পর্যটন বিচিত্রা ডেস্ক
ঢাকা থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার উত্তরের জেলা টাঙ্গাইল। যেখানে ভাওয়ালের পাহাড়ি বনের সঙ্গে মিলিত হয়েছে যমুনা নদীর মোহনা, দেখা মেলে গারো ও কোচ উপজাতির অনন্য সংস্কৃতির। পর্যটনের জন্য খুব একটা পরিচিত না হলেও গ্রামের মনোরম পরিবেশ, গভীর বন, সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক তাৎপর্যের জন্য খ্যাতি রয়েছে টাঙ্গাইল জেলার। বিখ্যাত সব রাজবাড়ি দর্শনের পাশাপাশি টাঙ্গাইলে বিখ্যাত চমচমের স্বাদ গ্রহণ করতে আপনিও চাইলে একদিনেই ঘুরে আসতে পারেন টাঙ্গাইল থেকে।
মহেরা জমিদার বাড়ি
টাঙ্গাইল শহর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই জমিদার বাড়ি। ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের নাটিয়াপাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই জমিদারবাড়ি। টাঙ্গাইলে অবস্থিত বিভিন্ন জমিদার বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হলো মহেরা জমিদার বাড়ি। আজও চকচক করছে এ বাড়ির দেওয়াল। এ বাড়ির দিকে তাকালেই আপনি বুঝতে পারবেন, তখনকার কারিগরদের হাতের ছোঁয়া কি অপূর্ব ছিল। ১৮৯০ সালেরও আগে নির্মিত হয় এই জমিদার বাড়ি। স্পেনের করডোভা নগরের আদলে নির্মিত এই জমিদার বাড়ি। কালীচরণ সাহা ও আনন্দ সাহা নামে দুই ভাই ১ হাজার ১৭৪ শতাংশ জমির উপর এই বাড়ি নির্মাণ করেন। এই জমিদার বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়বে বিশাখা পুকুর। ভেতরে ঢুকলে চৌধুরী লজের দেখা পাবেন। এর পাশেই আছে আকর্ষণীয় এক ভবন। যার নাম আনন্দ লজ। তার পাশে আছে মহারাজ লজ। এই জমিদার বাড়ির সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও সুন্দর ভবনের নাম কালীচরণ লজ। ইংরেজি ইউ অক্ষরের আদলে করা ভবনটি রানিদের জন্য নির্মাণ করা হয়। তাই একে রানি ভবনও বলা হত। জমিদার বাড়ির ভেতরে বাগান, শিশুপার্ক, বিভিন্ন আর্টিফিশিয়াল স্থাপনা আছে। এছাড়া পাখ-পাখালি, বাগান, পুকুর, বিল্ডিং সব মিলিয়ে স্বপ্নপুরীর মতো মনে হয় মহেরা জমিদার বাড়ি।
হেমনগর জমিদারবাড়ি
জমিদার হেমচন্দ্রের নামেই স্থানটির নামকরণ হয় হেমনগর। টাঙ্গাইল থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে ও গোপালপুর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই জমিদার বাড়ি। ১৮৯০ সালের দিকে হেমচন্দ্র এখানে তার এই সুন্দর রাজকীয় বাড়িটি নির্মাণ করেন ১৮০০ বিঘার উপরে। জানা যায়, দিল্লি ও কলকাতার কারিগররা এই বিশাল জমিদার বাড়ি নির্মাণ করেন।
স্থানীয়রা এই জমিদার বাড়িকে পরীর দালান নামেই বেশি চেনেন। সেখানে ঢুকতেই চোখে পড়ে এর মূল ভবনের চাকচিক্য। দামি পাথর ও রঙিন কাঁচ ব্যবহার করে বাড়ির দেওয়া এমনকি পিলারগুলোতেও কারুকার্য করা। এই জমিদার বাড়ির মেঝেতেও অপূর্ব নকশা করা আছে। এই বাড়িতে ২৫টি কক্ষ আছে। যার সামনের অংশ পুরো ইউরোপীয় ধাচের। একসময় রাজবাড়ির মাঝখানে ছিলো একটি দিঘী, যা ভরাট হয়ে গেছে। এর কাছাকাছি বেশ কিছু পুরনো নিদর্শন আছে, যা রাজা হেমচন্দ্র তার আত্মীয় স্বজনের জন্য নির্মাণ করেছিলেন। সেগুলো ছিল ছোট ছোট কুঠির। পর্যটকদের কাছে এই রাজবাড়িও জনপ্রিয় একটি টুরিস্ট স্পট।
করটিয়া জমিদার বাড়ি
মোঘল স্থাপত্য শিল্পের অন্যতম নিদর্শন হলো করটিয়া জমিদার বাড়ি। টাঙ্গাইল সদর উপজেলা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে করটিয়া ইউনিয়নের পুটিয়া নদীর তীরে এই জমিদার বাড়ি অবস্থিত। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় এই বাড়ির জমিদার ভারতে চলে যান। তবে এখন তার কিছু বংশধরেরা বাস করছে বাড়িটিতে। এজন্য পর্যটকদের দুই ঈদের সময় ছাড়া তেমন ঢুকতে দেওয়া হয় না। জানা যায়, বিখ্যাত পন্নী পরিবারের ১১ তম পুরুষ সাদত আলী খান পন্নী করটিয়াতে পন্নী বংশের ভিত প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকেই তার বংশধরেরা এখানে বসবাস করতে শুরু করেন।
দেলদুয়ার জমিদার বাড়ি
টাঙ্গাইলের একমাত্র মুসলিম জমিদার বাড়ি হচ্ছে দেলদুয়ার জমিদার বাড়ি। সেখানকার দেলদুয়ার উপজেলায় অবস্থিত এই জমিদার বাড়ি। স্থানীয়দের কাছে এটি নর্থহাউজ নামেও পরিচিত। ঔপনিবেশিক স্থাপত্যশৈলীর আদলে তৈরি একতলা বিশিষ্ট এই জমিদার বাড়ির সৌন্দর্যের তুলনা হয় না। লাল-সাদা রঙের একতলা এই জমিদার বাড়ির শিল্পকর্মে মসজিদের মতো কারুকার্য দেখা যায়। যা মনে প্রশান্তি এনে দেয়। এই জমিদার বাড়ির ঠিক মাঝ বরাবর আছে ছাদ। সেটি বেশ ভিন্ন। সেখানেই নাকি বাড়ির নারীরা আড্ডা দিতেন। জমিদার বাড়ির ঠিক পূর্ব পাশে আছে লোহার গার্ডেন চেয়ার, গোল টেবিল, পানির ফোয়ারা। পেছনে আছে আম বাগান। পূর্ব দক্ষিণ কোণে রয়েছে তিনটি বিশাল গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ, এর পাশেই আছে একটি বিশাল। রাজবাড়ির সামনে দেখতে পাবেন পারিবারিক কবরস্থান। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে এই জমিদার বংশের সমাপ্তি ঘটে। অন্যান্য জমিদার বাড়ির তুলনায় এটি বেশ ভালো অবস্থানে আছে। এখনো একজন কেয়ারটেকার বহাল আছেন এই রাজবাড়ি দেখভালের জন্য।
পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি
টাঙ্গাইল সদর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণে নাগরপুর উপজেলার লৌহজং নদীর তীরে পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি অবস্থিত। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে রামকৃষ্ণ সাহা মন্ডল নামক একজন ধর্নাঢ্য ব্যক্তি পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি স্থাপন করেন।
১৫ একর জায়গার উপর ৩টি অট্টালিকা নির্মাণ করেন তিনি। এগুলোর একত্রে নাম রাখেন তিন তরখ। অট্টালিকাগুলো আকারে বড়, মেঝো ও ছোট হলেও দেখতে কিন্তু একই রকম। এই বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়বে ৩টি নাট মন্দির। রেলিং টপ কিংবা কার্নিশ যে দিকেই চোখ যোবে দেখবেন ছোট ছোট নারী মূর্তি। প্রতিটি অট্টালিকার মাঝে আছে দুটি সুন্দর নারী মূর্তি। তার পাশে আছে একটি করে ময়ূর। ১০০ বছরের পুরোনো ছায়াঘেরা সুনিবিড় পরিবেশ জমিদারদের আমেজটা আজও ধরে রেখেছে। জমিদার বাড়িটি ভ্রমণপিপাসু ও ইতিহাসপ্রেমীদের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে আজও। বাড়ির পেছনে আছে একটি দিঘি ও ২টি পরিত্যক্ত ক‚প। বর্তমানে জমিদার বাড়িটি বিসিআরজি ডিগ্রি কলেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
মধুপুর জাতীয় উদ্যান
নিরিবিলি কোনো এক বিকেলে গভীর বনে হারিয়ে যাওয়ার অনুভ‚তি পেতে টাঙ্গাইলের ২০ হাজার একরেরও বেশি এলাকা জুড়ে রয়েছে মধুপুর জাতীয় উদ্যান। শহরের কোলাহল থেকে দূরে প্রশান্তির খোঁজ পেতে মধুপুর জাতীয় উদ্যানকে সেরা জায়গা মনে হয় প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে। অল্প বিস্তর পরিচিত সংরক্ষিত এই বনে রয়েছে হরিণ প্রজনন কেন্দ্র। ফলে এখানে ঘুরতে গেলে প্রকৃতির কোলে বন্যপ্রাণীদের ছুটে বেড়ানোর দৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। কুটিরশিল্পের পণ্য কেনার ইচ্ছা থাকলে উদ্যানের আশেপাশের কারিতাস দোকানগুলোতে যাওয়া যেতে পারে। মধুপুরে আসলে আনারসের স্বাদ নিতে ভুলবেন না যেন। এখানকার আনারসের জাত যেমন দেশসেরা, তেমনি দামে সস্তা। ঢাকা থেকে ২ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে মধুপুর শহরে আসার পর কয়েক মিনিট এগোলেই দেখা মিলবে মধুপুর জাতীয় উদ্যানের।
পীরগাছা রাবার বাগান
টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার মধ্যে অন্যতম মনোরম স্থান হলো পীরগাছা রাবার বাগান। এখানকার বাগানে সারিবদ্ধভাবে বেড়ে ওঠা বড় বড় গাছ বছরে ২ ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে। বর্ষাকালে গাছগুলোতে দেখা যায় সবুজের সমারোহ আর শীতকালে তারা সেজে উঠে পাতা ঝড়া সৌন্দর্যে। ফলে প্রত্যেক সময়ই বাগানে মাধুর্য বিরাজ করে। বাগানের ঠিক পূর্ব দিকে গেলে পাওয়া যাবে রাবার কারখানা। যেখানে কাঁচা রাবার সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ, শিট প্রস্তুতকরণের পুরো প্রক্রিয়া দেখার সুযোগ মিলবে। অনুমতি সাপেক্ষে এখানকার ফুলের বাগানঘেরা রেস্ট হাউজে থাকা যায়। মধুপুর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে পীরগাছা রাবার বাগানে সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা মোটরবাইকের মাধ্যমে যাওয়া যাবে।
আতিয়া মসজিদ
টাঙ্গাইল জেলার অন্যতম আইকনিক ও স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নিদর্শন হলো দেলদুয়ার উপজেলার আতিয়া মসজিদ। মুঘল ও সুলতানি আমলের অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর এই মসজিদের নকশা একসময় ১০ টাকার নোটে দেখা যেত। ছোট পরিসরের এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটির নির্মাণশৈলী বেশ আলাদা ধরনের। বাংলায় এ ধরনের মসজিদ নির্মাণশৈলী খুব একটা দেখা যায় না। টাঙ্গাইল শহর থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে আতিয়া গ্রামে অবস্থিত এই সুন্দর মসজিদটিতে অটোরিকশায় করে যাওয়া যায়।
২০১ গম্বুজ মসজিদ
টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার পাথালিয়া গ্রামে অবস্থিত ২০১ গম্বুজ মসজিদ। সুসজ্জিত ২০১টি গম্বুজের এ মসজিদে রয়েছে ৮টি সুউচ্চ মিনার, যার মধ্যে ৪টি ১০১ ফুট এবং বাকি ৪টি ৮১ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট। মসজিদের পশ্চিম দিকের প্রাচীরটি এখনও নির্মাণাধীন। চমৎকার এ মসজিদটি দেখতে বাস বা ব্যক্তিগত গাড়িতে করে গোপালপুর উপজেলায় পৌঁছাতে হবে। তারপর মসজিদে যাওয়ার জন্য যেকোনো স্থান থেকে পরিবহন পাওয়া যাবে।