নাদিয়া ইসলাম নিতুল:
Life is a highway the journey begins till the end. আমাদের যাপিত জীবনে আমাদের মনস্তত্ত্ব ক্ষুদ্র একটা গ-িতে আটকে রাখে, সেই বাক্সে বন্দি একগুঁয়েমি জীবন থেকে বের হয়ে নতুন শুরুটা তখনই সম্ভব যখন আমরা বের হই ‘নিজেকে জানার অভিযানে’। নিজের ভেতরের অসীম শক্তিকে তখনই অনুধাবন করা যায় যখন প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হই আমরা, নিজেকে জয় করার অভিযানটা সেখান থেকেই শুরু হয়। তখন আমরা হয়ে যাই অভিযাত্রী। ভ্রমণ মানে আমার কাছে নিজেকে জানার অভিযান। রহস্য রোমাঞ্চ ভালোবাসার বিষয়টা মনে হয় ছোটবেলা থেকে অ্যাডভেঞ্চার বই পড়া, মুভি দেখা, স্কুলের গ-িতে থাকার সময় গার্লস গাইড করার কল্যাণে শুরু। মেডিকেল কলেজের স্টাডি ট্যুরে দার্জিলিং গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার সূর্যোদয় দেখে প্রথম পাহাড়ের প্রেমে পড়েছিলাম। এফএম রেডিওতে কাজ করছি সেই ২০১১ সাল থেকে। কখনো স্টেশন থেকে ছুটি যদি নিতাম সেটার একটাই উদ্দেশ্য দূরে কোথাও ঘুরতে যাবো। সবচেয়ে প্রিয় অবশ্যই পাহাড়। পাহাড় একটা নেশার মতো যত যাবেন নেশা তত বাড়তেই থাকে।
ট্র্যাকিং করেছি সীতাকুণ্ড, কিউক্রাডং, দামতুয়া, ধুপপানি, হামহাম, রেমাক্রি, রোয়াংছড়ি, খাগড়াছড়ি রাঙামাটি থেকে বান্দরবান, এক একটা প্রকৃতির বুনো সৌন্দর্য মস্তিস্কের নিউরনে যেই সুখানুভূতি দেয় তা শব্দে বর্ণনা করা কঠিন। যে কখনো পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে তার বিশালতা অনুভব না করেছে তাকে বুঝিয়ে বলা সম্ভব না। ভ্রমণের প্রতি ভালোবাসা থেকেই এবিসি রেডিওতে ২০২০ থেকে শুরু করি ‘হাইওয়ে টু ট্রাভেল’ শো; যা আমাকে পরিচয় করায় দুঃসাহসিক সব পর্বতারোহী, ভ্রমণপ্রিয় মানুষ এবং অভিযাত্রীদের সঙ্গে, ভ্রমণের নেশাটা আরও পেয়ে বসে আর খুঁটিনাটি বিষয় জানার আগ্রহ বেড়ে যায় অনেকগুন। দুর্গমতা অনেক দেখেছি, পাহাড়ের ভয়ংকর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছি বহুবার। তবে এবারের ভ্রমণটা ছিল অন্যরকম, একই সাথে ভ্রমণ আর রোমাঞ্চের সংমিশ্রণ। সারা বিশ্বে ক্লাইম্বিং অত্যন্ত জনপ্রিয় অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস, যার রয়েছে অনেক রকম ধরর- লং ফেস র্যাপলিং (কন্ট্রোল ডিসেন্ডিং), জুমারিং, এক্সট্রিম হ্যামকিং, ক্যানোয়িং, জিপ লাইন, রিভার ক্রসিং। বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই এগুলো হয়। কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় ভ্রমণবিলাসী মানুষদের জন্য এই সুযোগটা করে দিয়েছে বাংলাদেশের অ্যাডভেঞ্চার একটিভিটি ক্লাব ‘ওয়াইল্ডারনেস বিডি’ ও ‘ক্রাক্স ডব্লিউ বিডি’, যারা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ভ্রমণপিয়াসী মানুষদের নিয়ে এই ইভেন্ট করে আসছে। তাদের ইভেন্টে অংশগ্রহণের মাধ্যমেই আমার অভিজ্ঞতা হলো জীবনে প্রথমবার র্যাপলিং করার।
ফকিরাপুল থেকে শ্যামলী বাসে করে সীতাকুণ্ড চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উদ্দেশে যাত্রা শুরু। এই ট্রিপে যাওয়ার আগে ২৪ জন ভ্রমণসঙ্গীর কেউ পরিচিত ছিল না। কাউন্টারে গিয়ে তানভীরের সাথে পরিচয় হওয়ার পর জান্নাত, তারেক, হাবিব ভাই, ইজাজ, ইমু, রেখাসহ সবাই এতো আন্তরিক ছিল যে মনেই হয়নি আমাদের প্রথম পরিচয়। প্রায় রাত ১২টায় রওনা দিয়ে ভোর ৫টায় আমরা পৌঁছে যাই সীতাকু-ে। সেখান থেকে আমাদের ইন্সট্রাক্টর সাদাব ইয়াসির ভাইয়ের সাথে পরিচয়, যার ৩ ঘণ্টার ট্রেনিং ও প্র্যাকটিস সেশন করেই ২৪ জন অভিযাত্রী জীবনে প্রথমবার ৩০০ ফুট র্যাপলিং করার রোমাঞ্চ উপভোগ করে। ইভেন্টের নাম ছিল ৩০০ ফুট লং ফেস র্যাপলিং। চন্দ্রনাথ পাহাড় ১০২০ ফুট, ৭১১ ফুট উচ্চতায় রয়েছে বীরুপাক্ষ মন্দির। সেখানকার ক্লাইম্বিং পয়েন্ট থেকে ৩০০ ফুট খাড়া পাহাড় (৩০ তলা উচ্চতার বিল্ডিং) বেয়ে লং ফেস র্যাপলিং করায় ‘ক্রাক্স ডব্লিউ বিডি’ টিম। লং ফেস র্যাপলিংয়ের আরেক নাম কন্ট্রোল ডিসেন্ডিং। যেখানে মোট তিনটি ক্লাইম্বিং গিয়ার থাকে- কোমড়ে হারনেস, ক্যারাভেনার, ফিগার অব এইট আর সেই সাথে স্টাটিক রোপ যার সাথে গ্লাভস। খুবই টেকনিক্যাল ও অ্যাপ্লাইড ফিজিক্সের সূত্র মেনেই এর প্রত্যেকটা ডিভাইস ব্যবহার করা হয় এবং কাজ করে। বিশেষ নেটের সাহায্যে হারনেসে সংযুক্ত ক্যারাভেনারের সাথে ফিগার অব এইট এবং রোপ যুক্ত করে এই এক্টিভিটি করা হয়। ক্রাক্স ডব্লিউ বিডির ক্রুরা বার বার করে বলে দেয় চুল ও জামা খুব সাবধানে রাখতে। কারণ ক্যারাভেনার এবং ফিগার অব এইটের মধ্যে কোনোভাবে কিছু আটকে গেলে বিপত্তি হতে পাওে, তখন ঝুলন্ত অবস্থা থেকে রেসকিউ করা ছাড়া কিছু করার থাকে না, আর ডান হাত দিয়ে ডিসেন্ড করে নামার সময় ক্যারাভেনার বার বার ঘষা খাওয়ার ফলে গরম হয়ে যায় তাই সাবধান থাকতে হয়।
আমার পালা শুরু হওয়ার পর প্রথম দিকে বেশ কিছু গাছের ডালপালার ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে র্যাপলিং করে নামতে শুরু করি। প্রথমে বার বার ডালপালা পায়ে আটকাচ্ছিল। ভয় বিষয়টা একেবারেই ছিল না। ভেতরে থেকে প্রচণ্ড এক রোমাঞ্চ অনুভব করছিলাম। প্রথমে দুইবার ব্যালেন্স রাখতে সমস্যা হচ্ছিল। কিন্তু কীভাবে যেন নিজের ভেতরের আত্মরক্ষার ক্ষমতা আমার মস্তিষ্ককে বলে দিচ্ছিল কীভাবে প্রতিকূলতা থেকে বের হতে হবে। প্রায় ৫০ ফুট নিচে আসার পর নিচে থেকে অভি ভাই ড্রোন নিয়ে অপেক্ষা করছে ফুটেজ নেয়ার জন্য। উনি বললেন- ‘আপু হাত পা ছেড়ে রিল্যাক্স হয়ে পেছনে তাকান আর রোমাঞ্চ অনুভব করেন।’ ৩০ তলা সমান উচ্চতায় ঝুলন্ত অবস্থায় আশপাশে দেখার সময় যে অ্যাড্রিনালিন রাশ (Adrenaline Rush- অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি থেকে অ্যাড্রিনালিন নিঃসরনের কারণে তীব্র উত্তেজনা ও উদ্দীপনার শারীরিক অনুভূতি) অনুভব করছিলাম তা মিলিয়ন ডলারেও হয় না। সেই সময় বার বার বলা হচ্ছিল- স্থির থাকার জন্য কিন্তু সেই সময় প্রচ- বাতাসের তোড় শুরু হওয়ায় বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল স্থির থাকতে। তারপরও নিজের ভেতরের অসীম ইচ্ছেটা সব সম্ভব করে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কোনো সারভাইভাল হলিউড মুভির দৃশ্যের মধ্যে আছি, সেই ঘোর যেন কাটছিল না, নিচে নামার পর রেখা আপুর তৈরি কফি পান করতে করতে মনে হচ্ছিল- জীবন সুন্দও, এটা অনুভব করার জন্য হলেও একবার এমন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা দরকার।
এরপর গিয়েছিলাম এক্সট্রিম হ্যামকিংয়ের ইভেন্টে। নাপিত্তাছড়া ট্রেইলে মাটি থেকে ১২০ ফুট উচ্চতায় দুই পাহাড়ের মাঝখানে হ্যামক ঝুলিয়ে দোল খাওয়ার অভিজ্ঞতা নিজে না করলে কখনো বলে বোঝানো সম্ভব না। প্রথমে খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে হয় ট্র্যাকিং করে। এর মধ্যে শুরু হলো বৃষ্টি। সেপ্টেম্বর মাস ছিল। পাহাড়ে ঝুম বৃষ্টির সাথে ফ্লাশ ফ্লাডের কথা নিশ্চয়ই অভিযাত্রীরা জানেন। পিচ্ছিল পাহাড়ি পথ বেয়ে অ্যাঙ্কর পয়েন্টে গিয়ে টাইরোলিন ট্রাভাস করে ১০ মিটার ডিস্টেন্স শূন্যে ঝুলে পার হয়ে হ্যামকে পৌঁছাতে লাইফ টাইম এক্সপেরিয়েন্স। জীবনের একটা সময় বার্ধক্য ছুয়ে যাবে, তখন মন চাইলেও দেহের সেই শক্তি থাকবে না, কিন্তু মস্তিষ্কের নিউরনে যে সুন্দর রোমাঞ্চ অনুরণন দিয়ে যাবে, তা ঠিক মৃত্যুর আগ মুহূর্তে যে যাপিত জীবনের সুন্দর স্মৃতির যে ফ্লাশব্যাক দেখবো তার মধ্যে থাকবে নিশ্চিতভাবে।
র্যাপলিং নিয়ে কিছু পরামর্শ
হারনেসের সঙ্গে ক্যারসভেনারের সাথে ফিগার অব এইট সংযুক্ত করে এই অ্যাক্টিভিটিতে অংশ নেয়া হয়। অনেকেই হয় তো জানেন না আগামী অলিম্পিকে ক্লাইম্বিং একটি ইভেন্ট হিসেবে যুক্ত হচ্ছে। তাই তুমুল সম্ভাবনা আছে বাংলাদেশের তরুণের এখানে অংশগ্রহণ এবং দারুণ কিছু করার। র্যাপলিংয়ের কিছু বেসিক একটু বলি।
ব্রিফিং-ট্রেনিং-প্র্যাকটিস
সেফটি ব্রিফিং দেয়া হয়। তিনটি সাধারণ বিষয় থাকে মূলত। এগুলো মেনে চলতে হয় সারাদিন। এরপর ট্রেনিং শুরু হয়। তারপর শুরু হয় অনুশীলন। যতক্ষণ না আপনার ব্যালেন্স, অ্যাক্টিভিটি, কনফিডেন্স লেভেল ভালো না হচ্ছে ততক্ষণ অনুশীলন করানো হয়।
গিয়ার ও রোপ
গিয়ারগুলোর ওয়েট ক্যারি করার ক্ষমতা কমপক্ষে ২৫ কেএন । অর্থাৎ ২৫০০ কেজির ওপর। একজন মানুষের ভার কত? ৫০/৭০/ ১০০/ ১৫০ কেজি। রোপ তার চেয়ে বহুগুণ ধারণ ক্ষমতার থাকে।
দুই রোপের নিরাপত্তা
এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি গিয়ারের ওয়েট ক্যারি করার ক্ষমতা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক অনেক বেশি হলেও এক্সট্রা একটি রোপ ব্যবহার করা হয় ব্যাকআপ হিসেবে। অর্থাৎ আপনি একটি রোপে র্যাপলিং করবেন, আর আপনার শরীরে বাঁধা অন্য একটি রোপ উপরে ক্রুদের হাতে থাকবে। ওই রোপের কন্ট্রোল সম্পূর্ণ তাদের হাতে থাকে। ফলে আপনি কোনো ভুল করলে বা কোনো কারণে আপনাকে উপরে তুলে ফেলতে হলে বা আপানি যে রোপ ও গিয়ারের সাহায্যে নামছেন সেটিতে বাই অ্যানি চান্স কোনো ত্রুটি চলে আসলে সাথে সাথে এক্সট্রা রোপটিতে চলে আসা যায়। বিলে রোপ এবং বিলে দেয়া এই ইভেন্টের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
রেসকিউ
উপরে একজন ইন্সট্রাক্টর সর্বদা গিয়ার আপ হয়ে প্রস্তুত থাকে, যাতে যেকোনো সমস্যায় এক সেকেন্ড সময়ও নষ্ট না করে অংশগ্রহণকারীর কাছে সাহায্য নিয়ে যাওয়া যায়। প্রস্তুত থাকে অংশগ্রহণকারীকে উপরে তুলে আনার সেট আপও ।
ইন্সট্রাক্টর টিম
এই টিমে থাকে চারজন। একজন নিচে সবাইকে প্র্যাকটিস করিয়ে প্রস্তুত করায় মূল ক্লাইম্বের জন্য। দ্বিতীয় ও তৃতীয় জন থাকে মূল অ্যাঙ্কর পয়েন্টে। মেইন রোপে অংশগ্রহণকারীকে নামাতে থাকে। বিলে রোপে অতিরিক্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাথে থাকে সাপোর্ট টিম মেম্বার এবং ডিভাইস । চতুর্থ জন নিচে থাকে। মেইন রোপের অ্যারেস্ট কন্ট্রোল করে এবং প্রস্তুত থাকে যাতে কোনো পরিস্থিতি কোনোভাবে সৃষ্টি হলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে রোপ বেয়ে উপরে উঠে সাহায্য পৌঁছে দেয়া যায়। সাথে থাকে সাপোর্টিং টিমের এক বা দুইজন সদস্য। ইন্সট্রাক্টর ও সাপোর্টিং টিমের মেম্বার মিলিয়ে কমপক্ষে ছয়জন থাকে।
লেখক: প্রোডিউসার, স্ক্রিপ্ট রাইটার, আরজে (এবিসি রেডিও)