■ পর্যটন বিচিত্রা প্রতিবেদন
গ্রামবাংলার প্রকৃত রূপ দেখতে হলে আমাদের পাড়ি জমাতে হবে দেশের বিভিন্ন জেলার নির্জন, নিভৃত, অথচ প্রাণবন্ত গ্রামগুলোতে। এখানে প্রতিটি গ্রাম যেন একেকটি জীবন্ত ছবি, যেখানে প্রকৃতি ও সংস্কৃতি একত্রে মিশে আছে। নিচে তেমনি ১০টি গ্রামের কথা তুলে ধরা হলো।
তাহিরপুর উপজেলা, সুনামগঞ্জ
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার পাথারিয়া, বরুঙ্গা ও লাউরগড় গ্রামগুলো বাংলাদেশের হাওরাঞ্চলের অন্যতম প্রাকৃতিক রত্ন। টাঙ্গুয়ার হাওরের কোল ঘেঁষে এসব গ্রামের অবস্থান। বর্ষাকালে গোটা হাওর পানিতে ডুবে যায়, আর গ্রামগুলো দ্বীপের মতো জেগে থাকে। নৌকা ছাড়া কোনো যাতায়াতের উপায় নেই, যা এক ভিন্ন ধরণের অভিজ্ঞতা। পাথারিয়াতে বসে সূর্যাস্ত দেখা, বা বরুঙ্গার ধানক্ষেতে হাঁটা এক অপার্থিব অনুভূতি তৈরি করে। শীতকালে এখানে অতিথি পাখির আগমন ঘটে, আর গ্রীষ্মকালে ফসলি মাঠ সবুজে মোড়ানো থাকে।
খালিয়াজুরি উপজেলা, নেত্রকোনা
নেত্রকোনার খালিয়াজুরি উপজেলার গাজীপুর, লামাপাড়া ও চরবানাইল গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সহজে ভুলে যাওয়া যায় না। এ অঞ্চল মূলত হাওরবেষ্টিত। বর্ষায় পানিতে ডুবে থাকে গ্রাম, আর শুষ্ক মৌসুমে দেখা যায় বিস্তৃত ধানক্ষেত। গাঁয়ের মেঠো পথ, খালপাড়ে জেলে সম্প্রদায়ের জীবন, পাখির কলতান, সন্ধ্যার বাতাস—সবকিছু মিলে এখানে প্রকৃতি যেন নিজ হাতে ছবি এঁকে রেখেছে। এমন গ্রামে কাটানো একটি দিন মানেই শহরের শত দিনের ক্লান্তি ভুলে যাওয়া।
গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলা, সিলেট
সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার লালাখাল সংলগ্ন গ্রাম ‘চন্দরগাঁও’ এবং জৈন্তাপুরের ‘বারিকটিলা’ গ্রাম দুটি অপরূপ সুন্দর। এখানকার নীলচে নদীর জল, পাহাড়ের সবুজ ঢাল, ঝরনার শব্দ আর গহীন বনের ঘ্রাণ প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। লালাখালে নৌকা ভ্রমণের সময় পাড়ের গ্রামের চা বাগানের দৃশ্য মুগ্ধ করে। জৈন্তাপুরে পাহাড়ি পথ দিয়ে হেঁটে গিয়ে দেখা মেলে নির্জন গ্রাম, যেখানে এখনো আদিবাসী খাসিয়া সম্প্রদায়ের বসবাস আছে। তাঁদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও পরিবেশ-সচেতন জীবনধারা পর্যটকদের মুগ্ধ করে।
বাঘাইছড়ি ও বিলাইছড়ি উপজেলা, রাঙামাটি
রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার রুইলুই পাড়া ও বিলাইছড়ির চংড়াছড়ি গ্রাম দুটি মেঘ ও পাহাড়ে মোড়ানো এক অনন্য লোকালয়। সাজেক যাওয়ার পথেই রুইলুই পড়ে, যা মেঘের রাজ্য নামে পরিচিত। পাহাড়ি পথ বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে গা ছমছমে অনুভূতি হয়, আর চূড়ায় পৌঁছে যখন গ্রামের ঘরবাড়ি, ধোঁয়া ওঠা রান্নার চুলা আর মেঘের খেলা চোখে পড়ে, তখন এক রূপকথার জগতে প্রবেশ করার অনুভূতি হয়। এখানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত—উভয়টাই অপূর্ব। এখানকার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনও এক শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা।
বিরল উপজেলা, দিনাজপুর
উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার বড়বাড়ি, গোপালপুর ও কালিকাপুর গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মৌলিক ও মাটির ঘ্রাণে ভরা। বিশাল ফসলি মাঠ, পাখিপূর্ণ পুকুর, গাছের ছায়া, হিমেল হাওয়া—সবই যেন এক আদি বাংলার দৃশ্যপট তৈরি করে। শীতকালে এখানকার পুকুরগুলোয় অতিথি পাখির আনাগোনা ঘটে। এমনকি এ গ্রামগুলোতে এখনো মাটির ঘর, খড়ের ছাউনি ও বাঁশের বেড়া দেখা যায়, যা আমাদের ঐতিহ্যের স্মারক।
হিজলা উপজেলা, বরিশাল
বরিশালের হিজলা উপজেলার গুয়াবাড়িয়া ও শ্রীপুর গ্রামের চারপাশে কীর্তনখোলা নদী ও অসংখ্য খালের অস্তিত্ব গ্রামগুলোকে জলে ভেসে থাকা গ্রাম বলে মনে হয়। বর্ষাকালে নৌকাই প্রধান বাহন, এবং শীতকালে খালপাড়ে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের প্রান্তসীমায় পৌঁছানো যায়। নারকেল গাছের ছায়া, খালের পাড়ে বসে ধীবরদের মাছ ধরা দেখা, পাখির কিচিরমিচির—সবকিছু মিলিয়ে জীবনের গতি এখানে ধীর, শান্ত ও প্রকৃতির সঙ্গে মিলিত।
শ্যামনগর উপজেলা, সাতক্ষীরা
সুন্দরবনের কোলঘেঁষা শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ও বুড়িগোয়ালিনী গ্রাম দুটি পরিবেশপ্রেমী ভ্রমণপিপাসুদের জন্য আদর্শ। ম্যানগ্রোভ বন, কাঁকড়াযুক্ত খাল, বন্য প্রাণী, নদীর নোনা পানি আর গাছপালার ঘনত্ব এক অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করে। এখানকার মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সংযুক্ত। জীবনযাত্রার প্রতিটি ধাপে প্রকৃতি ও পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। জোয়ার-ভাটা, নৌকাযোগে চলাফেরা, মধু সংগ্রহ, বনজ সম্পদ ব্যবহার ইত্যাদি দেখলে বোঝা যায় জীবনের প্রকৃত মূল কোথায়।
হরিপুর উপজেলা, ঠাকুরগাঁও
হরিপুর উপজেলার বকুয়া ও গেদুড়া গ্রামের চারপাশজুড়ে ভারত সীমান্ত, নদী আর বনের অপূর্ব মিশ্রণ। এই গ্রামগুলোতে এখনো পুরনো মন্দির, ছোট ছোট ঝরনা ও পাখিদের অভয়ারণ্য দেখা যায়। সকালবেলায় নদীর ধারে হাঁটতে হাঁটতে দেখা মেলে চাষিদের জমিতে কাজ করা দৃশ্য, নারী-পুরুষ একসাথে হাঁস-মুরগির যত্ন নিচ্ছে—এসবই জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির ঐকতানে গাঁথা। এখানকার খাদ্যাভ্যাস, গ্রামীণ মেলা, হাট-বাজারের পরিবেশ, সবকিছুই মনকে প্রফুল্ল করে তোলে।
পেকুয়া উপজেলা, কক্সবাজার
কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার রাজাখালী ও উজানটিয়া গ্রামের সৌন্দর্য সম্পূর্ণভাবে সমুদ্র ও পাহাড় নির্ভর। বঙ্গোপসাগরের তীরে জেগে ওঠা এই গ্রামগুলোতে নারকেল ও তালগাছের সারি, বিস্তীর্ণ বালুচর, লবণচাষ, মাছ ধরা—সবকিছুতেই প্রকৃতি ও মানুষের সান্নিধ্য স্পষ্ট। দুপুরবেলা লবণ মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে সূর্যের প্রতিচ্ছবি দেখতে দেখতে হৃদয় কাঁপে। গ্রামগুলো শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে, যেখানে সময় থেমে থাকে প্রকৃতির নিয়মে।
ডিমলা উপজেলা, নীলফামারী
ডিমলা উপজেলার ঝুনাগাছ চাপানী ও পশ্চিম ছাতনাই গ্রাম দুটি তিস্তা নদীর পাড়ঘেঁষা। এখানে নদীর গতিপথ, পলির স্তর, বালুচর আর চরের জীবনযাত্রা পর্যটকদের অভিভূত করে। শুষ্ক মৌসুমে চরে চরে গরু চরানো, পাট চাষ, মাটির ঘর ও খেজুরগাছ দেখা যায়। বর্ষাকালে এই গ্রামগুলোতে নৌকা ভ্রমণ কিংবা মৎস্য শিকার যেন এক নতুন অ্যাডভেঞ্চার।
বাংলাদেশের এই গ্রামগুলো আমাদের প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও শিকড়ের প্রতিচ্ছবি। শহরের আধুনিক জীবন যতই জাঁকজমকপূর্ণ হোক না কেন, গ্রামের প্রকৃতিপূর্ণ পরিবেশে ফিরে এলে বোঝা যায় প্রকৃত শান্তি কোথায়। এসব গ্রাম ভ্রমণ আমাদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়, পরিচয় করিয়ে দেয় প্রকৃতি, পরিবেশ ও মানবিকতার সঙ্গে। প্রতিটি জেলা ও উপজেলার এমন অনেক গ্রাম রয়েছে যা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এতে যেমন অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে, তেমনি সংরক্ষিত থাকবে আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য ও পরিবেশ। বাংলাদেশের প্রকৃত সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে এসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা গ্রামে। শহুরে মানুষকে শিকড়ে ফিরতে হলে এই গ্রামগুলোতেই যেতে হবে। এবং সেই যাত্রা হবে শুধু ভ্রমণ নয়, আত্মিক উপলব্ধি।