লেখকঃ এলিজা বিনতে এলাহী –পর্যটক ও শিক্ষক
গল্প শুরু করার আগে একটি বিষয় বলা দরকার। অনেকের কাছে হিমালয় ও এভারেস্ট প্রায় সমার্থক। অর্থ হচ্ছে- হিমালয়ের বিস্তৃতি পশ্চিম পাকিস্তানের নাঙ্গা পর্বত থেকে শুরু করে ভারত, নেপাল, ভুটান হয়ে পুবে চায়নার নামচা বারওয়া অবধি।
হিমালয়ে রয়েছে হাজার হাজার শৃঙ্গ। এর মাঝে পৃথিবীর সবথেকে উঁচু শৃঙ্গের নাম এভারেস্ট। এই সুবিশাল পর্বতমালার প্রায় প্রতিটিতে যেমন আরোহণ করার সুযোগ রয়েছে, তেমনি রয়েছে হেঁটে বেড়ানোর সুযোগ। পাহাড় প্রেমীদের ভাষায় বলতে গেলে হিমালয়ের নানা পথে আছে ট্রেকিং ও হাইকিং। আরোহণ করতে অবশ্যই বিশেষ ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন। ট্রেকিং করার জন্য বিশেষ কোনো ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন নেই, তবে শারীরিক সক্ষমতার সাথে সাথে মানসিক শক্তি খুব জরুরি।
ঐতিহ্য অনুরাগী পর্যটক আমি, তাই হিমালয়ের পথে পথেও খুঁজেছি পুরাকীর্তি ও ঐতিহ্য। যদিও এভারেস্ট ও এর আশপাশের পর্বতমালা অবশ্যই প্রাকৃতিক ঐতিহ্য কিংবা প্রাকৃতিক পুরাকীর্তির অংশ। অল্প যা কিছু ঐতিহ্য দেখেছি যা আমার দৃষ্টিতে হেরিটেজ এবং অবশ্যই তা মানবসৃষ্ট। এভারেস্ট বেস ক্যাম্প অবধি যাওয়া ও ফিরে আসা মিলে ১৪ দিন হেঁটে বেড়ানোর পথে কী কী ঐতিহ্য মনকে চমকিত করেছে, সেইসব নিয়েই আজকের এই ভ্রমণ রচনা।
তেনজিং-হিলারি বিমানবন্দর
এভারেস্ট বেস ক্যাম্প ট্রেকে কি শুধুই প্রকৃতির বিস্ময় রয়েছে! মানুষের তৈরি কিছুই নেই! একথা বলতে বোঝাচ্ছি- সেখানে কি হেরিটেজ নেই! নিশ্চয়ই রয়েছে। ট্রেক শুরুই হয় এক ঐতিহাসিক বিমানবন্দর থেকে। বিশ্বে এক দুর্লভ নজির সৃষ্টি হয়েছে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিমানবন্দর তৈরির।
কাঠমান্ডু থেকে বেস ক্যাম্প অবধি ভ্রমণের ছোট ছোট নানা অনুষঙ্গ সবই আমার জন্য ছিল বিস্ময়। ১৪ জনের ছোট একটি এয়ারক্রাফটে করে পর্বতের মাঝ দিয়ে লুকলার তেনজিং-হিলারি বিমানবন্দরে অবতরণও একটি বিস্ময়। ছোট এয়ারক্রাফট, ছোট রানওয়ে, পৃথিবীর অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ এয়ারপোর্ট। এই প্রথম কোনো বিমানের ককপিট দেখেছি। ছোট্ট একটি প্লাস্টিকের পর্দা ঝুলছিল বিমানের ক্যাপ্টেনদের বসার জায়গা আর যাত্রীদের মাঝে। প্লাস্টিকের হওয়ার কারণে ককপিট অনায়াসেই দেখা যাচ্ছিল। সামনে না জানি আরও কত বিস্ময় অপেক্ষা করছে। আমি আসলে মনে মনে অপেক্ষা করে ছিলাম কখন এয়ারপোর্টটা দেখবো!
লুকলা এয়ারপোর্ট সম্পর্কে একটু বলি- বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিপদজনক বিমানবন্দরের মধ্যে আছে নেপালের লুকলা বিমানবন্দর। বর্তমানে এই বিমানবন্দরের নাম তেনজিং-হিলারি এয়ারপোর্ট। ২০১০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হিস্ট্রি টিভি চ্যানেলে এই বিমানবন্দরকে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দর হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ১৯৬৪ সালে নিউজিল্যান্ডের পর্বতারোহী স্যার এডমন্ড হিলারির তত্ত্বাবধানে এই বিমানবন্দর নির্মিত হয়েছিল। নির্মাণকাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৮ সালে স্যার এডমন্ড হিলারি এবং শেরপা তেনজিং নোরগের নামানুসারে এই বিমানবন্দরের নতুন নাম রাখা হয় তেনজিং-হিলারি বিমানবন্দর। আকাশপথে কাঠমান্ডু থেকে মাত্র ৪০ মিনিটের দূরত্ব এই বিমানবন্দরের। বিপদজনক হলেও বিমানবন্দরটি বেশ জনপ্রিয়। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে লুকলা থেকে অধিকাংশ পর্বতারোহী মাউন্ট এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে যায়। ২০১১ সালের আগে এই বিমানবন্দরের রানওয়ে মাটির তৈরি ছিল।
লুকলা বিমানবন্দরের নাম তেনজিং-হিলারি হওয়ার কারণ নিশ্চয়ই সবার জানা। ১৯৫৩ সালে এই দুইজন ব্যক্তি ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন এভারেস্ট জয় করে। লুকলা বিমানবন্দরে অবতরণ এবং আরোহণের জন্য বরাদ্দকৃত যে স্থানটি রয়েছে তা আকারে অনেক ছোট। পিচের আস্তরের রানওয়ের এই বিমানবন্দরে শুধুমাত্র হেলিকপ্টার এবং অন্যান্য ছোট বিমান অবতরণ করতে পারে। এর রানওয়ে ১,৭২৯ ফুট। লুকলা বিমানবন্দরের উচ্চতা ৯,৩৩৪ ফুট। স্বল্প রানওয়ে এবং ভূখ-ের কারণে এখানে বড় বিমান অবতরণ সম্ভব নয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২,৪৩৮ মিটার ওপরে অবস্থিত এই বিমানবন্দরে নেই কোনো উন্নত ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেম।
মানে ও কানে
‘Eliza you are passing through a Kane’ কৃষ্ণা বললো। ওহ! বলা হয়নি, এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে আমার গাইডের নাম কৃষ্ণা। আর পোর্টারের নাম খুদ। পোর্টাররা ট্রেকারদের ব্যাগ বহন করে এক গন্তব্য থেকে অন্য গন্তব্যে নিয়ে যায়। অনেক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ট্রেকার নিজেই নিজের প্রায় ১০/১২ কেজি ওজনের ব্যাগ বহন করে থাকে। ফিরে আসি কানের গল্পে। ‘এটির অর্থ কি কৃষ্ণা?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম। কৃষ্ণার উত্তর- ‘তুমি একটি নতুন গ্রামে প্রবেশ করছ পেছনে সব কুদৃষ্টিকে ফেলে’। একটি জনপদ থেকে অন্য একটি জনপদে প্রবেশ করার গেটকে বলা হয় কানে।
প্রতিটি গেটে ধর্মীয় কিছু বাক্য লেখা থাকে। প্রেয়ার হুইলও দেখতে পেলাম। সবাই গেট পার হওয়ার সময় প্রার্থনা করে কানে গেট দিয়ে পার হয়। সব মন্দশক্তিকে অতিক্রম করে নিজ গন্তব্যে নিরাপদে পৌঁছার জন্য এই গেটগুলো বানানো হয়েছে। নেপালের খুম্বু প্রদেশের বাসিন্দারা বহুকাল ধরেই এই সংস্কৃতি ধারণ করে আসছে।
‘মানে’ অর্থ স্টোন। লুকলা থেকে কিছু দূর ট্রেক করার পর পথের বিভিন্ন জায়গায় দেখতে পেলাম কিছু পাথরে খোদাই করে লেখা রয়েছে। শুধু যে পাথরে রয়েছে এমনট নয়, ছোট ছোট পাথরের প্লেট বানিয়ে সেগুলো সুন্দর করে পথের মাঝে কিংবা এক কোণে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ট্রেকে চলতে চলতে কৃষ্ণাই আমার জন্য গুগল আংকেলের কাজ করছিল। ভীষণ অভিভূত আর আপ্লুত হয়েছি মানে-স্টোনগুলো দেখে। পাথরগুলোতে মূলত ধর্মীয় অনুশাসন, মন্ত্র, কথা, উপকথা লেখা রয়েছে। সবগুলোই তিব্বতীয় ভাষায়। বহু যুগ যুগ ধরে এগুলো সংরক্ষিত আছে গোটা খুম্বু ভ্যালিজুড়ে।
টুকলা পাস সমাধি ভূমি
পর্বতেও সমাধি ভূমি! আমিও অবাক হয়েছি। যারা আমার ভ্রমণ বিষয়ে জানেন বা ভ্রমণের সাথে সংশ্লিষ্ট কাজগুলো দেখেছেন, তারা প্রত্যেকেই জানেন পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের সমাধি ভূমির প্রতি আমার দারুণ দুর্বলতা আছে। সমাধি ভূমিকে আমার ইতিহাসের আড়ত মনে হয়।
টুকলা পাসের এই জায়গাটিকে ঠিক সমাধি ভূমি বলা যাবে না। এটি আসলে একটি স্মৃতিকেন্দ্র। এভারেস্ট ও অন্যান্য পর্বত আরোহণ করতে গিয়ে যারা আর ফিরে আসেননি তাদের উদ্দেশেই এই স্মৃতিকেন্দ্র বা স্মৃতিফলকগুলো রাখা হয়েছে। কারণ যারা হিমালয়ে দেহত্যাগ করেছেন তাদের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। শেরপারা নিহতদের সম্মানার্থে একটি টুম্বের মতো বানিয়েছেন পাথর জড়ো করে। তারপর সেখানে ছোট একটি এপিটাফে নাম, বয়স, মৃত্যুকাল ও দেশ লিখে রাখা হয়েছে। পর্বতারোহীদের মেমোরিয়ালের স্থানে বাংলাদেশি সজল খালেদেরও স্মৃতিফলক রয়েছে। সেটি দেখে খুব গর্ববোধ হচ্ছিল। সজল খালেদ এভারেস্টেও চূড়া ছুঁয়েছিলেন, কিন্তু নেমে আসার সময় তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। আরও একটি মেমোরিয়াল দেখেছি ট্যাংবোচে গ্রামে, আমার লজের পাশেই ছিল ৫/৬টি মেমোরিয়াল।
প্রস্তর স্তূপ বা পাথরের পিরামিড
ধীরে ধীরে হেঁটে উচ্চতায় উঠছি, সবুজ কমে যাচ্ছে, পাথরের আকার বড় হচ্ছে। যেদিকে তাকাই শুধু পাথর আর পাথর। মাঝে মাঝে দেখছি ছোট বড় পাথর সাজিয়ে উঁচু স্তম্ভের মতো বানানো রয়েছে। কোনো কোনো ট্রেকার আবার জিরানোর সময় বসে পাথরের স্তম্ভ তৈরি করছেন, কেউ কেউ বানানো স্তম্ভের ওপর আরও কিছু পাথর জোড়া দিচ্ছেন। কৃষ্ণা বলছিল- এগুলো রুট ফাইন্ডার। যখন ছিল না গুগল, ছিল না স্মার্ট ওয়াচ, জিপিএস তখন কি ট্রেকাররা ট্রেক করেননি কিংবা পাহাড় প্রেমীরা পর্বতে আরোহণ করেননি? অবশ্যই করেছেন। হেঁটেছেন অজানার পথে, হারিয়েছেন পথ। হারিয়ে খুঁজে পাওয়ার দোলাচলে অন্য পথিকের পথ সুগম করার এই পাথরের স্তম্ভগুলো তৈরি করতেন। পরের ট্রেকাররা এসে বুঝতে পারতেন এখানে আগেও ট্রাভেলাররা এসেছেন। এই রুট ফাইন্ডারগুলোই বিভিন্ন পথের নির্দেশনা দিয়েছে। ইংরেজিতে এই পাথরের পিরামিডকে বলা হয় কের্ন, বাংলা করলে হয় সীমানাসূচক প্রস্তর স্তূপ। স্মৃতিস্তম্ভ তৈরিতে ও পথ প্রদর্শক হিসেবে এই পাথরের স্তূপগুলো ব্যবহার হয়। হিমালয়ের পথে হাঁটতে গিয়ে কত ঐতিহ্যের সন্ধান পেয়েছি! আমার কাছে হিমালয়ের হেরিটেজ এ গুলোই।
ট্যাংবোচে বৌদ্ধ মঠ
টেংবোচে মঠ (থ্যাংবোচে বা দাওয়া চোলিং গোম্পা) হলো পূর্ব নেপালের খুম্বু উপত্যকায় অবস্থিত একটি তিব্বতি বৌদ্ধ মঠ, ১২৬৬৭ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এবং এভারেস্ট বেস ক্যাম্প ট্রেকের পথে। এটি সমগ্র অঞ্চলের সবচেয়ে বিশিষ্ট এবং বৃহত্তম মঠগুলোর মধ্যে একটি। এর অবস্থান দুধ কোশি এবং ইমজা খোলা নদীর সঙ্গমস্থলে একটি পাহাড়ে; যেখানে আমা দাবলাম পর্বতের অবস্থান একটি অত্যাশ্চর্য পটভূমি তৈরি করেছে। টেংবোচে মঠ অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছে। নির্মাণকালের প্রথম বছর ১৯১৯ সালে এটি ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়, দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত ছিল ১৯৮৯ সালে এটি আগুনে ধ্বংস হয়ে যায়। পরে এই মনাস্ট্রিকে আবার তৈরি করা হয়।
হিমালয়ের পথে হাঁটতে হাঁটতে কতই না ঐতিহ্য দেখা হলো। এমন নয় শুধুমাত্র একটি মন্দিরের দেখা মিলবে বেস ক্যাম্প অবধি। ছোট ছোট এ রকম অনেক মঠ, স্তূপা, মন্দির চোখে পড়বে। এছাড়া প্রেয়ার ফ্ল্যাগ, প্রেয়ার হুইল তো প্রতিটি গ্রামেই রয়েছে।
হিমালয়ের নায়করা
হিমালয়ের গল্প বলার সময় যদি শেরপাদের কথা না বলি, তাহলে ভীষণ অপরাধবোধে ভুগবো। শেরপা জাতি! হ্যাঁ, হিমালয়ের সত্যিকারের নায়ক তো তারাই! তিব্বত, নেপালের খুম্বু অঞ্চল ও ভারতের দার্জিলিং অঞ্চলে পরিভ্রমণ করা একটি জাতি। হিমালয় অভিযানের একদম শুরুর দিকে এই জাতি মালামাল পারাপারের গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করেছিল। এখন এভারেস্ট এবং হিমালয় অভিযানে শেরপারা একটি অপরিহার্য অংশ। আমার মতো অনেকেই হয়তো পর্বতের গাইডদের শেরপা ভাবেন। কিন্তু শেরপা একটি জাতি; যারা পর্বতে অন্যান্য গাইডের মতো কাজ করে। শেরপা অর্থ গাইড নয়।
যাত্রাপথে দেখা হয়েছিল দুজন শেরপার সাথে। একজন ৭ বার এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছেন, অন্যজন ১৭ বার। দুজনের খাবার হোটেলেই আমি দুপুরের খেয়েছি। দুজনেই সাধারণ, দারুণ অমায়িক। রেস্টুরেন্ট চালিয়ে জীবন ধারণ করেন। শেরপাদের নাম কোথাও শোনা যায় না। মেডেল, সফলতা তো যিনি উপরে উঠেছেন উনার ঝুলিতে গেছে! যাইহোক, এ এক নিদারুণ বাস্তবতা! তবে আমার চোখে এভারেস্টের রিয়েল হিরো শেরপারা আর সেখানে আরোহণ করতে গিয়ে যারা আর ফেরেননি তারা। তারা এভারেস্টকে অমর করেছেন। এই দুজন শেরপার সাথে যখন দেখা হয়েছে, নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হয়েছে। কি অল্প কাজে নিজেকে সফল ভাবতে শুরু করেছিলাম। এভারেস্ট বেস ক্যাম্প ট্রেক সম্পন্ন করা একজন ৪৬ বছর বয়স্ক নন-ট্রেকার নারীর স্বপ্নপূরণ, কোনো সফলতা নয়!
ট্রেকের দিনগুলো
আগেই বলেছি, আমার গাইডের নাম কৃষ্ণা। কৃষ্ণা আর আমি কাঠমান্ডু থেকে একই সাথে লুকলা এসেছি। লুকলাতে এসে যুক্ত হয়েছে আমার পোর্টার খুদ। মাঝ বয়সি খুদ গুড মর্নিং ছাড়া, ইংরেজি একেবারে জানে না বললেই চলে। পুরো সময়টাতে খুদের সাথে আমার হাসি বিনিময় আর ইশারা ইঙ্গিতে কথা ছাড়া সেরকম কোনো বাক্য বিনিময় হয়নি। খুদ আর আমার মাঝে দোভাষীর কাজ করতো কৃষ্ণা। লুকলা এয়ারপোর্টের সব তথ্য কৃষ্ণার কাছ থেকেই শোনা।
লুকলাতে নেমেই সকালের নাস্তা সেরে হাঁটার পালা শুরু, মানে আমার ট্রেকিংয়ের হাতেখড়ি। খাবার হোটেলের সামনেই দেখতে পেলাম খুদ আমার ডাফেল ব্যাগ নাড়াচাড়া করছে। আমি, কৃষ্ণা ও খুদ তিনজনেই রেডি। খুদ লম্বা লম্বা পায়ে পিঠে আমার ১৫ কেজি ওজনের ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে গেল। নিমিষেই সে আমাদের দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেল। হাঁটছি ধীর পায়ে, টুকটাক কথা হচ্ছে কৃষ্ণার সাথে। কৃষ্ণা ভালো বাংলা বোঝে, ইংরেজিতেও বেশ পারদর্শী। শুধু বাংলা ও ইংরেজি নয়, কৃষ্ণা ৪টি ভাষায় কথা বলতে পারে। নেপালের ইতিহাস, হিমালয়ের নানা বিষয়, এভারেস্ট, ট্রেকিং, ট্রেকিংয়ের সময় খাবার দাবার, নিয়ম মেনে চলা, বিশেষ করে প্রচুর পানি করা- সবকিছু সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা দিল সে আমাকে।
হাঁটতে হাঁটতে লোকালয় পার হচ্ছি। সেখানকার অধিবাসীদের সাথে মাঝে মাঝেই হাসি ও কুশল বিনিময় হচ্ছে। প্রথম দিন হেঁটেছিলাম ৯ কিলোমিটার। স্বল্প পরিসরে বেস ক্যাম্প অবধি প্রতিদিনের যাত্রার অভিজ্ঞতা পুঙ্খানুপুঙ্খ বলা সম্ভব নয়। তারপরও যাত্রার কথা বলতে ইচ্ছে করছে। প্রথম দিন রাতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে ফাকদিং নামে এক জায়গায়। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছিল কিন্তু আমার কাক্সিক্ষত লজের দেখা পাচ্ছিলাম না। শেষ বেলায় শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসছিল। কৃষ্ণা হাসতে হাসতে আমার দিকে তাকিয়ে বলছিল ‘Eliza, final legs are always difficult’। শেষ অবধি এসে থামলাম লজে। সেই সময় বাইরের তাপমাত্রা ছিল ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাসের সেরকম তীব্রতা না থাকলেও সমতলের গরম আবহাওয়া থেকে যাওয়ার পর বেশ শীত অনুভূত হচ্ছিল। স্বভাবগতভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কথা মাথায় এলো। রেস্ট রুমে গেলাম, একটি পাত্রে পানি দেখলাম আধা বরফ। বেসিন, কমোড কোথাও পানি আসছে না। কৃষ্ণার শরণাপন্ন হলাম। কথা বলে বুঝলাম- ওয়েট টিস্যু আর বরফ গলা পানি ছাড়া উপায় নেই। রাতে খাবার দেওয়া হলো সন্ধ্যা ৭টায়। নেপালি থালি ভাত, ডাল, পাপড়, সবজি, শাক আর মুরগির তরকারি। খাবার পর বিছানা। বিছানায় মনে হলো কেউ বরফ পানি ঢেলে রেখেছে। পোশাক যা পড়ে ছিলাম শুধু উপরের জ্যাকেটটা খুলে ঘুমাতে গেলাম। শরীর এত ক্লান্ত থাকার পরও ঘুম আসছিল না, কিন্তু কেটে গেল কাক্সিক্ষত স্বপ্নের কাছাকাছি যাওয়ার একটি রাত!
আহ! এভারেস্ট বেস ক্যাম্প!
এর পরের গন্তব্য নামচে বাজার, বেস ক্যাম্প ট্রেকের সব থেকে বড় আর জনপ্রিয় বাজার। কেউ কেউ বেস ক্যাম্প অবধি যান না, নামচে বাজার দেখতেই সংক্ষিপ্ত ট্রেক করে । নামচে বাজার প্রবেশ মুখের পথটা দারুণ। সন্ধ্যে হওয়ার কিছু আগে সুন্দর গোছানো একটি শহরে এলাম। নামচে বাজার এসে নতুন একটি বিষয়ের সাথে পরিচিত হয়েছি এক্লিমাটাইজেশন। বেশি উচ্চতার সাথে শরীরকে খাপ খাওয়ানোর জন্য, নির্দিষ্ট একটি উচ্চতায় যাওয়ার পর আবার নেমে কিছুটা কম উচ্চতায় ঘুমানোর প্রক্রিয়াকে এক্লিমাটাইজেশন বলে। এভাবে পর্যায়ক্রমে উচ্চতার সাথে শরীরকে খাপ খাওয়াতে হয়। নামচে বাজারে পরদিন সকালে এক্লিমাটাইজেশন করতে হবে, অর্থাৎ একদিন এখানে থাকবো। আমি মনে মনে খশি হলাম, কম হাঁটতে হবে, কিছুটা রেস্ট পাবো। নাগরিক সব সুযোগ সুবিধাই এখানে উপভোগ করা যায়। তবে মেলা তেল জলের হিসাব করতে হবে। মানিব্যাগ ভারি হওয়া দরকার শুধু। এই বাজারে পাবেন বিশ্বের উচ্চতম পানশালা ‘আইরিশ পাব’। বিশ্বের উচ্চতম পাঁচ তারকা হোটেলটিও এই নামচে বাজারে অবস্থিত, হোটেল এভারেস্ট ভিউ। নামচে বাজার এত জনপ্রিয় হওয়ার কারণের পেছনে রয়েছে স্যার হিলারি। সবাই বলেন- হিলারি এখানে কিছুদিন বসবাস করেছেন।
বেস ক্যাম্প পৌঁছানো অবধি দিনপঞ্জিটা নামচে বাজারের পর এরকম ছিল- নামচে বাজার থেকে ট্যাংবোচে গন্তব্য, সেখান থেকে দিংবুচে- এভাবে ট্রেক চলতে থাকলো। দিংবুচেতে গিয়ে আবার এক্লিমাটাইজেশন। ধীরে ধীরে উচ্চতায় উঠছি আর শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। শ্বাসজনিত কিছুটা অস্বস্তি, হালকা মাথা ব্যথা, রাতের ঘুমের ব্যাঘাত, খাবারে অনীহা নিজের মাঝে লক্ষ্য করছিলাম। তীব্র মাত্রায় অনুভব করছিলাম না, কিন্তু নিজের ভেতর টের পাচ্ছিলাম।
ডিংবুচেতে এক্লিমাটাইজেশনের সময় বিকালে বেড়াতে গিয়েছিলাম ১৪ হাজার ফুট একটি বেকারিতে নাম ‘ফ্রেন্স বেকারি’। এই প্রথম এত উঁচুতে কোনো বেকারিতে এলাম। এর পরের গন্তব্য লোবুচে। স্বপ্নের বেস ক্যাম্প আর বেশি দূরে নয়, এই উত্তেজনায় রাতের ঘুম আরও কমতে লাগলো। উচ্চতা বাড়ছে, তুষারপাত বাড়ছে, তাপমাত্রা কমছে, উত্তেজনা বাড়ছে, আরও শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। সব মিলিয়ে এখন চিন্তা করতে বসলে আসলেই একটি সুন্দর স্বপ্নের মতো মনে হয়। লোবুচে থেকে গোরকশেপ যাত্রাটা বেশ কষ্টকর লেগেছে। কারণ, গোরকশেপ থেকে সেইদিনই বেস ক্যাম্প যেতে হবে, আবার গোরকশেপে ফিরতে হবে। কারণ, বেস ক্যাম্পে থাকার জায়গা নেই। সেজন্য একটু মানসিক চাপ অনুভব করছিলাম। সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার তাগিদ, অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো আবার এদিকে পা যুগল জানান দিচ্ছিল যে, তারা খুব ভালো নেই।
বিশাল বিশাল পাথর আর গ্লেসিয়ারের (হিমবাহ) উপর দিয়ে হেঁটে যখন এভারেস্ট বেস ক্যাম্প লেখা পাথরটার সামনে দাঁড়িয়েছি, বিশ্বাস হচ্ছিল না। এখনো লেখার সময় বিশ্বাস হচ্ছে না, আমি ট্রেক শেষ করে দেশে ফিরেছি।
কেন হেঁটেছি হিমালয়ে?
এভারেস্ট খুম্বু প্রদেশে অবস্থিত। এখানকার সব পর্বতের নাম স্থানীয় নামের সাথে মিল রেখে করা। তবে সর্বোচ্চ চূড়ার নাম ইংরেজি কেন? কৃষ্ণা বলছিল- ‘তিব্বতীয়দের কাছে এই চূড়া চেমোলুংমা নামে পরিচিত, নেপালের শেরপাদের কাছে পরিচিত সাগরমাথা নামে’। দুটো নাম থাকার পরও এভারেস্ট দেওয়া হলো। পশ্চিমা আগ্রাসন থেকে দক্ষিণ-এশিয়ার দেশগুলোর যেন মুক্তি নেই। এভারেস্ট আমার কাছে ‘সাগরমাথা’ নামেই বেশি প্রেমময়, বেশি মায়াময়।
এই ট্রেক ছিল নিজের সাথে নিজের একটি বোঝাপড়া। একটি স্বপ্নপূরণের প্রতিশ্রুতি। আমাদের দেশে অনেক মধ্য বয়সি নারী রয়েছেন, যাদের ইচ্ছা আছে, সামর্থ্য আছে কিন্তু সেই ইচ্ছা কেউ জাগিয়ে দেয়নি কখনো। আমার মতো একজন ৪৬ বছরের সাধারণ নন-ট্রেকার নারী যদি এভারেস্ট বেস ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে, সেই অভিজ্ঞতা নেওয়ার যোগ্যতা সবার রয়েছে।