পর্যটন বিচিত্রা প্রতিবেদন
বর্ষায় যেখানেই যান না কেন, সবুজ আর জলমগ্ন প্রকৃতি আপনাকে মুগ্ধ করবে। তাই গন্তব্য যেখানেই হোক, বর্ষায় বেরিয়ে পড়াটাই বেশি জরুরি। হাওরের বৈশিষ্ট হলো এখানে বছরের ছয় মাস পানি থাকে, বাকি সময়টা থাকে শুকনা। বর্ষায় হাওর হয়ে ওঠে অনেকটা কূলহীন। বিশাল জলরাশির বুকে বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোকে একেকটা ছোট দ্বীপের মতো মনে হয়। হাওরজুড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা হিজলগাছ আর পানির নিচ থেকে জেগে ওঠা করচের বন সৌন্দর্যের ঝাঁপি মেলে বসে। জলরাশির বুকে উড়ে বেড়ায় সাদা সাদা বক আর পরিযায়ী পাখি। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে সাদা শাপলা। ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য বর্ষায় সৌন্দর্যের সবটুকু দিয়ে পসরা সাজায় হাওর। তবে শুষ্ক মৌসুমেও রূপ কমে না হাওরের। এ সময় হাওর হয়ে যায় দিগন্তবিস্তৃত সবুজের প্রান্তর। মাইলের পর মাইল ফসলি জমি, ধুলা ওড়া মেঠো পথ পেরিয়ে হেঁটে বেড়ানোর আনন্দও কম নয়।
টাঙ্গুয়ার হাওর
বর্ষাকালের রোমাঞ্চকর অনুভ‚তি নেওয়ার জন্য সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর একটি অসাধারণ জায়গা। চারদিকে থৈ থৈ পানিতে এ সময় এক শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্যের দেখা মেলে হাওরে। নৌকার ছাদে রাত কাটানো, জোছনায় চাঁদের রূপালি আলোর মোহনীয় রূপ নিশ্চিতভাবেই আপনাকে কিছু নান্দনিক ছবি দেবে, যদি আপনার ক্যামেরা এমন স্বল্প আলোতে ছবি তোলার উপযোগী হয়।
বর্ষায় হাউসবোটে ভ্রমণের ৫ তথ্য
হাওরে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নদী, নালা ও খাল বর্ষায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। বিস্তীর্ণ জলরাশির মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা হিজল-করচগাছ, পাখির ওড়াউড়ি আর অনতিদূরে ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়। পানি, মেঘ আর পাহাড়ের এমন রূপে মুগ্ধ হয়ে প্রতিবছর টাঙ্গুয়ায় ঘুরতে যান হাজারো পর্যটক। এই পর্যটকদের জন্য কয়েক বছর হলো হাওরে ভাসছে বিশেষায়িত সব নৌযান। ‘হাউসবোট’ নামে পরিচিত বিলাসবহুল এসব নৌকাঘর ভ্রমণপিপাসুদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। জেনে নিন হাউসবোটে ভ্রমণের কিছু তথ্য।
* টাঙ্গুয়ার হাওরের পর্যটকবাহী বেশির ভাগ হাউসবোটই সুনামগঞ্জ শহরের সাহেববাড়ির ঘাট থেকে ছেড়ে যায়। কিছু হাউসবোট তাহিরপুর উপজেলা সদরের থানা ঘাট থেকেও ছাড়ে। সুনামগঞ্জ সদর থেকে সড়কপথে তাহিরপুর যেতে লাগে প্রায় দেড় ঘণ্টা। টাঙ্গুয়ার হাওরের বড় অংশ এই তাহিরপুরেই পড়েছে। হাওরে প্রবেশের দূরত্ব কমে আসে বলেই তাহিরপুর থেকে নৌকাভাড়া অপেক্ষাকৃত কম। তবে বর্ষার সময় পানি বেড়ে গেলে প্রায়ই এই রুটে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তাই ভ্রমণের আগে হালনাগাদ তথ্য জেনে নেবেন।* কোনোটার নাম ‘বর্ষা’, কোনোটা ‘জলনিবাস’ বা ‘মেঘদূত’। বাহারি নামের এসব হাউসবোট হুটহাট ঘাটে গিয়ে ভাড়া করতে পারবেন না। আগে থেকে বুকিং করে যেতে হবে। প্রায় সব হাউসবোটের নামেই ফেসবুক পেজ আছে। পেজে দেওয়া নম্বরে যোগাযোগ করে বুকিং করতে পারেন।
* হাউসবোট বুকিং করার আগে তাদের প্যাকেজ সম্পর্কে জেনে নিন। নৌকার আকার, ধারণক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধা, মৌসুম, ভ্রমণকারীর সংখ্যা ইত্যাদির ওপর হাউসবোটের প্যাকেজ-মূল্য নির্ভর করে। ফেসবুক পেজে ছবি ও ভিডিও দেখে হাউসবোটটি সম্পর্কে ধারণা নিন।
* হাউসবোট ভেদে ১০-২৪ জন পর্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণ করা যায়। এসব নৌযানে খাবারদাবারসহ দুই দিন ও এক রাতের প্যাকেজ জনপ্রতি ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। অন্যান্য দিনের তুলনায় ছুটির দিন ও পূর্ণিমার সময় হাউসবোটের ভাড়া কিছুটা বেশি থাকে।
* হাউসবোটগুলো সকালেই হাওরের উদ্দেশে ঘাট ছাড়ে। এরপর টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচ টাওয়ারে গিয়ে বিরতি দেয়। সেখান থেকে বিকেল নাগাদ চলে যায় টেকেরঘাট, রাতে ওখানেই নোঙর করা থাকে। এখানকার শহীদ সিরাজ লেকে (নীলাদ্রি) সন্ধ্যা কাটান পর্যটকেরা। তারা দ্বিতীয় দিন টেকেরঘাট থেকে শিমুলবাগান, বারিকটিলা, জাদুকাটা নদী হয়ে সন্ধ্যার আগেই আবার সুনামগঞ্জের সাহেববাড়ি বা তাহিরপুর ঘাটে ফিরে আসেন।
কিশোরগঞ্জের নয়নাভিরাম হাওর
হাওর-বাঁওড়-নদীর মায়া ঘেরা অবারিত সৌন্দর্যের জেলা কিশোরগঞ্জে প্রতিদিন বেড়াতে যান হাজারো পর্যটক। জেলার জনপ্রিয় ভ্রমণস্থানগুলোর মধ্যে আছে ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও নিকলীর হাওর এলাকা। এসব এলাকার বেড়িবাঁধগুলোতে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকালে দৃষ্টিসীমার মধ্যে কোনো গ্রাম দেখা যায় না। বর্ষায় এসব বাঁধেই পর্যটকের সমাগম বেশি থাকে। বাংলাদেশে অসংখ্য পর্যটন এলাকা রয়েছে, যার মধ্যে কিশোরগঞ্জের হাওরগুলো প্রকৃতির অশেষ দান। দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি যেকোনো প্রকৃতিপ্রেমীর মনে আনন্দের ঢেউ তুলবে। নীল আকাশ যেন তার সব সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে হাওরের জলরাশির অপর প্রান্তে। দূরের আকাশকে স্পর্শ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে শান্ত স্নিগ্ধ দ্বীপের মতো ভাসমান গ্রামগুলো। যত দূর চোখের দৃষ্টি যায় নীল জলরাশির ছোট ছোট ঢেউয়ের ভাঁজে ভেসে উঠে অর্ধডুবন্ত সবুজ গাছগাছালি। রাজহাঁসের স্বাধীন ছুটে চলা পুলকিত করে হাওরে ঘুরতে আসা সৌন্দর্যপ্রেমীদের। ছাতিরচরের অর্ধডুবন্ত করচের বন এবং হাওরের ছোট–বড় নৌকা দিয়ে মাছ ধরার দৃশ্য দেখে মনে হবে যেন এক একটি জীবন্ত ছবি।
কিশোরগঞ্জের বড় হাওরগুলো ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলায়। হাওরবেষ্টিত এ জনপদে থইথই পানি থাকে পাঁচ থেকে ছয় মাস। পানি নেমে যাওয়ার পর সবুজ পালকে ভরে উঠে পুরো হাওর। সারা বছর হাওরের সৌন্দর্য অটুট থাকলেও মূলত বর্ষাকালই ভ্রমণপিপাসুদের মূল আকর্ষণ। হাওরে দেশের প্রকৃতিপ্রেমিকদের ভিড় হয় বর্ষায়। কিশোরগঞ্জ শহর থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা অটোয় যেতে হয় চামড়া বন্দর। চামড়া বন্দর থেকে নৌকায় বা স্পিডবোটে ইটনা, মিঠামইন কিংবা অষ্টগ্রাম যাওয়া যায়।
হাওরের আসল সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে বের হতে হয় রাতে। নিস্তব্ধ হাওর যেন আঁকড়ে ধরে কান পেতে নীরবতাকে অনুভব করার জন্য। রাতের হাওর উপভোগ করার জন্য নৌকা ভাড়া করতে হবে। ভ্রমণের জন্য কিশোরগঞ্জের বেশ কিছু দর্শনীয় স্থানে দর্শনার্থীদের ভিড় হয়। এর মধ্যে নিকলী বেড়িবাঁধ, ছাতিরচরের অর্ধডুবন্ত করচের বন, করিমগঞ্জের বালিখলা, মিঠামইন উপজেলার ইটনা, মিঠামইন এবং অষ্টগ্রাম অলওয়েদার সড়ক।
এ ছাড়া ভ্রমণপিপাসুদের নজর কাড়ে বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতীর স্মৃতিবিজড়িত মন্দির, দিল্লির আখড়া, ঈসা খাঁর দুর্গসহ অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থাপনা। হাওর ছাড়াও এই বর্ষায় যেতে পারেন কয়েক জায়গায়-
বিছনাকান্দি
মেঘালয়ের সেভেন সিস্টার্স থেকে আসা পানির ধারা প্রকৃতিতে অপরূপ দৃশ্য তৈরি করে বিছনাকান্দিতে। ২ পাশে পাথুরে পথ এক অপার্থিব আবহ এনে দেয়। সিলেটের অন্যান্য ভ্রমণ-গন্তব্যের মতো বিছনাকান্দিও বর্ষাকালে প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। মোহনীয় ঝর্ণার সঙ্গে চমৎকার পানির প্রবাহ শুধু সারাজীবন মনে রাখার মতো অভিজ্ঞতাই দেবে না, সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য অসাধারণ কিছু ছবিও দেবে।
নাফাখুম ঝর্ণা
বান্দরবানে পাহাড়ের গহীনে অবস্থিত নাফাখুম ঝর্ণা। বর্ষাকাল এই ঝর্ণায় যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময়। এই সময়েই ঝর্ণাটি তার পরিপূর্ণ রূপে দেখা দেয়। বৃষ্টির কারণে ঝর্ণার পানির প্রবাহ এতটাই বেড়ে যায়, সেই দৃশ্য একবার দেখলে আর ভুলবার নয়। আপনি এই ঝর্ণার এবং ঝর্ণার সঙ্গে নিজের অপূর্ব কিছু ছবি তুলতে পারবেন, তবে সতর্কতার বিষয়টি অবশ্যই মাথায় রাখবেন।
কাপ্তাই লেক
নীল পানিতে নৌকায় চড়া মানুষ, পরিষ্কার নীল আকাশ আর বিশুদ্ধ প্রকৃতি – এমন ছবি দেখে আমরা সবাই কম-বেশি ভেবেছি এ যেন সোশ্যাল মিডিয়ার জন্যই তোলা। এমন ছবি তোলার জন্য সবচেয়ে উপযোগী জায়গা হল কাপ্তাই লেক, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় কৃত্রিম লেক। বর্ষাকালে কর্ণফুলী বাঁধ খুলে দেওয়া হয়, লেকের পানি বেড়ে যায় অনেক। এখানে কায়াকিং, মাছ ধরা, নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়ানো- এমন নানা ব্যবস্থা রয়েছে পর্যটকদের জন্য। লেকের পাড়ে রয়েছে রিসোর্টও, যেখান থেকে লেকের অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়। কাপ্তাই লেকে এমন চমৎকার দৃশ্য আর অ্যাক্টিভিটির পাশাপাশি আপনি পাবেন দারুণ সব ছবি।
শ্রীমঙ্গল
দিগন্তজোড়া সবুজ চা-বাগানের জন্য পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল। এটি বাংলাদেশের চায়ের রাজধানী হিসেবে পরিচিত। যেহেতু শ্রীমঙ্গলের প্রধান আকর্ষণ চা বাগান, তাই বর্ষাকালে এখানে এলেই সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করা যাবে। তাছাড়া, এখানকার লেক ও বনগুলোও বর্ষাকালে সবচেয়ে সুন্দর রূপ ধারণ করে। শ্রীমঙ্গল একটি উপভোগ্য ও প্রশান্তিদায়ক ভ্রমণের অভিজ্ঞতা দেওয়ার পাশাপাশি কিছু চমৎকার ছবিও দেবে, যার জন্য তেমন কোনো এডিটিংও প্রয়োজন হবে না।
বর্ষাকালে ভ্রমণ করা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কিছুটা কঠিন এবং দুঃসাধ্য হতে পারে আবহাওয়ার জন্য। তবে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও সতর্কতার সঙ্গে ভ্রমণ করলে আপনি নিজেকে আবিষ্কার করবেন সবুজ প্রকৃতি আর বিস্তীর্ণ জলাশয়ের মধ্যে, যা আপনার ইন্সটাগ্রাম ফিডে প্রকৃতির ছোঁয়া এনে দেবে।
দক্ষিণের জলতরঙ্গ
বর্ষায় দুক‚ল ছাপানো নদীর উথাল-পাতাল রূপ দেখতে চাইলে যেতে হবে মেঘনার নিম্নেংশে। ঢাকার সদরঘাট থেকে প্রতিদিনই একাধিক লঞ্চ ভোলার ইলিশা, মনপুরা, চরফ্যাশন, নোয়াখালীর হাতিয়াসহ বিভিন্ন রুটে যায়। ঘনঘোর বর্ষাদিনে এসব লঞ্চে চেপে দক্ষিণের কোনো জনপদের উদ্দেশে দুদিনের জন্য বেরিয়ে পড়তে পারেন। তবে এই ধরনের যাত্রায় লঞ্চভ্রমণে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ঝড় ও বন্যা পরিস্থিতির কথা মাথায় রাখতে হবে, বাছাই করতে হবে মানসম্পন্ন লঞ্চ।
জলপ্রপাত
বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, চট্টগ্রাম, সিলেট, মৌলভীবাজারে আছে ছোট-বড় অনেক জলপ্রপাত। নাফাখুম, ধুপপানি, জাদিপাই, হামহাম—বাহারি নামের মতো রূপেও জলপ্রপাতগুলো অনন্য। গহিন পাহাড়ের এই জলপ্রপাতগুলো দেখতে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে পিছপা হচ্ছেন না রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষেরা।
বর্ষায় প্রতিটি জলপ্রপাত প্রাণ ফিরে পায়, বিপুল জলপতনের আনন্দে হয়ে ওঠে উচ্ছল।
এই বর্ষায় কোনো জলপ্রপাত দর্শনের পরিকল্পনা আপনিও করতে পারেন। শীতল হতে যেতে পারেন পাহাড়ের মাথা থেকে গড়িয়ে পড়া জলধারার নিচে। তবে একটা কথা মনে করিয়ে দিই, বান্দরবানের রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলায় নিরাপত্তাজনিত কারণে ভ্রমণ-নিষেধাজ্ঞা এখনো জারি আছে। এই তিন উপজেলায় বেশ কিছু বুনো জলপ্রপাত থাকলেও আপাতত সেসব ভ্রমণতালিকা থেকে বাদ রাখতেই হবে।
সাজেক
বর্ষায় পাহাড়ি প্রকৃতি সবুজ হয়ে ওঠে। পাহাড়ের সবুজে ডানা মেলে সাদা-কালো মেঘ। সবুজের বেষ্টনীতে কেবলই বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা! ভোরে বৃষ্টি হলে মেঘ ঢুকে পড়ে শোবার ঘর পর্যন্ত। সাজেকের মেঘ কখনো ধরা দেয় সমুদ্রের রূপে। সবুজ উপত্যকা, অপার্থিব সূর্যোদয়, জোছনায় ছড়িয়ে পড়া মেঘের দল, আকাশের মেঘের অনেক রং মিলিয়ে সাজেক যেন অন্য এক জনপদ। এক জাদুকরি প্রকৃতির রহস্যঘেরা উপত্যকা। সারা দেশে পর্যটকদের পছন্দের নামও সাজেক। পাহাড়ি এই উপত্যকা রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায়। যাতায়াত করতে হয় খাগড়াছড়ি শহর হয়ে। বর্ষায় সাজেকের শোভা দেখার পরিকল্পনা আঁটতেই পারেন।
চলনবিল
ভরা বর্ষায় চলনবিল হয়ে ওঠে জল-থইথই। চলনবিল শুধু একটি বিল নয়, অনেক বিল, খাল ও নদী নিয়ে গড়ে ওঠা জলাভ‚মি। বিলটি বিস্তৃত নাটোরের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর এবং সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও রায়গঞ্জ উপজেলার ১ হাজার ৬০০টি গ্রাম নিয়ে। বর্ষার অবারিত জলে নৌকায় ভাসতে চলনবিল রাখতে পারেন ভ্রমণতালিকায়।
চলনবিলে ঘুরতে সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নাটোরের বিভিন্ন জায়গা থেকে যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জের কাছিকাটা অথবা পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর। সবখানেই বাসযোগে যাওয়া যাবে। অন্যদিকে ঢাকা থেকে ট্রেনযোগে চাটমোহর অথবা ভাঙ্গুড়ার বড়াল ব্রিজ স্টেশনে নেমে ভাড়ার নৌকায়ও চলনবিল ঘোরা যাবে।
বৃষ্টিমুখর সমুদ্র
বর্ষা মৌসুমের আগমনী সুর বাজার আগে থেকেই কক্সবাজার ও কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে পর্যটকের আনাগোনা কমতে থাকে। বৃষ্টিবাদলের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষ সমুদ্রবিলাসে তেমন একটা আগ্রহী হয় না। তাই দুটি এলাকাতেই লোকসমাগম থাকে কম। পর্যটনের ভাষায় এই সময়টাকে বলা হয় ‘অফ সিজন’। সেই সময়টায় পর্যটক টানতে হোটেল-রিসোর্টগুলো ছাড়ও দিয়ে থাকে। তবে বৃষ্টিবহুল বর্ষা যাদের প্রিয়, সমুদ্রের ঘোলা জলের জোরালো ডাক যাদের আন্দোলিত করে, তাঁরা ঠিকই ছুটে যান সৈকতের পাড়ে। যথেষ্ট ছাড়ে থাকা-খাওয়ার সুবিধার সঙ্গে তাঁরা পেয়ে যান কোলাহলহীন সৈকতের নির্জন রূপ।
বর্ষাকালে ভ্রমণের পূর্বে কিছু সতর্কতা
আপনি যদি খুব বেশি ভ্রমণপিপাসু হয়ে থাকেন তবে বর্ষাকালে ভ্রমণ আপনার জন্য নতুন কিছু নয়। অবশ্য খুব গরম বা হাড়-কাপানো শীত অথবা পা পিছলে পড়ে যাবার মত বৃষ্টি ভেজা আবহাওয়ায় যারা ভ্রমণ করতে ভালবাসেন, কোনও কিছুই তাদেরকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। এরপরেও আপনার ভ্রমণকে আরও সুন্দর এবং ঝামেলামুক্ত করার জন্য কিছু পূর্ব সতর্কতা মেনে চলতেই হয়। চলুন দেখে নেই, এই বর্ষায় ঘুরতে যাবার আগে কি কি ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে।
সঠিক গন্তব্য বাছাই
বন্ধু-বান্ধব সবাই একসাথে হয়ে হুট করে বেরিয়ে পড়লেন। গন্তব্যে পৌঁছে স্থানীয় সবার কাছে শুনলেন এই জায়গাটা এই সময়ে না, অন্য আরেক সময়ে অনেক ভালো লাগে। অগত্যা কোনও রকম ঘুরে আসার পর আপনার বন্ধুদের যারা ইতোমধ্যে সেখানে আগে ঘুরে এসেছে তাদের কাছেও একই কথা শুনলেন।
এরকম হতাশাজনক অবস্থায় পড়তে না চাইলে বর্ষাকালে ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে সুন্দর জায়গাগুলোর ব্যাপারে আগে থেকেই জেনে রাখুন। অবশ্য বাংলাদেশ বর্ষাকাল এবং শীতকাল দুই ঋতুতেই অপরূপ সাজে সেজে উঠে। তাই বর্ষাকালে বাংলাদেশ ভ্রমণের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। শুধু আগে থেকে কাছাকাছি নিরাপদ আশ্রয়স্থল, থানা, এবং হাসপাতালগুলোর ব্যাপারে জেনে নেবেন।
আবহাওয়ার খবর দেখে নেয়া
এসময় বৃষ্টির ব্যাপারে সঠিক করে কিছুই বলা যায় না। রওনা হওয়ার সময়ে হয়ত দেখবেন রৌদ্রজ্জ্বল দিন আর গন্তব্যে পৌঁছার ঠিক আগ মুহুর্তে অকস্মাৎ বৃষ্টি এসে একদম কাক ভেজা করে দিবে। তাই আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী যাত্রার শুরু থেকে গন্তব্যে পৌছার আগে কোথায় কোথায় থামবেন, তার একটা ছোট্ট ছক করে ফেলুন। যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থার জন্য বিকল্প রাস্তা বের করে রাখুন। কারণ অনেক পরিকল্পনার পরেও স্বাভাবিকভাবেই সব কিছু পরিকল্পনা-মাফিক হয় না।
দিনের শুরুতে যাত্রা
বর্ষাকালে ভ্রমণ মানেই বৃষ্টির জন্য আপনার যাত্রা দেরি অথবা গন্তব্যে পৌঁছাতে দেরি। তাই কিছুটা সময় হাতে নিয়ে আগেই বেড়িয়ে পড়ুন। আর অবশ্যই রাতে নয়। মুষলধারে বৃষ্টি বা ঝড়ো বৃষ্টি দুই ক্ষেত্রেই দিনে ভ্রমণটাই বেশি নিরাপদ। তাছাড়া আপনি যদি বৃষ্টির সৌন্দর্য উপভোগ করতে চান, সেক্ষেত্রেও সকাল সকাল বেরিয়ে পড়াটাই উত্তম। আপনার অবস্থান এবং গন্তব্যের মধ্যকার দূরত্বটা জেনে রাখুন। সেই সাথে যে গাড়িতে যাচ্ছেন, তাতে করে সেখানে পৌছতে কত সময় লাগতে পারে তারও একটা ধারণা নিন।
পানি নিরোধক পরিধেয় ও ব্যাগ প্যাক
বর্ষাকোলে ভ্রমণে এটা অনিবার্য যে, আপনি ও আপনার জিনিসপত্র সব ভিজে যাবে। তবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
রেইনকোট ও ছাতা সাথে নিয়ে নিন। আপনার কাপড় নেয়ার জন্য পানি নিরোধক এবং খুব সহজেই ভাঁজ করা যায় এমন ব্যাগ সাথে নিয়ে নিন। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আপনার ঘড়ি, মোবাইল ফোন, ক্যামেরা, পাওয়ার ব্যাঙ্ক প্রভৃতিকে বৃষ্টি থেকে রক্ষা করা।
এগুলোর জন্য একটু খরচ হলেও ভালো পানি নিরোধক ব্যাগ কিনে নিন। আপনার এই বিনিয়োগটি পরবর্তীতে আপনার অতি প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিগুলোকে রক্ষা করবে।
ওষুধ এবং পোকামাকড় নিরোধক সাথে নেয়া
বৃষ্টির এই মৌসুমে প্রত্যেকটি পর্যটন এলাকাই মশা এবং অন্যান্য পোকামাকড়ের প্রজনন ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, খাবারগুলোতেও ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বেড়ে যায়। তাই বিভিন্নভাবে আপনি ফুড পয়জনিংয়ের শিকার হতে পারেন। এ জন্য আগে থেকেই সম্ভব হলে একটি ফার্স্ট এইড বক্স সাথে রাখুন। পোকামাকাড় নিরোধক ক্রিমগুলো আপনাকে যে কোনো জায়গায় সুরক্ষা দিবে। আর অনেক সময় ঘুরতে গেলে আশেপাশে কোনো ফার্মেসি নাও পাওয়া যেতে পারে। তাই সাথে ওষুধ থাকা আবশ্যক। এগুলো আপনার খাবারে সমস্যা, ভ্রমণের কারণে মাথা ব্যথা, ছোট্ট-খাট জখম ইত্যাদিতে কাজে লাগবে।
সর্বপরি আপনার বর্ষাকালের ভ্রমণ শুরুর আগের দিনেই এই গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো তালিকা করে আপনার স্মার্টফোনে সেভ করে রাখতে পারেন। কী কী নিয়েছেন, কোথায় কী রেখেছেন এসব কিছু পরবর্তীতে আপনি চটজলদি বের করে ফেলতে পারবেন। এই সতর্কতাগুলো আপনার প্রিয়জনের সাথে আপনার দীর্ঘ পথের ভ্রমণটিকে আরো বেশি দ্বিধাহীন করে তুলবে।