পর্যটন বিচিত্রা প্রতিবেদন
ঝরনার পাশাপাশি উপজেলার অন্যান্য পর্যটন স্পটও ঘুরে দেখতে পারবে ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকরা। বন্ধু-সহপাঠী, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে ঝরনার স্বচ্ছ পানিতে ঘা ভেজানোর জন্য সময় এখন।
জানা গেছে, মিরসরাই উপজেলা ঝরনার রানি হিসেবে সারাদেশে পরিচিত খৈয়াছড়া ঝরনা। সেখানে বছরের যেকোনো সময় দূরদূরান্ত থেকে প্রতিদিন ছুটে আসে ভ্রমণপিপাসুরা। এবারের ঈদের ছুটিতে মানুষের ঢল নামতে পারে খৈয়াছড়া ঝরনা ছাড়াও রূপসী ঝরনা, হরিনাকুণ্ড ঝরনা, নাপিত্তাছড়া ঝরনা, সোনাইছড়ি ঝরনা, বোয়ালিয়া ঝরনা ও মেলখুম ট্রেইলে। এ ছাড়াও বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃত্রিম লেক মহামায়া ইকোপার্কেও পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন।
সৌন্দর্যের হাতছানি মহামায়া লেকে
মহামায়া লেক দেশের পর্যটকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়। পাহাড়ের কোলঘেঁষে আঁকাবাঁকা লেকটি দেখতে অপরূপ সুন্দর। ছোট বড় অসংখ্যা পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত এই মহামায়া লেক। এই লেকের অন্যতম আর্কষণ হচ্ছে পাহাড়ি ঝরনা এবং এর স্বচ্ছ পানি। এর জলাধারের চারপাশে দেখলে মনে হবে সবুজের চাদর বিছানো রয়েছে।
আপনার মনে হবে যেন কোনো এক শিল্পীর সুনিপুণ ছবি। মহামায়া লেকের নীল জলরাশিতে আপনি ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা বা ইঞ্জিন চালিত নৌকা দেখতে পাবেন। এই নৌকায় পরিবার পরিজন নিয়ে আপনি লেকের স্বচ্ছ পানিতে ঘুরতে পারেন এবং হারিয়ে যেতে পারেন লেকের অপরূপ সৌন্দর্যের মাঝে।
নৌকাতে বসে মহামায়া লেকের চারপাশের পাহাড় ও বিশাল জলরাশি আপনাদের মুগ্ধ করে তুলবে। বিকেল বেলা সূর্য যখন অন্তিম নীলিমায় ডুবে যায় তখন লেকের পরিবেশটি খুবই চমৎকার লাগে।
লেকের স্বচ্ছ পানি ছাড়াও রয়েছে পাহাড়ের মাঝে একটি গুহা, কিছু প্রাকৃতিক ঝরনা এবং রাবার ড্যাম। মহামায়ার নীলাভ জলরাশি, দুই পাশে উঁচু উঁচু পাহাড়, পাহাড়ের কোলঘেঁষে স্বচ্ছ পানিতে তাকাতেই দেখা যায় নীলাকাশ। পূর্ব দিগন্তের সারি পাহাড়ের বুক চিরে যেতে যেতে একসময় হারিয়ে যেতেও মন চাইবে কল্পনায়। মনে হবে এক অন্য রকম সৌন্দর্য রচিত হয়েছে।
আপনি চাইলে নৌকা দিয়ে লেকে ঘোরাঘুরির পাশাপাশি, নিরিবিলি স্থানে বসে ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে পারবেন। অবশ্য এজন্য আপনাকে ছিপ আগে থেকে নিয়ে যেতে হবে। লেকের পাড়ের নির্মল আর বিশুদ্ধ বাতাস আপনার শরীর ও মনকে মুহূর্তেই সতেজ করে তুলবে।
লেকের পানিতেও সাঁতরে বেড়াতে পারবেন ইচ্ছামতো। লেকের শেষ প্রান্ত সেখানেও রয়েছে ঝরনাধারা। পর্যটকদের দারুণ অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ দিতে এখানে রয়েছে কায়াকিংয়ের ব্যবস্থা। চারদিকে পাহাড় আর সবুজ ঘেরাও লেকের স্বচ্ছ জলে কায়াকিংয়ের আনন্দ নিতে প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক ভিড় জমান এখানে। চাইলে পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে পারেন। সেখান থেকে দেখা যায় দূরের পথ। এক কিলোমিটার দূরের মহাসড়ক, তার অর্ধেকের রেলপথ, ট্রেনের ছুটে চলা, কৃষানির ধান মাড়ানো, কৃষকের ফলন, কিশোরের দুরন্তপনা এসবই দেখা মিলবে চূড়া থেকে।
পরিবার-পরিজন বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে পিকনিকের জন্য মহামায়া লেক দারুণ একটি স্থান। আপনি চাইলে এখানে রান্নাবান্না করেও খেতে পারবেন।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী যেকোনো বাসে টিকিট কাটতে হবে। নামতে হবে মিরসরাইয়ের ঠাকুরদীঘি বাজারে অথবা মহামায়া রাস্তার মুখে। নিজস্ব যানবাহন নিলে একেবারেই মহামায়ার গেটে নামতে পারবেন। আবার চট্টগ্রাম নগরের অলংকার সিটি গেট থেকে কিছু লোকাল বাসে করে ১০০ থেকে ১২০ টাকা ভাড়ায় ঠাকুরদীঘি নামতে পারবেন। ঠাকুরদীঘি থেকে জনপ্রতি ১৫-২০ টাকা সিএনজি ভাড়ায় চলে যেতে পারবেন মহামায়া ইকোপার্কের মেইন গেটে। অথবা সিএনজি রিজার্ভ করে (ভাড়া ৮০-১২০ টাকা) চলে আসবেন মহামায়া ইকো পার্ক। এই ইকো পার্কের ভেতরেই মহামায়া লেকের অবস্থান। প্রতিজন টিকেটের মূল্য ৩০-৪০ টাকা।
খৈয়াছড়া ঝরনা
আকার আকৃতি ও গঠনশৈলির দিক দিয়ে বেশ বড় এই খৈয়াছড়া ঝরনা। এর মোট ৯টি মূল ধাপ ও অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন ধাপ আছে। প্রকৃতির নান্দনিক তুলিতে আঁকা সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হবে ভ্রমণপিপাসু মানুষ। অনেকে রাতের বেলায় চাঁদের আলোয় ঝরনার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পাহাড়ের পাদদেশে তাঁবু টাঙিয়ে অবস্থান করেন। প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি সেতুবন্ধন করে, সবুজের চাদরে ঢাকা বনানী রূপের আগুন ঝরায়। যেখানে প্রকৃতি খেলা করে আপন মনে।
খৈয়াছড়ায় আছে অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন ধাপ, যা বাংলাদেশের আর কোনো ঝরনাতে এখনো পর্যন্ত দেখা যায়নি। তাই খৈয়াছড়াকে বলা হয় বাংলাদেশের ঝরনার রানি। মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া গ্রামের সবুজ শ্যামল আঁকা বাঁকা মেঠো পথ পেরিয়েই দেখা মিলবে বিস্ময়কর ঝরনা।
যেভাবে যাবেন খৈয়াছড়া ঝরনায়
ঢাকা থেকে যেকোনো বাস কাউন্টার থেকে চট্টগ্রামগামী বাসে উঠবেন। যাওয়ার পথে মহাসড়কের মিরসরাই পৌরসদর পার হয়ে বড়তাকিয়া বাজারের আগে খৈয়াছড়া ঝরনা রাস্তার মুখে নামবেন। চট্টগ্রামের একেখান থেকে সিডিএম, চয়েস অথবা উত্তরা বাসে করে এসে একই বড়তাকিয়ার পরে খৈয়াছড়া ঝরনা রাস্তার মুখে নামবেন। সেখান থেকে ১ কিলোমিটার সিএনজি করে জনপ্রতি ২০ টাকা, বাকি পথ পায়ে হেঁটে যেতে হবে।
রূপসী ঝরনা
প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্যের আরেক নাম বড় কমলদহ রূপসী ঝরনা। আঁকাবাঁকা গ্রামীণ সবুজ শ্যামল মেঠো পথ পার হয়ে পাহাড়ের পাদদেশে গেলেই শোনা যাবে ঝর্ণার পানি গড়িয়ে পড়ার অপরূপ শব্দ। দুই পাশে সুউচ্চ পাহাড়। সাঁ সাঁ শব্দে উঁচু পাহাড় থেকে অবিরাম শীতল পানি গড়িয়ে যাচ্ছে ছড়া দিয়ে। মেঘের মতো উড়ে আসা শুভ্র এ পানি আলতো করে ছুঁয়ে দেখলেই এর শীতল পরশ মুহূর্তে ক্লান্তি ভুলিয়ে দেবে।
টলটলে শান্ত পানির চুপচাপ বয়ে চলার ধরনই বলে দেবে এর উৎস অবশ্যই বিশাল কিছু থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পর্যটকেরা আবিষ্কার করবেন লাল আর নীল রঙের ফড়িঙের মিছিল। যত দূর পর্যন্ত ঝিরিপথ গেছে তত দূর পর্যন্ত তাদের মন মাতানো ঝিঁঝি পোকার গুঞ্জন শোনা যায়। রূপসী ঝরনার পানিতে গোসল করার লোভ সামলানো কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।
বছরের পর বছর ঝরনার পানি গড়িয়ে যাচ্ছে এই ছড়া বয়ে। কয়েক বছর পূর্বে রূপসী ঝরনা নামে আবিষ্কার হলো এটি। মিরসরাই উপজেলার সর্ব দক্ষিণে বড় দারোগারহাটের উত্তরে পাহাড়ের কোল অবস্থিত এক দৃষ্টিনন্দন, অনিন্দ্যসুন্দর এক জলপ্রপাত। মিরসরাইয়ের অন্যান্য ঝর্ণাগুলোর চেয়ে এই ঝরনায় যাওয়া অনেকটাই সহজ।
যেভাবে যাবেন
দেশের বিভিন্ন স্থান হতে যেকোনো বাসযোগে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বড়দারোগাহাট বাজারে নামবেন। এরপর সিএনজি অটোরিকশাযোগে বাজারের উত্তর পাশের ব্রিকফিল্ড সড়ক দিয়ে পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত যাবে। এরপর পায়ে হেঁটে ঝরনায় যাওয়া যাবে। অথবা যে কোনো বাস থেকে ব্রিকফিল্ড সড়কের মাথায় নেমে অটোরিক্সা ছাড়া আধা কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে যেতে পারবেন।
এ ছাড়াও এবারের ঈদুল আজহার ছুটিতে পর্যটকদের আগমন বাড়বে মিরসরাইয়ের আরশিনগর ফিউচার পার্কে, মুহুরী প্রজেক্ট প্রজনন কেন্দ্র, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর অর্থনৈতিক অঞ্চল, হরিনাকুণ্ড ঝরনা, নাপিত্তাছড়া ঝরনা, সোনাইছড়ি ঝরনা, বোয়ালিয়া ঝরনা ও মেলখুম ট্রেইলে।