিতি হিন্দু, মুসলিম রাজা, মহারাজা, নবাব ও জমিদারদের অতীত আধিপত্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
এছাড়া সারা রাজশাহী বিভাগে অসংখ্য হিন্দু মন্দির ও মঠের উপস্থিতি থেকে রাজা ও জমিদারদের প্রভাব-প্রতিপত্তির পরিচয় পাওয়া যায়। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দিতে আগত ইউরোপীয় খ্রিষ্টান মিশনারিদের আগমনের পর এই অঞ্চলের বিভিন্ন অংশে নির্মিত গির্জার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এ সকল অতীত সমৃদ্ধি ও সভ্যতার অরেক নির্দশনই কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে।
রাজশাহী বিভাগের উল্ল্যেখযোগ্য পর্যটন স্থানসমূহের মধ্যে রয়েছে- ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যস্থান নওগাঁর বৌদ্ধবিহার ছাড়াও কুসুম্বা মসজিদ, বগুড়ার মহাস্থানগড় ও মাহিসওয়ারের মাজার, রাজশাহীর পুঠিয়া রাজবাড়ি, বাঘা মসজিদ ও বরেন্দ্র জাগিুঘর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনা মসজিদ, নাটোরের উত্তরা গণভবন, পাবনার তাড়াশ জমিদারবাড়ি ও ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের আশ্রম এবং সিরাজগঞ্জের হযরত মখদুম শাহদৌলার মাজার ও রবীন্দ্র কাচারিবাড়ি এবং গম্ভীরা গান ইত্যাদি।
গম্ভীরা রাজশাহী এলাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় লোকসংগীত। গম্ভীরা মানে সমসাময়িক বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরে তার সমাধান বলে দেওয়া। ‘নানা-নাতির’ ভূমিকা নিয়ে দুজন ব্যক্তি সংলাপ ও গানের মধ্য দিয়ে গম্ভীরা গান পরিবেশন করে। আঞ্চলিক ভাষায় রচিত সংলাপ ও সমসাময়িক কোনো বিষয়ে গম্ভীরা গানের মূল উপজীব্য। নানা-নাতির নাচ, গান, কৌতুক, অভিনয়, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মাধ্যমে পরিবেশনের কারণে গম্ভীরা গান খুবই উপভোগ্য হয়ে উঠে।
রাজশাহী বিভাগ বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ নানাজাতের রসালো আমের জন্য বিখ্যাত। চাঁপাইনবাবগঞ্জকে আমের রাজধানী বলা হয়। বাংলাদেশে যতগুলো ফল উৎপন্ন হয় স্বাদ, গন্ধ ও উৎপাদনের দিক থেকে আমের অবস্থান শীর্ষে। এজন্য একে ফলের রাজা বলা হয়। বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৮ লাখ টন আম উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাতে ২ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদিত হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাতে বিভিন্ন জাতের আম পাওয়া যায়। এদের মধ্যে সবচেয়ে আগে ওঠে গোপালভোগ। তারপর আসে হিমসাগর বা ক্ষিরসাপাত। এরপর ল্যাংড়া এবং একের পর উঠতে থাকে ক্ষিরভোগ, মোহনভোগ, রাজভোগ, রানিভোগ, রানিপছন্দ, সিন্দুরা, সুবর্ণরেখা, নাক ফজলি, ফজলি, চিনি ফজলি, সুরমাই ফজলি, চিনি মিসরি, জগৎমোহিনী, রাখালভোগ, গোবিন্দভোগ, তোতাপুরী, আ¤্রপালি, চম্পা, সূর্যপুরি, লক্ষ্মণভোগ, কিষাণভোগ, আশ্বিনা, ভাদুরিগুঁটি, ক্ষিরমণ, দুধসর, মল্লিকা, রাজলক্ষ্মী, দুধকুমারি, বিন্ধাবনি ইত্যাদি নানা আকৃতি ও নানান স্বাদের আম।
রাজশাহীর তিলের খাজা সুবিখ্যাত এর মোলায়েম ও মচমচে স্বাদের জন্য। রাজশাহী ছাড়া, কুষ্টিয়ার তিলের খাজারও বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। রাজশাহী জেলার চারঘাট থানার হলদিগাছীতে উন্নতমানের তিলের খাজা প্রস্তুত হয়। চিনি বা গুড় এবং তিল সহযোগে তৈরি হয় মচমচে স্বাদের তিলের খাজা। প্রথমে তিল নিয়ে কড়াইতে তেল ছাড়া হালকা আঁচে বাদামি করে ভাজতে হয়। এরপর চিনি বা গুড় সামান্য পানির সাথে মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে পেস্ট বা ক্যারামেল তৈরি করে তাতে ঢেলে দিয়ে মৃদু আঁচে নাড়তে হয়। এরপর মিশ্রণটি একটি সমতল স্থানে পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে তার ওপর বেলন দিয়ে চ্যাপ্টা করে কিছুটা ঠান্ডা হয়ে এলে ছুরি দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করা হয়। এভাবে পুরো ঠান্ডা হয়ে গেলে তৈরি হয় মচমচে সুস্বাদু তিলের খাজা।
রাজশাহীর পান বাংলাদেশের নামকরা পান। বিয়েশাদি, পূজা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানে অতিথি আপ্যায়ন ও রসনা তৃপ্তিতে রাজশাহীর পানের বেশ কদর রয়েছে। ঝাঁঝহীন ও রসালো রাজশাহীর পান সবার কাছে পছন্দনীয়। রাজশাহীতে জেলাতে ২৫ হাজারের অধিক পানের বরজ রয়েছে। নিঃশ্বাসকে সুরভিত করা এবং ঠোঁট ও জিহবাকে লাল করা ছাড়াও মনে প্রফুল্ল আনার জন্য রাজশাহীর পান প্রসিদ্ধ। রাজশাহীতে এক পোয়া অর্থাৎ ৩২ বিড়া (৬৪টি পানে এক বিড়া) বড় পানের দাম প্রায় চার হাজার টাকা। রাজশাহীতে বার্ষিক উৎপাদিত পানের দাম বর্তমান বাজার মূল্যে ১০০ কোটি টাকার ওপরে।
বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাদুঘর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর রাজশাহী শহরে অবস্থিত। বাংলার তৎকালীন গভর্ণর লর্ড কারমাইকেল ১৯১৩ সালে স্থানীয় জাদুঘরগুলোর সংগঠকদের প্রতœতত্ত্ব সম্পদ সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং প্রদর্শনের জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করেন এবং ১৯১৬ সালে তিনি এই জাদুঘর ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৪৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এই জাদুঘর পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে- বহু মূল্যবান পাথর ও ধাতু নির্মিত ভাস্কর্য, খোদিত লিপি, মুদ্রা, মৃৎপাত্র পোড়ামাটির ফলক, অস্ত্রশস্ত্র, আরবি ও ফারসি দলিলপত্র, চিত্র, বইপত্র ও সাময়িকী এবং সংস্কৃতি।
রাজশাহী রেশম শিল্পের জন্য বিখ্যাত। এই রেশম বাজারই প্রথম ইউরোপীয় বণিকদের বাংলায় আসতে আকৃষ্ট করে। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রেশম কারখানা রাজশাহী শহরের বালিয়াপুকুর নামক স্থানে অবস্থিত। ইতিহাস অনুসন্ধানে দেখা যায়, সপ্তদশ শতাব্দীতে প্রথম চীন দেশে রেশম চাষ শুরু হয়। এক সময় এই দেশে উৎপাদিত রেশম স্থানীয় চাহিদা পূরণ করার পরও প্রচুর পরিমাণে বিদেশে রপ্তানি করা হতো। রেশম শাড়ি বাঙালি রমণীর ঐতিহ্যগত সৌন্দর্য এবং সাংস্কৃতিক স্বতন্ত্রের প্রতীক। রেশম কাপড়ের বিভিন্ন ডিজাইন ও ধরন- গরদ, মটকা, বেনারসি প্রভৃতি নামে পরিচিত।
বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য মিলে চার শতাধিক পর্যটন আকর্ষণ রয়েছে। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য অবলোকনের জন্য বেড়াতে আসেন। তবে এই সব আকর্ষণ দেশে-বিদেশে আমাদের আরও বেশি প্রচার করতে পারলে প্রতিবছর লাখ লাখ বিদেশি পর্যটক বেড়াতে আসবেন।